মাস্টার মশাইয়ের স্নেহ জীবনের আশীর্বাদ
অঞ্জনা মজুমদার
অনেক দিন হয়ে গেছে আমার স্কুল জীবন শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু একদিনের কথা আমি ভুলে যাইনি। আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। তখন স্কুলে ইন্সপেক্টর স্যর আসতেন। ছাত্রছাত্রী দের সাথে মাস্টার মশাই এর মূল্যায়নও একসাথেই হয়ে যেত। যেদিন ইন্সপেক্টর আসবেন সেটা জানতে পারলে তার আগের তিনদিন সাজো সাজো রব। মাস্টার মশাইরা অঙ্ক, ইংরেজির কঠিন কঠিন প্রশ্ন ভালো, পিছিয়ে পড়া ছাত্র ছাত্রীদের শেখানোর চেষ্টা করতেন।
কিন্তু সেদিন স্কুলে হঠাৎই আগাম না জানিয়ে এসে পড়লেন ইন্সপেক্টর সাহেব। মাস্টার মশাইরা তটস্থ হয়ে পড়লেন। ইন্সপেক্টরের রিপোর্টে যে স্কুলের গ্রান্ট পাওয়া না পাওয়া নির্ভর করছে।
হেডমাস্টারমশাই ইন্সপেক্টরকে নিয়ে প্রথমেই এলেন ক্লাস ফোরের ঘরে। ইংরেজি ক্লাস সবাই উঠে দাঁড়িয়ে বলল, গুড মর্নিং স্যর।
ইন্সপেক্টর বললেন, গুড মর্নিং স্টুডেন্টস্। বস সবাই, আমরা বাঙালি বলতো বাংলায় গুড মর্নিং এর বাংলা কি?
সবাই থতমত খেয়ে চুপ করে রইল। কেবল শেষ বেঞ্চের গণেশ উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, সুপ্রভাত মাস্টার মশাই।
তার কথার সুরে সুর মিলিয়ে আমরা সবাই বলে উঠলাম, সুপ্রভাত।
খুশি হলেন ইন্সপেক্টর সাহেব। বললেন, বেশ বেশ। ইংরেজি থেকে বাংলা হল,এবার বাংলা থেকে ইংরেজি হোক।
শেষ বেঞ্চের গণেশের পরের জনকে জিজ্ঞেস করলেন, বলতো একটি ছাতা ইংরেজি কি?
সে পরিমল, উঠে দাঁড়িয়ে নিশ্চিত হয়ে বলল, এ আমব্রেলা।
ইন্সপেক্টর হাসি মুখে পরের জনকে একই প্রশ্ন করলেন। তার মুখে হাসি দেখে সবাই ভাবলো ঠিক উত্তর দেওয়া হয়েছে। সবাই একই উত্তর দিল। এভাবে পরপর সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল, একই উত্তর দিল। সবশেষে আমার পালা। বাবার শেখানো নিয়ম মেনে কম্পিত গলায় বললাম, অ্যান আমব্রেলা।
ইন্সপেক্টর বললেন, কেন অ্যান কেন? সবাই তো এ বলল। আমি ভাওয়েল এর নিয়ম বললাম।
ইন্সপেক্টর আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, বাঃ! হেসে বললেন, বাংলা ইংরেজি দুটোতেই তোমাদের ক্লাস পাশ করে গেলে।
হেডমাস্টারমশাই এর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। স্কুলের জন্য ভালো রিপোর্ট দিয়ে ইন্সপেক্টর বেরিয়ে গেলেন স্কুল থেকে।
হেডমাস্টারমশাই আমার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিলেন। কিন্তু গণেশকে একেবারে জড়িয়ে ধরে বললেন, মানস ভালো ছাত্র। স্কুল ছাড়াও বাড়িতে ওর বাবা পড়া দেখিয়ে দেন। ও তো পারবেই। কিন্তু তুই যে সুপ্রভাত মানে জানিস আমি জানতাম না। তুই আমাদের মান বাঁচিয়ে দিলি।
গণেশ বলল, স্যর আপনি যে আমাদের প্রার্থনার লাইনে রোজ আমাদের সুপ্রভাত বলেন তাই শুনেই তো শিখেছি।
হেডমাস্টারমশাই বললেন, এভাবেই আরও মন দে। তোর লেখাপড়া হবে। অনেক বড় হও তোমরা সবাই।
গণেশ মাথা নিচু করে রইল। পরদিন থেকে একটু একটু করে গণেশের পড়াশোনায় মন বসল। ক্রমশঃ ভালো রেজাল্ট করল।স গণেশ এখন কেন্দ্রিয় সরকারের পদস্থ অফিসার। সেদিন হেডমাস্টারমশাই এর আদর তাকে ভেতর থেকে বদলে দিয়েছিল। মাস্টার মশাই এর সামান্য স্নেহ ভালোবাসা ছাত্রদের জীবন বদলে দেয় সত্যিই।
===============
অঞ্জনা মজুমদার
এলোমেলো বাড়ি
চাঁদপুর পল্লী বাগান
পোঃ রাজবাড়ি কলোনী
কলকাতা ৭০০০৮১
Comments
Post a Comment