অণুগল্প
আত্মত্যাগ
কৃষ্ণা সরকার
ক্লাসে ঢুকে হেডমাস্টার অখিল বাবু বললেন, এবার তোমাদের পড়াশোনায় আরো মনোযোগ দিতে হবে, সামনে মাধ্যমিক, ইস্কুলের মান রাখতে হবে তো ? সবাই সমস্বরে বললো হ্যাঁ স্যার। সূর্য ইস্কুলের ফাস্ট বয় —তাকে ডেকে বললেন কি সূর্য? আমাদের ইস্কুলের মুখ উজ্বল করতে পারবে তো ! হ্যাঁ স্যার, আমি যথা সম্ভব চেষ্টা করব। এরপর ঋজুকে বললেন তুমি একটু পড়াশোনায় মন দাও ঋজু? স্যার আপনি একদম ভাববেন না, আমার বাবা আছেতো। অখিলবাবু জানেন ঋজু ধনী বাপের বখে যাওয়া আদরের দুলাল, তার উপর বাবা বিজনবিহারী একজন এম এল এ। ছেলেটির পড়াশোনায় একদম মন নেই, সারাদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারা, তাসখেলা, সিগারেট খাওয়া সব কিছুতেই হাত পাকিয়ে ফেলেছে, ওকে বিশেষ কিছু বলে লাভ নেই । ইস্কুলের হেডস্যার অখিলবাবু, অত্যন্ত বিনয়ী, ভদ্র ছাত্রদের নিজের পুত্রসম চোখে দেখেন। সূর্য, অখিলবাবুকে যথেষ্ট ভক্তি শ্রদ্ধা করে
সময় - অসময়ে বাড়িতে গিয়ে পড়াশোনা বুঝে আসে। সেদিন সূর্য ইস্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল হঠাৎ দেখে বড় বট গাছের নিচে হেড মাস্টার আর ঋজুর বাবা বিনোদ বিহারীবাবু কি যেন কথাবার্তা বলছে, সূর্য বটগাছের পেছনে চলে যায় । ঋজুর বাবা বলছেন দেখবেন মাস্টারমশাই আমার ছেলে যেন টেস্টে পাস করে তানা হলে জানেন তো মাধ্যমিকে বসতে পারবে না ! অখিলবাবু চুপ করে থাকেন, জানেন প্রতিবাদ করে কোন লাভ হবে না।
ক্ষমতার জোরে এরা যা খুশি তাই করতে পারে। এতো সাধের - হাতে গড়া ইস্কুল, ছেলেমেয়েদের একটা বছর নষ্ট হয়ে যাবে এটা তিনি কিছুতেই হতে দেবেন না, তছাড়া ইস্কুলের রেপুটেশান্ নষ্ট হবে।
বিনোদবাবু বলেন, না না আপনি চিন্তা করবেন না।
আমি যথাযোগ্য সম্মানের সাথে আপনাকে পুষিয়ে দেব। সূর্য লক্ষ্য করে মাস্টারমশাইএর চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছে, তবুও তিনি কোন কথা বলছেন না। বিনোদবাবু হেসে বললেন বুঝেছি মৌন সম্মতির লক্ষণ, তিনি একটি লাল খাম অখিলবাবুর হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন হ্যাঁ দেখে নেবেন ওখানে দশ হাজার আছে,তথাপি মাস্টারমশাই মাথা নিচু করে রইলেন। কিছু পরে এম এল এ বিনোদবাবু চলে গেলেন। সূর্য গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে, অখিলবাবুর সাথে চোখাচোখি হতে অখিলবাবু বললেন, সূর্য তুমি কিছু শোননি, কিছু জান না, সূর্য হতবাক দৃষ্টিতে ঘাড় নেড়ে আস্তে আস্তে চলে যায়, সে ভাবেনি তার স্বপ্নে গড়া দেবতার গায়ে কালির আঁচড় ।
সেদিন রাতে অখিলবাবু বেশি মাত্রায় আফিং সেবন করলেন । কারণ আজ সহজে ঘুম আসবে না। ইস্কুলে পরীক্ষা ভালভাবে হয়ে গেল, অখিলবাবু নিশ্চিন্ত হলেন । এরইমধ্যে একদিন সূর্যকে ডেকে বিনোদবাবুর দেওয়া খামটা দিয়ে বললেন 'সূর্য একটা কাজ করে দেবে বাবা ? কি কাজ মাস্টারমশাই ! এটা ঋজুর বাবার সাথে দেখা হলে তার হাতে দিয়ে দিও, ঠিক আছে মাস্টার মশাই। নির্দিষ্ট দিনে পরীক্ষার ফলাফল টাঙিয়ে দেওয়া হল। ইস্কুলে হৈ চৈ ব্যাপার, ছাত্ররা পাশ করার আনন্দে মশগুল, আচমকা একটা খবরে সবাই স্তম্ভিত, "গ্রামের মহানন্দা" ইস্কুলের হেড স্যার অখিলবাবু হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে ভোর বেলায় মৃত্যু বরণ করেছেন। বাড়ির সামনে পুলিশ, ইস্কুলের ছাত্র, মাস্টার, চারিদিকে ভীড় - দূরে দাঁড়িয়ে সূর্য, মাস্টারমশাইকে প্রণাম করার উদ্দেশ্যে এসে, এমনটা যে দেখবে ভাবতে পারেনি।
হঠাৎ এম এল এ বিনোদবিহারীর গাড়ি এসে দাঁড়ায়, গাড়ি থেকে নেমে হম্বিতম্বি করতে থাকে, কোথায় অখিলবাবু ! আমার ওতোগুলো টাকা মুখের কথা মুখে আটকে যায়, কি হয়েছে?
সূর্য ছুটে এসে বলে, কাকাবাবু, মাস্টারমশাই আপনাকে এই খামটা দিয়ে গেছেন, দেখে নেবেন।
==============
কৃষ্ণা সরকার
রামরতন ঘোষ রোড
পোস্ট রাজপুর
কোলকাতা 149
Comments
Post a Comment