আত্মরতি
এস. আজাদ
(১)
আজ ছুটির দিন। অফিস নেই, বসের হুকুম নেই, কোথাও যাওয়ার তাড়া বা তাগিদ নেই, কাজের মেয়েটার একবেলা ছুটি। তার ছুটি থাকলে নিয়ম করে কাজের মেয়েটাকে একবেলা ছুটি দেয় দেবাঙ্গী। আগে একা একা হাঁপিয়ে উঠলেও এখন অভ্যাস হয়ে গেছে একাকীত্বে। মানুষ অভ্যাসের বশ। নিঃস্তব্ধ নিস্তরঙ্গ এই দুপুরে দেবাঙ্গীর মন যেন শব্দহীন এক গতিধারা, যার স্রোতে ভেসে আসে ফেলে আসা দিনের প্রতিচ্ছবি। বুকশেলফে গুছিয়ে রাখা পুরনো ডায়েরি খুলে কখনো কখনো যাপিত জীবনের সম্পর্ক গুলো নেড়েচেড়ে দেখে। সময়ের দৃঢ় আলিঙ্গনে ধরা না দিয়ে দেবাঙ্গী মেতেছে সময়কে নিজের গ্রন্থিত বেঁধে রাখার বিভোর স্বপ্নে।
শুরুর আগেই শেষ হয়ে যাওয়া সম্পর্কের দায় তার মাথায় চাপিয়ে শুভ চলে গেছে। এক সময় যাকে জীবনের সমান্তরাল মনে হত, যাকে এক বেলা না দেখলে শ্বাসকষ্ট শুরু হতো, সেই মানুষটা এখন কারও স্বামী, কারও বাবা। কখনও-সখনও শুভর ফেসবুক স্ট্যাটাস, দেখা যায় হাসিমুখো সংসার। দেবাঙ্গী দেখে, কোন অনুযোগ অভিযোগ ছাড়াই ঠোঁটের কোনায় হালকা বাঁকা হাসির অস্পষ্ট রেখা ধরে রেখে স্ক্রল করে এগিয়ে যায়। এগিয়ে যাওয়াই তো জীবন। ঠিক অবজ্ঞা নয়। অন্য কিছু একটা থাকে সেই হাসিতে। তার হৃদয় এখন আর বিদ্ধ হয় না। শুভর সাজানো হাসির ঘরকন্নার ছবিতে— প্রথম প্রথম যেমন হতো। ছবির হাসি কি জীবন্ত নাকি শুধুই ফ্রেম! তা নিয়ে বিশেষ মাথা না ঘামালেও মাঝে মাঝে ছুটির বিকালে মাথাব্যাথা করে বৈকি ! অসংলগ্ন ভাবনায় দীর্ঘ ভ্রমণে কারো কাঁধে মাথাটা রাখতে ইচ্ছা করে, এখনও ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করে। কিন্তু ইচ্ছা করলেই বা কার কি!
দেবাঙ্গী চাইলেও ভুলতে পারে না সেদিনের কথা যেদিন, প্রবল গ্রীষ্মের দহনজ্বালা জুড়িয়ে শীতল করেছিল প্রথম আষাঢ় ধারা। দুই ক্লাস ওপরে পড়া শুভদের ছাদের ঘরে জটিল অঙ্ক বুঝতে বুঝতে আউলানো মাথা বৃষ্টির জলে ঠান্ডা করতে গিয়ে প্রথম প্রেমের তপ্ত নিঃশ্বাসে হারিয়ে ফেলেছিল নিজেকে। ছাদ জুড়ে ছড়ানো বৃষ্টির মাঝে ঈশ্বর-ঈশ্বরী খেলে ক্লান্ত দেহভার ছেড়ে দিয়েছিল আর এক দেহে। সে জানে না শুভর বৃষ্টি দেখলে এখনও ভিজতে ইচ্ছা করে কিনা, একা কিংবা যুগলে মন চাইলে ভেজে কিনা! নাকি শরীর খারাপের ভয়ে আঁচলে মাথা গলিয়ে বৃষ্টির দুপুরে বন্ধ জানালার ভিতর নাক ডাকিয়ে ঘুমায় কুম্ভকর্ণ। বাইরে বিষণ্ণ বৃষ্টি একা একা পাহারা দেয় প্রেম প্রণয় আর বিচ্ছেদের শিলালিপি।
জানালার ওপাশে বাজতে থাকা ঘুঘু ডাকের বিষণ্ণতার মাঝে, আপন তেজে মাথার উপর জ্বলতে থাকা সূর্য নিজে দাঁড়িয়ে থেকে যখন পারদ স্তম্ভের তদারকি করে তখন হিসাবের খাতা খুলে বসলে ব্যালেন্সের কলাম জুড়ে শুধুই শূন্যতা। কে জানে? তার জীবনে একরকম কত শত শূন্যস্থান রয়ে গেছে— যা কখনো পূর্ণ হবে না। শূন্যতাকে কেন্দ্র করেই হয়ত দেবাঙ্গীর পরিণতি। জীবনতো একটা চক্র, শূন্যতাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়।
মায়ের চলে যাওয়াটা যেন তার জীবনের এক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটায়। বাবা নামক লোকটা থাকতেও বাবা না ডাকতে পারার যন্ত্রণা তার মা কোনদিন বুঝতে দেয়নি। বাবার কথা উঠলে বলত আমিই বাবা, আমিই মা। বাবার বৈষয়িক প্রয়োজন মেটাতে পারলেও অপত্য স্নেহ, বাবার গায়ের গন্ধ, আদর আবদার একা একজন মা দিতে পারে না। মা তো মা-ই, মা কখনো বাবা হতে পারে না। আসলে সরকারী চাকরির অহংকারে অহংকারী মা, বেকার বাবার যন্ত্রণটা বোঝার চেষ্টা তো করেইনি, উল্টে শীতল প্রেমের লাঞ্ছনায় বিষিয়ে তুলেছিল মিনিট ঘন্টা দিন রাত মাস বছর। বাবার জীবনের নিদারুন করুন পরিণতি আর তাকে বাবার স্নেহ ছায়া থেকে দুরে সরিয়ে রাখা মাকে অপরাধী সাব্যস্ত করে গারদ হীন নির্জন কারাগারে নিজেকে শাস্তি দিয়েছে। বাবার মৃত্যুর পর শেষ কিছু বছরে মা আর দেবাঙ্গীর সম্পর্কের জমাট বরফ কিছুটা গলেছিল সময়ের উত্তাপে —অসীম ভালোবাসার আড়ালে ইগোর বুকে মুখ লুকিয়ে থাকা বোবা ভাষাগুলো কিছুটা উন্মুক্ত হয়েছিল। এখন সেই অনুভূতিগুলোও ক্রমশ ভোঁতা হয়ে আসছে। মায়ের মৃত্যুর সাথে সাথে জৈবিক পরিচয় ও সম্পর্কের বোঝা নামিয়ে রেখে সে আত্ম পরিচয়ে একাকী ভেসে যেতে থাকে।
দায়িত্ব বাড়লেও অফিসের ব্যস্ততা এখন অনেকটা কমে এসেছে। পদোন্নতি হয়ে আরও উপরে উঠে গেছে সে। বয়সের ব্যস্তানুপাতে জীবনের অস্থিরতাগুলোও কমতে কমতে নিজের ভিতর একধরনের স্থিরতা এসে বাসা বেঁধেছে। না, একাকীত্ব নয়—বরং এক নিজস্বতা। যেন পৃথিবীর সঙ্গে নয়, এখন সে সহবাস করে একান্তই নিজের সঙ্গে।
একসময় যাকে ছাড়া জীবন অচল মনে হয়ে ছিল, মনে হয়ে ছিল সে পাশে না থাকলে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে কিন্তু সময় নামক সঞ্জীবনী সুধামৃতের সাথে জড়াজড়ি করে থাকতে থাকতে বেঁচে থাকাটা যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এমন সে অভ্যাস যেখানে বিশেষ ব্যক্তিটি ছাড়াই আছে। দিব্যি আছে। জীবন অচলও হয়নি নিঃশ্বাসও বন্ধ হয়নি। আসলে ওগুলো প্রচলিত বাগধারার মতো। আর পাঁচটা অভ্যাসের মতো। বলতে হয় তাই বলা। আসলেই বিশুদ্ধ ভালোবাসা বলে কিছু হয় না। ভালোবাসা ততক্ষণ বিশুদ্ধ যতক্ষণ শর্তহীন আত্মসমর্পণ। ভালোবাসা ততটাই গভীর তুমি যতটা বুদ্ধিহীন বাধ্য।
দেবাঙ্গী অফিস ফেরত বিকেলবেলা নিজে বাজার করে, রাত্রে নিজের জন্য রান্না করে, সকালের জন্য তুলে রাখে ফ্রিজে, ঝুল বারান্দায় বসে আকাশ দেখতে দেখতে এক কাপ লাল চায়ে নিমগ্ন থাকে রবীন্দ্রসংগীতে। সকালবেলা শাড়ি পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে—যেখানে একটা দুটো নয় অজস্র গল্প জমে আছে স্থির হয়ে, যোগ্য শ্রোতার অভাবে জমে আছে কতো না বলা কথা। নিজের কথার পুনরাবৃত্তি করে নিজের কাছে। নিজের কথা ভার লাঘব করে নিজেই। কখনো আবার চিঠি লেখে নিজেকে।
"প্রিয় দেবাঙ্গী,
তুই তো অন্যরকম। কেউ তোকে বুঝতে পারেনি। একথা ঠিক, তুই নিজেও কি বুঝেছিস ? হয়তো বুঝেছিস, হয়তো বুঝিসনি। যারা বুঝেছে বলে ভাবতিস তারা আসলে তোকে বোঝেনি, বোঝার ক্ষীণ চেষ্টাও করেনি কোনো দিন, শুধু ব্যাবহার করতে চেয়েছে তোর নিষ্পাপ সরলতাকে। একটা সময় পাগলের মতো ছুটেছিস সময়ের পিছনে আর এখন সময় তোর পিছু ছুটে বেড়ায় পোষা বিড়ালের মতো। আদুরে সময়। একটা সময় তোর প্রেম ছিল, স্বপ্ন ছিল, রাগ ছিল, অভিমান ছিল, না পাওয়ার, পেয়ে হারানোর ভয় ছিল। আজ সব গেছে। তুই শুধু নিজের। নিজেকে নিয়ে ভাবিস, নিজেকে ব্যস্ত রাখিস, নিজেকে শাসন করিস আদর করিস। এটাই যথেষ্ট। নিজেকে ভালো না বাসলে অন্য কাউকেও ভালোবাসা যায় না রে। এমনই করেই, ভালো থাকিস।
— ইতি, দেবাঙ্গী
(২ )
হেমন্তের ধোঁয়াসামাখা অলস এক সন্ধ্যায় বারান্দায় কেদারায় বসে দুলতে দুলতে আর দুলুনির তালে তালে ঝিমুতে ঝিমুতে হঠাৎ তার মনে হয়—শুভর সঙ্গে সম্পর্কটা কি শুধুই প্রেম ছিল? নাকি সমাজের প্রচলিত সম্পর্কের ভিতরে জমে থাকা শর্ত ভাঙার এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা? আজ বুঝতে পারে—শুভ আসলে ছিল এক উদ্দেশ্যহীন অস্থায়ী প্রক্রিয়ার অংশ, স্থায়ী গন্তব্য নয়।
আর 'ভালোবাসা'?
সেটা এখনও আছে—তবে বাইরের কারও জন্য নয়। আজকাল দেবাঙ্গী নিজের চুলে হাত বুলিয়ে বলে, "তুই ভালো আছিস তো?" নিজের কাছে সে করেছে শর্তহীন আত্মসমর্পণ। সে এখন নিজের কাছে বুদ্ধিহীন আনুগত্যে বাধ্য।
এ এক নতুন প্রেম, নিজেকে নিয়ে। কোথায় যেন একদিন পড়েছিল ঠিক মনে নেই, এক আত্মসচেতন নারী নিজেকেই বিয়ে করেছে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে করেছে সিঁদুরদান। সে নারী এখন হয়ত আত্মরতিতে মগ্ন।
দূর থেকে পাখির ডাক ভেসে আসে। একটি মৃত পাতা টুপ করে ঝরে পড়ে বারান্দায়। সেও একদিন ঝরে যাবে মেহগিনি পাতার মতো বাতাসের সাথে নয়ত নিজের ভারে অতি ধীরে। কোলাহলহীন।
জীবনের কোলাহলের মাঝে অবসম্ভাবী মৃত্যু আসুক নীরবে, নিস্তব্ধতার কফিনে কফনে জড়াজড়ি করে। কোনো শেষ ইচ্ছা নেই শুধু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগে একবার শুধু একবার সুন্দর করে সাজতে চায়। বাসর কিংবা নবমীর রাতের মতো, যেমন করে সাজলে অন্যের চোখে ঈর্ষার আগুন কুণ্ডলী পাকিয়ে ধকধক করে জ্বলে ওঠে। যে আগুনে প্রতিপক্ষকে পুড়িয়ে পাওয়া যায় অসীম শান্তি, পাওয়া যায় একাকী গহীন গাঙে অবগুণ্ঠনহীন অবগাহনের অপার প্রশান্তি।
সব কিছু ফেলে সময়কে সাথে নিয়ে জীবন এগিয়ে যায়—নির্জন, তবে শুদ্ধ।
__________________
এস. আজাদ (সেখ মহঃ সানি আজাদ)
শিবপুর ,দীঘিরপাড় পোস্ট - রাজবাটী জেলা - পূর্ব বর্ধমান
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত, পিন নম্বর - ৭১৩১০৪

Comments
Post a Comment