নিঃশব্দ বন্ধুত্ব
সুচন্দ্রা বসু
মেঘলা সকালে জঙ্গল যেন নতুন করে জীবন্ত হয়ে ওঠে। পাখির কিচিরমিচির, পাতার উপর শিশিরের ঝরঝরে শব্দ, দূরে নদীর স্রোতের খশখশ ধ্বনি—সবই মিলে তৈরি করছে এক ধীর, স্বপ্নের মতো পরিবেশ।
নন্দিনী এক বছর ধরে এই জঙ্গলে বসবাস করছেন, শুধু একটি ছোট তাঁবু, কিছু খাতা আর ক্যামেরা নিয়ে। প্রতিদিন সকাল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তিনি বসে থাকতেন—চুপচাপ, গরিলাদের দিকে তাকিয়ে।
নন্দিনী লিখে রাখতেন—গরিলাদের দোলন, হাস্যোজ্জ্বল খেলা, সন্তানদের যত্ন, এবং দলীয় প্রধানের হঠাৎ রাগ। তিনি লক্ষ্য করতেন, তারা মানুষের উপস্থিতিতে মোটেও আতঙ্কিত নয়, বরং কৌতূহল প্রকাশ করে।
তার লক্ষ্য ছিল ধীরে ধীরে এই গরিলাদের বিশ্বাস অর্জন করা। তিনি জানতেন, প্রকৃতির নিয়মে বন্ধুত্ব সময় নেয়।
দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল। কখনও কখনও গরিলারা তাঁকে দেখে থমকে যেত, আবার তাদের কাজে ফিরে যেত। তিনি জানতেন—তাদের মধ্যে কিছুটা আস্থা তৈরি হয়েছে।
সিলভারব্যাক রূপালি-রঙের পুরুষ গরিলার দিকে তাঁর নজর সবচেয়ে বেশি থাকত। রূপালি শক্তিশালী, গরিলাদের নেতা। মাঝে মাঝে তার চোখে অদ্ভুত এক কৌতূহল দেখা যেত।
নন্দিনী লিখে রাখতেন— "রূপালি আজ চারপাশে দাঁড়িয়ে আমাদের কাছে কোনো হুমকি দেখাচ্ছে না। সে শুধু খেয়াল করছে।"
প্রতিটি ছোটো ঘটনার বিশ্লেষণ তাকে আরও কাছাকাছি এনেছিল এই অচেনা জীবনের সঙ্গে।
এক রাত, যখন জঙ্গল নিঃশব্দে নিস্তব্ধ ছিল, নন্দিনী ঘুমোচ্ছিলেন তাঁবুর ভিতরে। হঠাৎ তিনি অনুভব করলেন অদ্ভুত এক ছায়া তাঁর তাঁবুর মুখোমুখি।
রূপালি, দলের প্রধান, নিঃশব্দে তাঁবুর ভিতরে প্রবেশ করেছিল। সে ধীরে ধীরে নন্দিনীর দিকে এগিয়ে এল। তার মুখে অদ্ভুত এক মনোযোগ—প্রায় যেন পরীক্ষা করছে, "এ মানুষ কি বন্ধু নাকি শত্রু?"
রূপালি তার বড় হাতে নন্দিনীর মুখের দিকে হালকাভাবে স্পর্শ করল। কিছুক্ষণ তারা একে অপরকে চুপচাপ দেখল। তারপর, নন্দিনী যেন অনুভব করলেন—রূপালি তাঁকে বন্ধু হিসেবে স্বীকার করল।
সে ধীরে ধীরে তাঁবু থেকে বেরিয়ে গিয়ে আবার জঙ্গলের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
পরদিন সকাল, নন্দিনী লিখলেন— "আমি অবাক হইনি। রাতে আমি ঘুমিয়ে থাকার সময়ই তার জন্য আমার কাছে আসা সহজ ছিল। সে বুঝতে চেয়েছিল আমি শত্রু নাকি বন্ধু। আমি শুধু কৃতজ্ঞ যে সে আমাকে বন্ধু হিসেবে দেখেছে।"
নন্দিনী জানতেন, সম্পর্ক কখনো জোর করে তৈরি হয় না। প্রাকৃতিক বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে জন্ম নেয়। এই এক মুহূর্তের নিঃশব্দ সাক্ষাৎ তাঁদের মধ্যে এক নতুন সম্পর্কের সূচনা করেছিল।
সকাল হয়, সূর্যের সোনালী আলো জঙ্গলের গহীন সব কোণকে স্নান করাচ্ছে। নন্দিনী তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে বসে, রূপালির দলকে দেখছিল।
আজ তাঁর লেখায় ছিল এক নতুন আত্মবিশ্বাস, এক শান্তি—যে গরিলাদের সঙ্গে তিনি নিজেকে মিলিয়ে ফেলতে পারছেন, তার আনন্দে মন ভরে গেছে।
জীবনের সব ব্যস্ততা, মানুষের শহরের আওয়াজ—সবই যেন দূরে। এখানে, জঙ্গলে, প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে, তিনি খুঁজে পেয়েছেন এক অদ্ভুত বন্ধুত্ব।
দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল। নন্দিনী লক্ষ্য করছিলেন, গরিলারা তাঁকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে শুরু করেছে। ছোট ছোট গরিলারা কখনও তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসি বা কৌতূহল দেখাচ্ছিল। রূপালি, দলের নেতা, মাঝে মাঝে দূরে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে লক্ষ্য করত, যেন নিশ্চয়তা নিচ্ছিল যে তিনি শান্ত।
নন্দিনী নিজে বুঝতে পারছিলেন—এ এখন শুধু পর্যবেক্ষণ নয়। তিনি এদের সঙ্গে শেয়ার করতে শুরু করেছেন ছোটখাট খাবার, খেলনা বা কিছু টুকরো ফল। গরিলারা তা খুব সাবধানে গ্রহণ করত।
একদিন, রূপালি এসে নন্দিনীর কাছাকাছি বসে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। নন্দিনী তার চোখের গভীরে দেখতে পেলেন—কৌতূহল আর আস্থা মিশ্রিত এক অনুভূতি। তিনি মৃদু হাসলেন। রূপালি ধীরে ধীরে পিছনে হেটে চলে গেল, যেন বলছে—"তুমি এখন আমাদের পৃথিবীর অংশ।"
নন্দিনী প্রতিদিন লিখছিলেন—কীভাবে গরিলারা নিজেদের মধ্যে কথা বলে, কিভাবে সন্তানদের শিক্ষিত করে এবং দলের মধ্যে সীমা ও নিয়ম তৈরি হয়।
এক রাতে, নন্দিনী জিজ্ঞাসা করলেন নিজেকে—"মানুষ কি কখনো প্রকৃতির এই নিঃশব্দ ভাষা শিখতে পারবে?" তিনি শিখছিলেন—চোখের দেখার বাইরে আরও অনেক কিছু আছে। স্পর্শ, গন্ধ, শরীরের ভাষা—এসবই প্রাকৃতিক বন্ধুত্বের ভাষা।
রূপালি তাঁর পাশে এসে বসে, কিছুক্ষণ নীরব। নন্দিনী অনুভব করলেন—এ বন্ধুত্ব নিঃশব্দ হলেও গভীর।
একদিন, নন্দিনী দলে কিছু নতুন খাবার নিয়ে গিয়েছিলেন। গরিলারা প্রথমে কৌতূহল দেখাল, তারপর শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে গ্রহণ করল। রূপালি মাঝে মাঝে দূরে দাঁড়িয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করল।
নন্দিনী বুঝতে পারলেন—এখন তিনি শুধু পর্যবেক্ষক নন। তিনি দলের অংশ। তিনি দায়িত্ব অনুভব করলেন—এই বন্ধুত্বকে রক্ষা করা এবং তাদের জীবনকে বুঝতে শেখা।
রূপালি ধীরে ধীরে নন্দিনীর দিকে তাকাল। তিনি যেন বলছে—"আমরা তোমাকে স্বাগত জানাই। তবে সবকিছু আমাদের নিয়মমাফিক।"
নন্দিনী মৃদু হাসলেন। তিনি জানতেন—এই নিঃশব্দ আস্থা তাঁদের মধ্যে স্থায়ী হবে।
বছর কেটে গেল। নন্দিনী এবং গরিলাদের সম্পর্ক এখন ঘনিষ্ঠ। তিনি জানতেন—যদি তিনি কেউ বা কিছু হয়রানি করতে চায়, রূপালি এবং দল সবকিছু সাবধানে দেখবে।
এক বিকেলে, নন্দিনী বসে রূপালি এবং দলের খেলাধুলা দেখছিল। ছোট গরিলারা খেলে, মায়ার ছোঁয়া দেয় এবং রূপালি কখনও কখনও চুপচাপ তাঁর দিকে তাকায়।
নন্দিনী লিখলেন—"মানব আর প্রাকৃতিক জীবনের মধ্যে দূরত্ব কখনও পূর্ণ নয়। ধৈর্য, কৌতূহল এবং আন্তরিকতা থাকলে বন্ধুত্ব জন্ম নেয়। আমি বুঝেছি—এই বন্ধুত্ব নিঃশেষ নয়, এটি জীবনের চিরস্থায়ী শিক্ষা।"
সন্ধ্যা নামল, সূর্য হাসলো, জঙ্গল নিঃশব্দ। নন্দিনী জানতেন—এই বন্ধুত্বই তাঁর সবচেয়ে বড় অর্জন।
নন্দিনী লক্ষ্য করলেন, ছোট গরিলারা কখনও কখনও তাঁর দিকে আসে খেলতে। তারা ফল বা ছোট দড়ি নিয়ে খেলাধুলা শুরু করে। নন্দিনী ধীরে ধীরে তাদের খেলায় অংশ নিতে শেখেন।
একদিন, একটি ছোট গরিলা ফল নিয়ে তার কাছে এল। সে ধীরে ধীরে ফল রাখল নন্দিনীর হাতে। নন্দিনী হাসলেন—এ যেন এক ছোট স্বীকৃতি।
রূপালি দূরে দাঁড়িয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিল। সে যেন বলছে—"তুমি এখন আমাদের অংশ। তুমি বুঝতে পারছ আমাদের নিয়ম।"
নন্দিনী লিখলেন—"শিশুদের সঙ্গে খেলতে খেলতে আমি বুঝলাম—ভালোবাসা এবং বিশ্বাস নিঃশব্দে জন্ম নেয়।"
রাতের অন্ধকারে, নন্দিনী বসে লিখছিলেন। জঙ্গলের সবকিছু নিঃশব্দে শোনার সময়, তিনি রূপালির কাছাকাছি এসে বসার অভ্যাস লক্ষ্য করলেন।
রূপালি কখনও কখনও ঘুরে তাঁর দিকে তাকায়, কিছুক্ষণ থমকে থাকে, তারপর আবার জঙ্গলের অন্য দিকে চলে যায়।
নন্দিনী বুঝতে পারলেন—এ নিঃশব্দ সাহচর্যই তাদের বন্ধুত্বের গভীরতা। কোনো শব্দের প্রয়োজন নেই। চোখের যোগাযোগ, শরীরের ভাষা—সবই যথেষ্ট।
এক রাতে, জঙ্গলে প্রবল ঝড় বইতে শুরু করল। বাতাসে ধুলো, পাতার আওয়াজ, বজ্রপাতের ঝঞ্ঝন—সব মিলিয়ে এক অশান্ত পরিবেশ।
নন্দিনী তাঁবুর ভিতরে নিরাপদ থাকলেও তিনি চিন্তিত—গরিলারা কেমন আছে? তিনি বাইরে বেরিয়ে দেখলেন, রূপালি দলকে নিয়ে নিরাপদ স্থানে যাচ্ছিল।
রূপালি তাঁর দিকে তাকাল। নন্দিনী বুঝলেন—এ চোখের দৃষ্টিতেই আছে "সব ঠিক আছে, আমরা একসাথে।"
ঝড় শেষে, সব শান্ত হলো। নন্দিনী লিখলেন—"প্রকৃতির চ্যালেঞ্জে বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় হয়। নিঃশব্দ সাহচর্য, আস্থা—এগুলোই জীবনের সেরা শিক্ষা।"
নন্দিনী জঙ্গলের শেষ দিনগুলো পার করলেন ধীরে ধীরে। তিনি জানতেন—এখানকার প্রতিটি পাতা, প্রতিটি গাছ, প্রতিটি নিঃশব্দ দৃষ্টি তাঁর জীবনের অংশ হয়ে গেছে। রূপালি এবং দলের অন্যান্য গরিলারা তাঁকে বিদায় জানাতে বিশেষ কিছু করল না। তবে তাদের নিঃশব্দ উপস্থিতি, চোখের কৌতূহল আর আস্থা—সবই ছিল বিদায়ের অঙ্গীকার।
নন্দিনী তাঁবু ভাঙলেন, খাতা আর ক্যামেরা সংগ্রহ করলেন। যখন তিনি জঙ্গলের সীমান্তে দাঁড়ালেন, রূপালি একবার ফিরে তাকাল। সেই এক মুহূর্তের চোখের ভাষা—"তুমি আমাদের বন্ধু। তুমি আবার ফিরে আসবে।"
নন্দিনী হৃদয়ে অনুভব করলেন—এই বন্ধুত্ব নিঃশেষ নয়। এটি তার জীবনের অংশ হয়ে গেছে। শহরের ব্যস্ততা, কংক্রিটের জীবনে তিনি হয়তো আর গরিলাদের সঙ্গে থাকতে পারবেন না, তবে সেই নিঃশব্দ আস্থা এবং বন্ধুত্ব তার সঙ্গে সবসময় থাকবে।
শহরে ফিরে, তিনি লিখলেন—
"প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক কখনও সীমিত নয়। ধৈর্য, কৌতূহল এবং আন্তরিকতা দিয়ে তৈরি বন্ধুত্ব চিরকাল স্থায়ী। রূপালি আমাকে শিখিয়েছে—আস্থা নিঃশব্দে, বন্ধুত্ব শব্দহীনভাবে জন্ম নেয়। আমি জানি, আমি যে জঙ্গল ছেড়ে এসেছি, সেই জঙ্গল আমার হৃদয়ে বেঁচে থাকবে।"
ক্যামেরার ছবিগুলো, খাতার লেখা—সবই তার স্মৃতি। প্রতিদিন তিনি চোখ বন্ধ করে রূপালির সেই এক চুপচাপ নজরকে মনে করেন। জীবনের ব্যস্ততা, মানুষের আলো, সবকিছু মিলিয়ে তার মনে এই জঙ্গলের নিঃশব্দ বন্ধুত্বের অনুভূতি সর্বদা জাগ্রত থাকে।
নন্দিনী বুঝলেন—মানব এবং প্রকৃতির মধ্যে যা বন্ধুত্ব জন্মে, তা হয়তো কখনো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে হৃদয়ে বেঁচে থাকা সেই বন্ধুত্ব জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ।
জীবন এগোচ্ছে, কিন্তু নিঃশব্দ বন্ধুত্ব চিরস্থায়ী।
-------------------------
সুচন্দ্রা বোস
২৬৭/৫ জি. টি. রোড
পানপাড়া শ্রীরামপুর হুগলি

Comments
Post a Comment