মহাশক্তি আসলে এক এবং অদ্বিতীয়
অর্হণ জানা
হিন্দুধর্ম অনুযায়ী জগতের স্রষ্টা ব্রহ্ম, আবার তিনিই পুরুষ ও প্রকৃতিতে দ্বিধাবিভক্ত। পুরুষ পুংশক্তি, আর নারীশক্তি হল প্রকৃতি। আর এই অপরূপ প্রকৃতিই পরমব্রহ্মের শক্তি।
হিন্দু শাস্ত্রমতে, এই নারী শক্তিই আদিশক্তি বা আদ্যাশক্তি মহামায়া। শক্তির মূল উৎস শক্তিমান ব্রহ্ম, এবং এই মাতৃশক্তি তাঁরই প্রকাশ।
সে জন্য তাঁকে বলা হয় ব্রহ্মারূপিণী। হিন্দু শাক্ত অনুসারীগণ তাঁকে বিভিন্ন নামে পুজো করেন। পরমাশক্তি, মহাশক্তি, মহাগৌরী, মহাদেবী, মহালক্ষ্মী, চামুণ্ডা, কালী, তারা, দুর্গা, জগদম্বা, সীতা, রাধা, ইত্যাদি।
আদিশক্তির বিভিন্ন রূপ
হিন্দু পুরাণে আদ্যাশক্তি বা মহাশক্তির বিভিন্ন রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। তার মধ্যে বাংলা বারো মাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে আদিশক্তির বারোটি রূপ বাঙালি শাক্ত অনুসারীদের মধ্যে প্রচলিত আছে। এগুলি হল--- গন্ধেশ্বরী, ফলহারিণী, কামাক্ষ্যা, শাকম্ভরী, পার্বতী, দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, কাত্যায়নী, পৌষকালী, রটন্তীকালী, সঙ্কটনাশিনী ও বাসন্তী। এখানে সেই বারোটি রূপ সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
গন্ধেশ্বরী
বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস, বৈশাখ মাসের পূর্ণিমাতে গন্ধবণিকেরাই দেবী গন্ধেশ্বরীর পুজো করেন। গন্ধেশ্বরী মাতৃশক্তির প্রতীক। বাংলার গন্ধবণিকরা আগে শৈবধর্মের উপাসক অর্থাৎ শিবের উপাসক হলেও পরবর্তীকালে শাক্ত উপাসক হয়ে ওঠেন।
ফলহারিণী
হিন্দু তন্ত্রমতে, ফলহারিণী কালী হল আদ্যাশক্তির একটি রূপ। জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যা তিথিতে বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ জীবনের বাধা-বিপত্তি দূর করার জন্য নানা রকম ফলমূল, মিষ্টান্ন দিয়ে ফলহারিণী কালীর পুজো করে থাকেন।
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এই দিনেই ১২৮০ বঙ্গাব্দে দক্ষিণেশ্বরে আদ্যাশক্তির সগুণরূপে স্ত্রী সারদা দেবীকে পুজো করেছিলেন। আজও রামকৃষ্ণ মঠ ও আশ্রমে এই পুজো 'ষোড়শী' পুজো নামে মহাসমারোহে পালিত হচ্ছে।
কামাক্ষ্যা
আদ্যাশক্তির আরও এক রূপ--- কামাক্ষ্যা। বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী, আষাঢ় মাসে দেবী কামাক্ষ্যার পুজো করা হয়। এই সংক্রান্ত একটি ছড়াও প্রচলিত রয়েছে--- '৬ আষাঢ় অম্বুবাচী, এর নেই কোনও পাঁজিপুঁথি'। এই পুজো উপলক্ষ্যে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় অম্বুবাচী উৎসব পালন করা হয়।
অম্বুবাচী তিথিতে মহাধুমধাম করে পূজিত হন দেবী কামাক্ষ্যা। আসামের অত্যন্ত জাগ্রত কামাক্ষ্যা মন্দিরে সবচেয়ে বড় অম্বুবাচী উৎসবের আয়োজন করা হয়।
শাকম্ভরী
শাকম্ভরী হলেন শ্রাবণ মাসের আরাধ্যা দেবী। দেবীর এই রূপের বর্ণনা মার্কণ্ডেয় পুরাণ ও দেবীভাগবত পুরাণে বর্ণিত আছে। দেবীভাগবত পুরাণে উল্লেখ আছে, হিরণ্যাক্ষ বংশধর রুরুর পুত্র দুর্গমাসুরকে বধ করার জন্যই দেবী পার্বতী শাকম্ভরী রূপ ধারণ করে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
শ্রাবণ মাসে প্রকৃতিতে প্রাচুর্য আনেন তিনি। ওঁর কৃপাতেই বাংলার মাঠঘাট ভরে ওঠে শাকসব্জিতে, এমনটাই মনে করেন দেবীর ভক্তরা। আর সেজন্যই গাছগাছালির পাতার রঙের সঙ্গে মিল রেখে এই দেবীর গায়ের রংও সবুজ। যদিও আদিশক্তির এই রূপের পুজো এখন অনেকটাই কমে গেছে গ্রামবাংলায়।
কৌশিকী
একবার শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামে দুই ভয়ঙ্কর অসুর ব্রহ্মার বরে বলিয়ান হয়ে স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল জয় করে ফেলেছিল। তখন স্বর্গ হারানোর ভয়ে আতঙ্কগ্রস্থ দেবতাদের অনুরোধে দেবী পার্বতী নিজের কোষিকা থেকে একজন দেবীর সৃষ্টি করেন, যিনি ভাদ্র মাসের অমাবস্যা তিথিতে ওই সহদর দুই ভাইকে বধ করেন। যেহেতু কোষিকা থেকে ওই দেবীর উৎপত্তি, তাই ওই দেবীর নাম হয়--- কৌশিকী।
পার্বতী
মহাদেব ও পার্বতী হলেন পুরুষ ও প্রকৃতি। তাঁদের মিলনেই পৃথিবীতে অব্যাহত থাকে জীবনধারা। পুরাণ মতে, ভাদ্র মাসে ঘটেছিল মহাদেব ও পার্বতীর প্রথম মিলন। তাই ভাদ্র মাসের আরাধ্যা দেবী হলেন--- পার্বতী।
দুর্গা
আশ্বিন মাসে যাঁর আরাধনায় মেতে ওঠে গোটা বাংলা, তিনিই হলেন দুর্গমাসুর দমনকারিণী দেবী দুর্গা। রামায়ণে যে অকালবোধনের কথা বলা হয়েছে এবং রামচন্দ্র যাঁর আরাধনা করেছিলেন, তিনি হলেন আদিশক্তির এই রূপ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই দেবীর সঙ্গেই মহিষাসুরমর্দিনী ও চার সন্তানের জননী দেবী পার্বতীর রূপটি মিশিয়ে পুজোর প্রচলন শুরু হয় বাংলায়। এখন বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ এবং ব্যয়বহুল উৎসব হল এই দুর্গোৎসব। দুর্গম নামের এক বিরাটকায় দৈত্যকে বধ করার জন্যই দেবী পার্বতীর নাম হয়--- দুর্গা।
জগদ্ধাত্রী
দেবী জগদ্ধাত্রী কার্তিক মাসের আরাধ্যা দেবী। পৌরাণিক কাহিনিতে বলা আছে, একবার ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু ও চন্দ্র--- এই চার দেবতা খুব অহঙ্কারী হয়ে উঠেছিলেন। মহাশক্তির শক্তিতেই যে তাঁরা বলীয়ান সেটা ভুলে গিয়েছিলেন।
তখনই তাঁদের সামনে উপস্থিত হন দেবী জগদ্ধাত্রী। তিনি জগতের রক্ষাকারিণী দেবী।
পশ্চিমবঙ্গের চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো সবচেয়ে বিখ্যাত। আলোর কারিকুরিতে সাজানো হয় পুরো শহরটিকে। চার দিনের এই পুজোর শেষ দিনে ওখনকার সমস্ত পুজো কমিটি পর পর লাইন দিয়ে শোভাযাত্রা বের করে একই দিনে দেবীমূর্তির বিসর্জন দেন।
কাত্যায়নী
আদিশক্তির কাত্যায়নী রূপের পুজোর প্রচলন রয়েছে অগ্রহায়ণ মাসে। মূলত বিবাহ ও সন্তান কামনা পূরণ করার জন্য অনেকে দেবী কাত্যায়নীর আরাধনা করেন।
ভাগবত পুরাণ অনুযায়ী, ব্রজের গোপিণীরা কৃষ্ণকে স্বামীরূপে পাওয়ার জন্য এই দেবীর মূর্তি গড়ে পুজো করেন মাঘ মাসে।
কিন্তু বাংলার নবদ্বীপের রাসযাত্রায় অগ্রহায়ণ মাসেই দেবী কাত্যায়নীর পুজোর প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশের মাগুরায় বেশ ঘটা করে কাত্যায়নী উৎসবের আয়োজন করা হয়। ঋষি কত্যায়ানের মেয়ে হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন বলেই দেবীর এই রূপের নাম হয়--- কাত্যায়নী।
পৌষকালী
বাংলার অনেক কালীমন্দিরেই পৌষকালীর পুজো হয়। আদিশক্তির এই রূপকে বলা হয়--- মোক্ষদানকারিণী। পৌষ মাসে পুজো বলে এই মাসের অন্যতম প্রধান সবজি মুলো নিবেদন করা হয় দেবীকে। তাই এখনও অনেকেই এই পুজোকে মুলোকালী পুজো বলেন।
রটন্তীকালী
মাঘ মাসের কৃষ্ণ চতুর্দশীতে আদিশক্তির আর এক রূপের পুজো করা হয় বাংলার বিভিন্ন কালী মন্দিরে। দেবীর এই রূপকে বলা হয়--- রটন্তীকালী। আদিশক্তির এই রূপকে গৃহের সুখশান্তির রক্ষাকারিণী দেবী হিসেবে গণ্য করা হয়। রটন্তীকালীর আরাধনায় সাংসারিক জীবন সুখের হয় বলেই ভক্তরা মনে করেন।
সঙ্কটনাশিনী
ফাল্গুন মাসের আরাধ্যা দেবী হলেন--- সঙ্কটনাশিনী। বসন্তের শুরুতে এই সময় বাংলার ঘরে ঘরে নানা ধরনের রোগের প্রকোপ দেখা যায়। তাই জীবনসঙ্কট ও অন্যান্য বিপদের হাত থেকে উদ্ধারের জন্য মায়ের ভক্তরা এই সঙ্কটনাশিনী দেবীর পুজো করে থাকেন।
বাসন্তী
চৈত্র মাসে বাসন্তী দেবী হিসেবে পূজিতা হন দেবী দুর্গা। শরৎকালে দুর্গা পুজোকে যেমন শারদীয় দুর্গাপুজো বলা হয়, ঠিক তেমনি চৈত্র মাসে বা বসন্তকালে বাসন্তী পুজোকে বলা হয় বাসন্তী দুর্গোৎসব। পুরাণ মতে, রাজা সুরথ ও সমাধি বৈস্য বাসন্তী দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন। চৈত্র মাসে বাংলার অনেক জায়গায় আদিশক্তিকে অন্নপূর্ণা রূপে পুজো করা হয়, আবার কোথাও বাসন্তী রূপেই আরাধনা করা হয়।
বারো মাসে বারো রূপে পূজিতা হলেও মহাশক্তি আসলে একটাই। এক এবং অদ্বিতীয়।
---------------------------------
ARHON JANA অর্হণ জানাYASH
Barajaguli, Gopal Road, Haringhata, Nadia
Pin - 741221
Opposite telephone exchange
Phone number : 8942013906
Comments
Post a Comment