সারপ্রাইজ....
— অর্পিতা মল্লিক
সকাল থেকে নীলিমার মেজাজ সপ্তমে চড়ে আছে। অকারণেই রান্নাঘরে বাসনপত্র প্রয়োজনের তুলনায় অনেক জোরে সরানো নড়ানো হচ্ছে, বরং ঠোকাঠুকি বলাই ভালো।আলোকবাবু ভালো করেই জানেন এখন কিছু বলতে যাওয়া মানে 'আগুনে ঘি ' দেওয়ার সামিল হবে ।কমদিন তো হলো না সংসার সমুদ্রে তরী বেয়ে চলার , প্রায় তিরিশ বছরের অভিজ্ঞতা। আজকের মেজাজের নেপথ্যের কারণ হলো গৃহকার্যসহায়িকার দুদিনের ছুটি নিয়ে তিনদিন ধরে অনুপস্থিতি। সব রাগ গিয়ে পড়বে তার উপর।
ভয়ে ভয়ে এক কাপ চা চাইতে তার কেটে যাওয়া গিটারের মতো গলায় উওর এলো ,"নিজে বানিয়ে নাও "...ব্যাস এটুকুই শুনতে চাইছিলেন আলোকবাবু । অনুমতি ছাড়া এই পরিস্থিতিতে রান্নাঘরে ঢুকলেই তো ধুন্ধুমার হতো। পরিপাটি করে চা করে নিজে এক কাপ নিয়ে নীলিমাকেও এক কাপ দিলেন। গলায় মধু ঢেলে বললেন, "আদা দিয়ে চা করেছি, খেয়ে নাও মাথা ঠাণ্ডা হবে।"
শ্লেষের সঙ্গে ঝাঁঝিয়ে ওঠেন নীলিমা ,"গরম চা খেয়ে মাথা ঠাণ্ডা হয় ! বুজরুকি যতো! তোমার আস্কারাতে মালতীর এতো বাড় বেড়েছে।না চাইতেই টাকা বাড়াও আরো । কি প্রতিদান দিচ্ছে, আমাকে খেটে মরতে হচ্ছে আর মহারাণী বাড়িতে আরাম করছে।"
নীলিমা রাগ করে হাজার কথা বললেও আলোকবাবু ভালো করেই জানেন মালতীকে গিন্নি কতোটা ভালবাসে।না চাইতেই আজ এটা কাল সেটা দিয়ে দেয়। ঘরের মেয়ের মতো হয়ে উঠেছে।ছেলে দুরে চলে যাওয়ায় মালতী যেন একটু বেশিই কাছের হয়ে গেছে...
" আমি সাহায্য করে দিচ্ছি , বলো না কি করবো ?"
উওর আসে," আদিখ্যেতা করতে হবে না।"
এদিকে সকাল থেকে বার পাঁচেক ফোন এসেছে , তার সাথে অগুনতি মেসেজ। বিজয়া সন্মেলনী উপলক্ষ্যে বন্ধুদের একটা গেট টুগেদারে যাবার বার্তা। আলোকবাবু রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কের উচ্চপদে কর্মরত। সহকর্মীরা প্রায় সকলে স্যাটার ডে ক্লাবের সদস্য। সদ্য দুর্গা পূজা পর্ব শেষ হয়েছে তাই বিজয়া উপলক্ষে বিশেষ খানাপিনার প্ল্যান হয়েছে আগামীকাল। আগে নীলিমাকে বললেও এই মুহূর্তে সাহসে কুলাচ্ছে না। পূজার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই মেনু ঠিক করা হয়েছে --তপসে ফ্রাই , ভেটকি পাতুরি, মাটন রেজালা --এসব ছাড়াও দামী স্কচের ব্যবস্থাও থাকবে।
আলোকবাবুর একমাত্র ছেলে অয়ন জার্মানিতে পোষ্টডক্টরেট করছে। পূজার সময় আসার কথা থাকলেও বিশেষ সেমিনার পড়ে যাওয়ায় আসতে পারে নি। সেই কারণে নীলিমা খুবই বিষণ্ণ হয়ে আছে। "বচ্ছরগন্ডার দিন বাড়ির ছেলে বাড়িতে না এলে কেমন লাগে?" স্বামীর কাছে এরূপ দরবার করেও কোনো লাভ হয়নি।
ভিডিও কলে রোজই ছেলের সাথে কথা হয়। অয়ন বাড়িতে থাকতে মা ঘেঁষা ছিল কিন্তু বাইরে গিয়ে সবসময় বাবার খোঁজ নেয়, খেয়াল রাখে। নীলিমার একটু অভিমান হয় কিন্তু কিছু বলে না।
মিঠে-কড়া দাম্পত্যে আলোকবাবু পরতে পরতে নীলিমাকে চেনেন। কোন পরিস্থিতিতে কিভাবে বরফ গলবে ভালোই জানেন । একটু নরম গলায় বললেন,"নীলি, আজ দমদমের বাড়িতে যাবে বিকেলে?"
ওপাশ থেকে কোনো উত্তর নেই, অগত্যা তিনি প্রস্তাব দিলেন," চলো না মা কে বিজয়ার প্রণাম করে আসি আর ফেরার পথে তোমার প্রিয় রেস্তোরাঁয় ডিনার সেরে ফিরব ।"
এবার কাজ হলো, একটু খুশির ঝিলিক খেলে গেল নীলিমার মুখে। সত্যি অনেক দিন বাপের বাড়ি দমদমে যাওয়া হয়নি। বাবা চলে গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে, মা আছেন, দাদা বৌদি আর এক ভাইঝি আছে। 'বাপের বাড়ি' নামে একটা সফ্ট কর্ণার প্রায় প্রতিটি মেয়ের মনেই থাকে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী দমদমের বাড়িতে সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হলো। মায়ের কাছে অয়নের কথা বলতে গিয়ে তো কেঁদে কেটে একসা! সস্নেহে দাদা বললেন,"কাঁদছিস কেন নীলি? কতো গর্ব হয় আমার অয়নকে নিয়ে! ছোট্ট ভাগ্নে কতো বড়ো হয়েছে।"
ভগ্নিপতিকে আড়ালে ডেকে ছুটি কাটিয়ে আসার পরামর্শ দেন। অয়নও বাবাকে তার কাছে যাওয়ার কথা বলেছিল । মাকে জানাতে বারণ করেছিল। পাসপোর্ট আগেই তৈরি ছিল। বাবার সাথে এসব কথা হতো মাকে লুকিয়ে। কিভাবে ভিসা আ্যপ্লাই করবে সবই জানিয়েছে অয়ন।
রেস্তোরাঁয় ডিনার সেরে বাড়ি ফিরে আলোকবাবু গিন্নিকে পরের দিনের স্যাটারডে ক্লাবের গেট টুগেদারের কথা বলতে নীলিমা হাসিমুখে তা অনুমোদন করে দেন । আলোকবাবু এবার নিশ্চিন্ত, মেঘ কেটে আলো দেখা দিয়েছে । গিন্নি কতো অল্পতে খুশি হয়ে যায় এটা ভেবে বড়ই ভালো লাগে। সাধারণত মহিলাদের যেসব বায়না থাকে - রকমারি শাড়ি, গয়না এসব কোনোটাই নীলিমার নেই।
পরদিন সকালে মালতী হাজির হতেই নীলিমা নরমে গরমে স্বমহিমায় ফেরেন। আলোকবাবু বৌয়ের ছোটখাটো বিষয়ে অভিমান, রাগ খুবই উপভোগ করেন - যেখানে ভালবাসার ভাষা হলো খুনসুটি, আর রাগের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে যত্নের পরশ।
আলোকবাবুকে বেরোবার আগে রীতিমতো এক প্রস্থ মুচলেকা দিতে হলো - "মাটন বেশি খাব না , এক পেগ মাত্র এক পেগ স্কচ খাব, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরব, নিজে ড্রাইভ করব না"..ইত্যাদি ।
অফিসে অনেকেই ওনাকে সমীহ করে চলে তার কর্মনিষ্ঠার ও সুপ্রতিষ্ঠিত ছেলের জন্য । শনিবারের মজলিসে বন্ধুকে গম্ভীর দেখে সহকর্মী বন্ধু সমীরবাবু জিজ্ঞেস করলেন,"কি রে এতো উদাস কেন? বৌদির সাথে মনোমালিন্য নাকি?"
"আরে না, ওর পূজার আগে থেকেই মন খারাপ। এবার নিয়ে দুবছর হলো অয়ন বাড়িতে নেই। গতবছর পূজার দুমাস আগেই গেছিল, এবার আসার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে একটি সেমিনারে যেতে হবে তাই আসতে পারল না ।"
"তো কি হয়েছে তোরা ঘুরে আয়। আর তোর তো অনেক ছুটি জমা আছে। সামনের বছর রিটায়ারমেন্ট, তার আগেই ইউরোপ ট্যুরটা করে আয় বৌদিকে নিয়ে। স্কেঞ্জেন ভিসা নিবি তাহলে একবারে ইউরোপ কভার হয়ে যাবে শুধু ইংল্যান্ডের জন্য আলাদা ভিসা লাগবে।"
অবাক গলায় আলোকবাবু বলেন, "তোর তো বেশ অভিজ্ঞতা আছে মনে হচ্ছে!"
"আরে গত বছর আমার শ্যালকের মেয়ের বিয়ে হলো, জামাই পোল্যান্ডে চাকরি করে। বৌকে ছাড়া ফিরে যেতে হল, পরে মেয়েকে পৌঁছতে শ্যালক স্ত্রীকে নিয়ে একেবারে রথ দেখা কলা বেচা দুইই করে এলো। সেজন্য আমি ডিটেইলস জানি।"
"এটা তো দারুণ বলেছিস সমীর। আমি অয়নের সাথে প্ল্যান করেছিলাম ওর কাছে যাব, কিন্তু এটা তো আরো ভালো। নীলিমা চমকে যাবে।"
" সুখী দাম্পত্যের চাবিকাঠি হলো সারপ্রাইজ দেওয়া মাঝে মধ্যে বুঝলে বন্ধু !"
" দেখ এই বয়সে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক দাঁড়িয়ে থাকে এক অদ্ভুত সমীকরণে -- ভালবাসা+অভ্যাস+খুনসুটির ঝগড়া -- ধৈর্য্য = বিবাহিত জীবন। কাজেই সারপ্রাইজ জাদুকাঠির মতো কাজ করে।"সমীর হাসতে হাসতে আলোককে বলে ।
কিছু দিন পর আলোকবাবু অফিসে তিনমাসের ছুটির দরখাস্ত জমা দিলেন। নীলিমাকে ছেলের কাছে যাবার কথাটা বলতে বাধ্য হলেন 'ভিসা'র জন্য। সব শুনে নীলিমা বেজায় খুশি, যা পারছে কিনে ট্রলি বোঝাই করছে। ছেলের জন্য কি নেবে ঠিক করতেই পারছে না।
আলোকবাবু যতোই বোঝান ওখানে সব পাওয়া যায়। গ্লোবাল মার্কেটিং এর যুগে বরং এখানের থেকে বেশি ভালো পাওয়া যায় কিন্তু মায়ের মন কোনো যুক্তির ধার ধারে না। দীর্ঘ দুবছর একমাত্র ছেলেকে কাছে না পাওয়া তৃষিত মাতৃত্ব একটি একটি করে দিন গুনছে। আলোকবাবু বুঝেই গেলেন লাগেজের বাড়তি মাশুল গুনতে হবে।
অবশেষে এলো প্রতিক্ষিত দিন। সকাল থেকে সাজো সাজো রব, রাত দশটায় ফ্লাইট। সন্ধ্যায় এয়ারপোর্টে পৌঁছে দফায় দফায়।সিকিউরিটি চেকিং, ইমিগ্ৰেশন , পাশপোর্ট ভিসা - বার কয়েক লাগেজ স্ক্রিনিং এর পর কর্তা - গিন্নি বিমানে চড়ে বসলেন । ততক্ষণে নীলিমা বেশ অধৈর্য্য হয়ে গেছে,"আমরা কি হাইজ্যাকার নাকি ! এতো চেকিং এর কি আছে?"
আলোকবাবু বলেন ," নিরাপত্তার জন্য নীলি, কি করা যাবে !"
মেঘের রাজ্য দিয়ে প্লেন চলেছে আর নীলিমা ভেবে চলেন কতোক্ষনে ছেলেকে দেখবেন। দীর্ঘ সময় পর ফ্র্যাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে পৌঁছে ভিসিটর লাউঞ্জে ছেলেকে দেখে চোখের জল আর বাঁধ মানলো না নীলিমার। দুহাতে জড়িয়ে ধরে মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বললেন,"কতো রোগা হয়ে গেছিস বাবু"...
আলোকবাবু হাসি মুখে মা ছেলেকে দেখছিলেন, চোখের কোণে জল চিকচিক করছিল তারো।
অয়ন গাড়ি ড্রাইভ করে বাবা মাকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। বাবা মা ছেলের সাফল্যে গর্বিত বোধ করে। নীলিমা বলেন,"তোকে আমি স্কুলে পৌঁছে দিতাম আর এখন তুই আমাদের নিয়ে যাচ্ছিস । কতো বড়ো হয়ে গেছিস। তবে আমার কাছে এখন থাকতে পারিস না !"
গলা ভারী হয়ে আসে নীলিমার। আলোকবাবু বলেন ," আবার কেন কাঁদছ? ছেলের কাছে তো এসে গেছ ।"
রাস্তায় এক আইসক্রিম পার্লারের সামনে অয়ন গাড়ি থামিয়ে মাকে বলে,"এখানকার আইসক্রিম খুব ভালো খাবে চলো, বাবা প্লিজ তুমিও আজকের খুশির মেজাজে চায়ের বদলে আইসক্রিম খাও।"
চারদিকে যেন খুশির হাওয়া বইছে।বেশ ঠাণ্ডা লাগছে।অয়ন বাবামার জন্য ওখানকার উপযুক্ত ভারী জ্যাকেট কিনে রেখেছিল । সেগুলো গায়ে চাপিয়ে বেশ আরাম লাগে আলোকবাবু ও নীলিমার ।
হাসিখুশিতে দিন কয়েক কেটে যায় । নীলিমা অয়নকে তার পছন্দের রান্না করে খাওয়ায় । অয়নও কাছাকাছি জায়গায় সুবিধা মতো ঘুরতে নিয়ে যায় বাবা মাকে। সাড়ে তিন ঘন্টার তফাৎ হওয়ায় জেট ল্যাগের সমস্যা খুব একটা হয়নি। একদিন অয়ন বলে ,"বাবা, এই উইকএন্ডে প্রাগ নিয়ে যাব তোমাদের।"
একটু হেসে আলোকবাবু বলেন ," শুধু প্রাগ?"
একটু অপ্রস্তুত হয়ে অয়ন বলে,"আর কোথায় যাবে? - সুইজারল্যান্ড যাবে তো।"
"আমি তোকে এমনকি তোর মাকেও এতোদিন বলিনি -- আমি প্ল্যান করেই এসেছি ইউরোপটা ঘুরব সবাই মিলে। তুই কি ভাবে ছুটি পাবি সেটা দেখ ।"
বাবার কথায় অয়ন আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। নীলিমা তো নিজের কানকে বিশ্বাস করতেই পারছে না। কাজপাগল স্বামী অফিস ছাড়া কিছুই বোঝে না সে এতোদিন ছুটি নিয়ে ঘোরাবেন।
অয়ন বাবাকে জড়িয়ে ধরে ,"এতো বড়ো সারপ্রাইজ দিলে বাবা, আমি তো ভাবতেই পারিনি। এটা আমাদের স্বপ্নের ভ্রমণ হবে যেটার সুখস্মৃতি সারাজীবন থাকবে।"
============
অর্পিতা মল্লিক
Dream Park, Sonarpur Station Road, Kolkata-700103

Comments
Post a Comment