অভিমান
তন্ময় পালধী
গত কয়েকদিন ধরেই একটানা বৃষ্টি চলছেই। আকাশ ঘন অন্ধকারে ঢাকা। বিকেলে বারান্দায় বসে অনুভাদেবী সবে খবরের কাগজ খুলেছেন, ঝমঝমিয়ে আবার বৃষ্টি নামল। একটানা বৃষ্টিতে মন খারাপ হলেও আজ আর বারান্দা ছেড়ে উঠে যেতে ইচ্ছে করলো না। ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে ডুব দিলেন অতীতে। স্মৃতির ক্যানভাসে জীবন্ত হয়ে উঠলো পুরানো দিনগুলি।
কদিন ধরেই চরম ব্যস্ততা বালিয়াল পরিবারে। বাড়ির ছোটমেয়ে অনুভার বিয়ে। সবে ম্যাট্রিক দিয়েছে। তার ইচ্ছা আরও পড়ার, বাবার ও তাই ইচ্ছে। কিন্তু সমাজ! তখনকার রীতিতে মেয়ের বয়স পনেরো ষোল হলেই দিয়ে দাও বিয়ে। অগত্যা বাবা আর কি করেন। টিচার্স ট্রেনিং কলেজে সিলেকশন হয়েও তাই ভর্তি হওয়া হলো না। বিষণ্ণতা নিয়েই বিয়েতে রাজি হয়ে গেলেন। সেদিনও বিকেল থেকে প্রচন্ড বৃষ্টি। আকাশভাঙা বৃষ্টিতে যেন চারিদিক ভেসে যাবে। সকলে চিন্তিত হয়ে পড়লেন।সাড়ে আটটায় লগন। মুহূর্তগুলো যেন কাটতেই চায় না। এক একটা মিনিট ঘন্টাখানেক বলে মনে হচ্ছে। চিরকালই অন্তর্মুখী সে। তার মনে যে কি ঝড় চলছে কেউই বুঝতে পারছে না। অথচ বিপরীতমুখী একটা আশাবাদিতা তাকে স্থির অবিচল রেখে দিয়েছে। মনের গতিপ্রকৃতি বড়ই জটিল। তাই সেও কি একটু টেনশনে। মেধাবী অনুভাও আজ লোকের বাঁকা কথায় ভীত। হঠাৎ উলুধ্বনির শব্দে চিন্তাসূত্র ছিন্ন হলো। দোতলার জানালার শার্সি খুলে দেখলেন, বরের পালকি দুয়ারে দাঁড়িয়ে। কত পুরানো এখনো যেন টাটকা,জীবন্ত।কিন্তু চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেলো সীতেশের ডাকে।কইগো এসো, তখন থেকে বারান্দায় বসে রয়েছো। ঠান্ডা লেগে সর্দি বাঁধাবে যে।
মনে পড়ে, এ বাড়িতে এসে শ্বশুরমশায়ের কড়া অনুশাসনে প্রথম দিকে মানিয়ে নিতে বেশ অসুবিধা হতো। কিন্তু সীতেশের ভালোবাসায় আপ্লুত সে।তার মনখারাপের মেঘগুলো পাড়ি দেয় ভালোবাসার রাজ্যে। কোল আলো করে জন্ম নেয় পুত্রসন্তান। সংসারের দায়িত্ব বাড়ছে। এমন সময়ে আবার অ্যাপ্লাই করা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের চিঠি আসে।
কি করবে সে। সীতেশ বাবার ভয়ে জবুথবু।শুভাকাঙ্খী কয়েকজন ভর্তি হওয়ার জন্য চাপ দেয়। সীতেশ চুপচাপ থাকে। সংসারের ঘানি ঠেলতে ঠেলতে সে যেন বিপর্যস্ত।তাই কখন যে নিজের ভালোলাগাগুলোর বিসর্জন ঘটে গেছে বুঝতেও পারে না। শ্বশুরবাড়ির নিস্পৃহতা তাকে মর্মাহত করলো। তাই ট্রেনিং এর প্রস্তাব নাকচ করে দিলো সে।
সময়ের পরিবর্তনে সংসার বড়ো হয়। ইতিমধ্যেই শ্বশুরমশায় মারা গেছেন।তিনটি ভাই,বোন মা ও নিজের সন্তান নিয়ে সীতেশ নাজেহাল। এদিকে দায়িত্ব বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নিজের স্বর্ণালী মুহূর্তের বিসর্জন। নিজের ভালোলাগা মন্দলাগা কবেই ভুলে গিয়েছে সে।অন্তর্মুখী অনুভা সেকথা কাউকে বুঝতেও দেননি। সংসারের কর্ত্রীভাব কি তাকে মোহাচ্ছন্ন করে তুলছে?কে জানে। সংসারের দায়বদ্ধতা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। তবুও মাঝে মাঝে হিমেল হাওয়ার মন কেমনের ডাকে ভেতরটা হু হু করে ওঠে। শীতের ভরা যৌবনের ডাক নিয়ে যায় স্কুলজীবনের ম্যাজিক মুহূর্তগুলিতে। ভিড় করে রাধা,বিপাশা, সায়ন্তনীরা। সেবার ওদের ক্লাস নাইন। বড়দি বললেন স্কুল থেকে একটা বনভোজন করা হবে। স্কুলের পাশেই যে শাল মহুলের জঙ্গল আছে ওখানেই হবে বনভোজন। সেবার কি মজাটাই না হয়েছিল। আর শরৎ এলেই দলবেঁধে গাঙ্গুলিদের চন্ডিমণ্ডপে ঠাকুর দেখতে যাওয়ার মজা যা ছিল না। ভাবনারা বড় বেয়াড়া। তাই একটার পর একটা ভাবনা মনকে দখল করে যেন কায়েমি হয়ে থাকতে চায়। বেশ থাকুক না। ভালোই তো এই দুদণ্ড নিশ্চিন্ত অতীতযাপন।
এখন সংসার তার আপন গতিতেই চলমান। ছেলেরাও বেশ বড় হয়ে গেছে। আচ্ছা ওরা কি মায়ের মনোরাজ্যের হদিশ রাখে। তবে তিনি কখনও নিজের মনযাপনের এই কথা কাউকে জানতেই দেবেন না। বড়, মেজো,সেজো ও মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।ছোটটির বিয়ে দিলেই নিশ্চিন্ত। সংসার থেকে বেশ কিছুদিন সন্ন্যাস নেবেন ভেবে রেখেছেন। কিন্তু সীতেশের শরীরটা ইদানীং ভালো যাচ্ছে না। বয়সজনিত প্রেশার থাইরয়েড তো আছেই, সঙ্গে জুটেছে স্মৃতিভ্রংশ। দুবছর আগে সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে ওটার আমদানি হয়েছে মনে হয়। নিজেও কি ঠিক আছেন তিনি। সেকথা বলতেও তার দ্বিধা। চিরকাল আত্মসুখ বিস্মৃত,অন্তর্মুখী তিনি
মাঝে মাঝে তো প্রেশারের ওষুধ খেতেও ভুলে যান। ছেলে অথবা মেয়ের যদি নজরে এলো তবেই খাওয়া হয়। অথচ সকলেই নিজ কাজে ব্যস্ত। সবসময় বাড়িতে থাকা তাদের পক্ষেও সম্ভব নয়। সবই বোঝেন তবুও কিসের এক অভিমান পেয়ে বসে তাকে। মনে হতে থাকে এটাই কি সারাজীবন সংসারে জীবন বলি দেওয়ার প্রতিদান। পরমুহুর্তেই নিজেকে ধমক দেন নিজেই। ছি কি ভাবছি সন্তানদের নিয়ে। এদিকে সীতেশ আবার চোট পেয়েছে মাথায়। সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে ভর্তি করা হোল। ডাক্তার কোলকাতায় রেফার করে দিলো।কিন্তু কোলকাতা থেকে দিব্যি সুস্থ হয়ে ফেরত এলো সীতেশ। বাড়ির সকলের কি আনন্দ। তারও বুকের ভার অনেকটা হালকা হয়ে গেলো। কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যেই সীতেশকে আবার কোলকাতা নিয়ে যাওয়া হলো। এবার যেন মনটা কু ডেকে উঠলো। গাড়ি ছাড়ার সময় সীতেশের দৃষ্টিতে কি অসম্ভব দেখে ফেললো সে। তবে কি, নিজেকেই প্রবোধ দেন। অথচ সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারলেন না। আশঙ্কাই সত্যি হলো।শেষরক্ষা হলো না। অপারেশন টেবিলেই নাকি সীতেশ চিরঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে তাকে ছাড়াই।
কাজকর্ম সব স্বাভাবিকভাবেই হয়ে গেলো। বড় সংসার কবেই ছোট হয়ে গেছে প্রয়োজনে। বৌমাদের ছেলের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। নাতি নাতনীদের পড়াশোনার জন্যে গ্রামের চৌহদ্দিতে আটকে রাখতে চাননি। এখন তিনি কি করবেন। ছেলেদের কাছে গিয়ে থাকবেন? মেয়ের কাছে থাকবেন? তবে তিনি বাড়িতেই থাকতে চান। ছেলে বা মেয়ে কারও কাছে গিয়েই বোঝা হতে চান না। কিন্তু এই সামান্য কথাটা বলতেও তার দ্বিধা। চিরকাল অন্যের সুখে আত্মবিসর্জনকারী তিনিও আজ অদ্ভুত দোলাচলে। মাঝে মাঝে বেশ অভিমান হয় তার, কেউ তাকে বুঝলো না। কিন্তু সেটাও ক্ষনিক ভাবনা মাত্র।তবে সকলের জোরাজুরিতে বাড়ি ছেড়ে বেরোলেন। আস্তে আস্তে শোকটা কি কাটিয়ে উঠতে পারবেন? আসলে গলগ্রহ হয়ে বাঁচাটাই দুর্বিষহ। এই প্রথম নিজেকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে সে। তার মনে হচ্ছে যদি কিছুদিন আরো বাঁচি, তবে শংকরপুরেই থাকবো। কিন্তু কিছুদিন ধরেই বুকের ব্যথাটা বেড়েছে যেন। সকলকে কেনো দেখতে ইচ্ছা করছে। মুখ ফুটে সেকথা বলতেও পারছেন না। কি মনে হলো আজ সারারাত গল্প করবেন নাতনির সাথে। রাত্রি বারোটা পর্যন্ত বেশ গল্পকরেই সময় কেটে গেলো। কখন চোখের পাতা লেগে গিয়েছে বুঝতেও পারেন না। সকালবেলা যেন আর পারছেন না। বড় ছেলে জিজ্ঞাসা করলো মা,মা কিছু হয়েছে? হেসে উত্তর দিলেন কই কিছু না তো। হঠাৎ চোখের সামনে অন্ধকার। মুখ গুঁজে দিলেন টেবিলে। জানলার পাশে কাকে দেখলেন? সীতেশ বোধহয়। সীতেশ দাঁড়াও আমি আসছি। কত অকথিত কথা বাকি রেখেই যেন পালাতে চাইলেন জীবন থেকে। মা,মা ছেলের ডাক দূর থেকে কানে আসছে। এবার চির প্রশান্তির হাসি ছড়িয়ে মিলিয়ে যাচ্ছেন মহাশূন্যের পথে।।
_________________________________________
তন্ময় পালধী। আরামবাগ।
Comments
Post a Comment