জীবন খুঁজে পাবি
লগ্না
" দিদি, এই দিদি, দিদি রে, "
চিৎকার করতে করতে বাড়িতে ঢুকল পিয়া|
" আরে, এত্ত চিৎকার করছিস কেনো? শুনতে পাচ্ছি বল "
বই এর আলমারি পরিষ্কার করতে করতে একটু বিরক্ত হয়েই বলল মমতা|
" বাঁচা প্লিজ আমায় "
" কেন আবার কি করেছিস তুই?"
" করিনি কিছুই, কিন্তু এখন ও যদি না করি, তাহলে আমার ইস্কুল থেকে তোর ডাক পড়বে| বুঝলি"
" তো কি করতে হবে শুনি এবার, আমি তোকে হেল্প করব| কাজ তুই করবি কিন্তু|"
" জানি, দিদি ইন্ডিয়া, তুমি হলে গিয়ে প্রকৃত শিক্ষিকা তাই তুমি প্রেরণা দেবে| হে ইশ্বর, ইস্কুলে আর বাড়িতে এইসব দিদিমণি দের পাল্লায় পড়ে আমার তো জীবন গেল"
" কাজের কথা বল| "
মমতা হাসতে হাসতে বলল পিয়াকে|
" আমাদের ইস্কুলে একটা প্রতিযোগিতা হবে, যেখানে বিভিন্ন অঞ্চলের মাস্টারমশাই, দিদিমণিদের নিয়ে লিখতে হবে| তাঁদের কাজ, আদর্শ, আর সেই জীবন থেকে আমি কি শিখলাম এটাও লিখতে হবে |"
বিরক্ত হয়েই বলল পিয়া|
" বাহ, দারুণ তো| অসাধারণ| তুই কার কথা লিখতে চাইছিস"
জিজ্ঞেস করল মমতা|
" তোর কথা লিখে দিতাম বুঝলি, তুই যেমন করে আমায় পড়াশোনা করতে বলিস সেটা হেভি লাগে, আর ইস্কুলে আছে রীতি ম্যাডাম| কি সুন্দর গল্প করে পড়ান| বাকিরা....
কিন্তু পুরোনো দিনের শিক্ষক লাগবে, কই পাই?"
" আমাকে তোর ভাল লাগে, এই যে এত্ত বকা দেই তারপর ও? "
" তোর সব ছাত্র ছাত্রীদের তোকে ভাল লাগে, তোর বকা ও মিষ্টি লাগে, তুই এত্ত সুন্দর করে ভেঙে ভেঙে গল্প করে পড়াতে পারিস কি বলি "
পিয়া টেবিলের উপর বসে পা দোলাতে দোলাতে বলল|
" শোন তোকে আমি আজ তিন বোনের গল্প শোনাব, শিলিগুড়ির তিন বোন, যারা ইংরেজ সরকার থাকাকালীন ইংল্যান্ড থেকে পড়াশোনা করে এসে সেই শিক্ষা দিয়ে মেয়েদের জীবনে আলো জ্বেলে দিয়েছিল"
" বল বল শুনি, দাঁড়া খাতাটা নি, লিখব"
" চুপ করে শোন, মনে রাখার অভ্যাস কর"
" বেশ "
" ইভা দাশগুপ্ত, নিভা দাশগুপ্ত , অমিয়া সেনগুপ্ত ছিলেন তিন বোন| তাঁরা বিদেশে পড়াশোনা করে যখন দেশে ফিরলেন তখন দেশে ইংরেজ শাসন| মেয়েদের অবস্থা খুব খারাপ| আমাদের দেশে বৈদেশিক আক্রমণের আগে মেয়েদের সবদিক দিয়ে উচ্চ স্থান ছিল| কিন্তু ক্রমাগত বৈদেশিক আক্রমণ এবং মেয়েদের উপর অত্যাচারের ফলেই মেয়েদের নিজের সম্মান রক্ষার জন্যে অনেক কিছু থেকে পিছিয়ে যেতে হয়| যদি ও উচ্চ বংশের মেয়েরা অনেক সুযোগ পেত| আর্থিক এবং সামাজিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া মেয়েদের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছিল| তার ফল পড়েছিল দেশের অবস্থায়| স্বাধীনতা সংগ্রামে অনেক মেয়েরা এগিয়ে নিজেদের প্রাণ বাজি রাখছিলেন | কিন্ত স্বাধীনতার পর দেশের দায়িত্ব কে নেবে? নারী শিক্ষার আলো জ্বালানোর কাজে অনেকেই এগিয়ে আসছিলেন| এই তিন বোন উত্তরবঙ্গের তেমন উজ্জ্বল নাম"
" এনারা কি করেছিলেন দিদি "
মুগ্ধ হয়ে শুনতে শুনতে জিজ্ঞেস করল পিয়া|
" যুদ্ধের সময় যে রিং এর মধ্যে সেনাবাহিনী লুকিয়ে থাকে, তেমনই একটা রিং এর মধ্যে মাত্র সাতজন মেয়েকে নিয়ে শুরু করেছিলেন শিলিগুড়ি বালিকা বিদ্যালয়|"
" রিং এর মধ্যে "
অবাক হয়ে জানতে চাইল পিয়া|
" ঠিক তাই "
" তারপর? "
" তারপর শুরু হল ওই অঞ্চলে নারী শিক্ষার প্রসার| ওই ইস্কুলে মেয়েদের নিয়ে আসা নিয়ে অনেক অসুবিধে হয়েছে| কিন্তু ওনারা থেমে যাননি| অষ্টমঙ্গলা তে বিধবা হয়ে যাওয়া মেয়েকে ইস্কুল পড়িয়ে শিক্ষিত করে জীবন গড়ে দেওয়া থেকে, দুঃস্থ মেয়েদের পড়াশোনা করে কাজের জোগাড় করে দেওয়া, সব করেছেন এই তিন বোন"
" শুধু মেয়েদের জন্যে ইস্কুল হয়েছে?"
" ঠিক তা নয়, আমি যতোটুকু জানি, দেশস্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন বুড়ো মাস্টার| ওনার নাম কেউ জানেনা| এই নামেই পরিচিত |
উনি এসে অমিয়া দেবী কে বললেন ইস্কুল করতে চান| অমিয়া দেবী নিজের আত্মীয় এবং নিজের পরিবারের জমিতে ছয়টি ইস্কুল করতে দিয়েছিলেন|"
" বিশাল ব্যাপার, এরকম শিক্ষিকা থাকলে তো ছাত্রের জীবন উজ্জ্বল হবে, কিন্তু এখন এমন নেই কেন দিদি?"
" কারণ এখন বেশিরভাগ শিক্ষক এই কাজকে পেশা হিসেবে দেখেন| কিন্তু শিক্ষকতার কাজ শুধু পেশা নয়, দায়িত্ব, বলা যায় দায়িত্বে ভরা যা যা কাজ আছে সবার মধ্যে সেরা| তাই শিক্ষকের জীবনে আদর্শ না থাকলে, মঙ্গলপ্রাণ না হলে শিক্ষকের চরিত্র, ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়না| কথায় কাজে মিল থাকেনা| তখন সেই চরিত্র ছাত্রের মধ্যে ছড়িয়ে যায়| তাই জীবনে সঠিক উদ্দেশ্য এবং সুন্দর চরিত্র না থাকলে শিক্ষকতা বর্বরতার সমান হয়ে যায় | "
" তাহলে উপায়?"
" নিজেকে উদ্দেশ্যে অনুপ্রাণিত করে যোগ্য শিক্ষক রূপে গড়ে তোলা, এই তিন বোনের জীবনে কত বাঁধা ছিল, হেরে গিয়েছেন কি?"
" নাহ "
" তাহলে তোর লেখার রসদ জোগাড় হল?"
" জীবনের রসদ ও জোগাড় হল দিদি | আমিও প্রকৃত শিক্ষক হতে চাই "
পিয়া এই কথা বলার সময়ে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল|
মমতা, বোনের মাথার উপর হাত রেখে আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল|
হয়ত এই দৃশ্য দেখল তখন ওই তিনবোন অন্য কোনো জগত থেকে, আর নিজেদেরকে বলল
" আমরা পেরেছি, পেরেছি আমরা "
Comments
Post a Comment