শিক্ষক—আলোর দিশারী
অর্পিতা মল্লিক
শিক্ষা এমন এক শক্তিশালী অস্ত্র যা দিয়ে পৃথিবীকে বদলে দেওয়া যায়। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হলে জাতির উন্নতি হয়। কাউকে অপমান করতে যোগ্যতা না লাগলেও সন্মান করতে যোগ্যতা লাগে আর প্রকৃত শিক্ষাই সেই যোগ্যতা তৈরি করে। 'শিক্ষা হলো জাতির মেরুদণ্ড '... প্রকৃত শিক্ষা শুধু অক্ষরজ্ঞান দেয় না, মনুষ্যত্ব শেখায় , অজ্ঞানতা থেকে মুক্ত করে।
আমাদের জীবনের প্রথম শিক্ষক বাবা মা। শিশু জন্মের পর বাবা মায়ের থেকে প্রাথমিক আচার আচরণ শেখে। ছোট থেকে অন্যর সাথে নিজের বাচ্চাকে তুলনা করা উচিত নয় -- এতে বাচ্চার হীনমন্যতা তৈরি হয়। প্রত্যেক বাচ্চারই নিজস্বতা থাকে। বাবা মায়ের উচিত প্রতিযোগিতায় না ঠেলে নিজস্বতা বিকাশে সাহায্য করা।
প্রকৃত শিক্ষা পুঁথিগত শিক্ষাতে আবদ্ধ নয় বরং এটি একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া—যা মানুষকে ঠিক ভুল বিচার করতে শেখায় , সুন্দর ও সুস্থ সমাজ গঠনে সাহায্য করে। সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত ব্যক্তি সে ,যে জ্ঞানকে ব্যবহার করে শুধু নিজেকে নয় সমাজকেও উন্নতির পথে নিয়ে যায়।
শিক্ষা প্রসারের প্রধান ভিত্তি হলো শিক্ষক।'গুরু বিনা জ্ঞান নাই'...শিক্ষক ছাত্র ছাত্রীদের কাছে রোল মডেল -- তার জীবন যাপন ,চরিত্র,আচার আচরণ, সবকিছুই শিক্ষার্থীদের মনে প্রভাব ফেলে। ইতিহাসে এর বহু নজির আছে।
শিক্ষক হলেন আলোর দিশারী , যিনি জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়ে শিক্ষার্থীদের জীবন আলোকিত করেন। প্রাচীনকালে গুরুকুলে থেকে ছাত্ররা পাঠ নিত,ছাত্র গুরুর সম্পর্ক কিছুটা আনুগত্যের হলেও , তাঁরা ছিলেন সমাজ গঠনের মুল কারিগর।
প্রকৃত শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সন্তানসম ভালবাসা দেন। শিক্ষকের এই আন্তরিকতার মাধ্যমে তিনি শ্রদ্ধা অর্জন করতে সক্ষম হন।এই সম্পর্কর বন্ধন প্রাণবন্ত করে তোলে শিক্ষাকে।
দেশের উন্নয়নে সেই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে।আর শিক্ষাব্যবস্থা নির্ভর করে শিক্ষকের মানসিকতা ও দায়িত্ববোধের উপর। একজন সৎ, নীতিবান, শিক্ষক অসংখ্য সৎ মানুষ গড়ে তুলতে পারে।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথায়,"দেশকে ভালবাসতে হলে আগে মানুষকে ভালবাসতে হবে ,আর মানুষকে ভালবাসতে শেখান শিক্ষক"।
শিক্ষকেরা যদি শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতা , সততা, মানবিকতা জাগিয়ে তুলতে পারেন, তবে সেই দেশ কখনো পিছিয়ে থাকবেনা। অপরদিকে যদি শিক্ষকদের মধ্যে অবহেলা, গাফিলতি,অর্থলোভ জন্ম নেয় ,তবে শিক্ষার মান নষ্ট হয়, সমাজ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়।
বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের সমাজের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আধুনিক যুগ হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষা ব্যবস্থাকে দ্রুত বদলে দিচ্ছে। এখন শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেট, অনলাইন ক্লাস ,কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে অনেক কিছু শিখতে পারছে। কিন্তু এর ফলে শিক্ষকের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় নি বরং দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে।কারণ তথ্য তো কম্পিউটার দিতে পারে কিন্তু সেই তথ্যকে সঠিক ভাবে কাজে লাগাবার জন্য জ্ঞান , নীতি, মুল্যবোধ কেবল শিক্ষকই দিতে পারেন।
বর্তমান সমাজের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো— সামাজিক অবক্ষয়। ভোগবাদ, স্বার্থপরতা, হিংসা ও দুর্নীতির কবলে সমাজ আক্রান্ত । পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হচ্ছে, নৈতিকতা অবহেলিত হচ্ছে, সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থায়ও এই অনভিপ্রেত প্রভাব পড়ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের সুরক্ষা অবহেলিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাগিং, ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। এসব কদর্য ঘটনা শিক্ষা ব্যবস্থাকে কলুষিত করে।এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে সমাধান করা উচিত।
প্রতিযোগিতার দৌড়, বাণিজ্যিক মানসিকতা, প্রাইভেট টিউশন ইত্যাদি কারণে শিক্ষার মুল চেতনা কোথাও কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে। আজকের দিনে শিক্ষকেরাও সমস্যার সন্মুখীন হন । যেমন— শিক্ষাদানকে আদর্শর বদলে চাকরি হিসেবে দেখা হয় । অতিরিক্ত শিক্ষার্থী সংখ্যা, অপর্যাপ্ত পরিকাঠামো শিক্ষার মান নষ্ট করে। শিক্ষকেরা অনেকক্ষেত্রে সামাজিক মর্যাদা হারাচ্ছেন।
আধুনিক শিক্ষা অনেকাংশে ডিগ্ৰি, চাকরি ও অর্থকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে, যেখানে মানবিকতা ও নৈতিকতার শিক্ষা উপেক্ষিত হচ্ছে। সোস্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার, ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রভাব বিস্তার কিশোর ও যুবসমাজকে বিভ্রান্ত করছে।
৫ই সেপ্টেম্বর ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের জন্মদিনটি শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হয় সারা দেশে। কিন্তু বর্তমান সময়ে এই আনুষ্ঠানিকতার আড়ালে লুকিয়ে আছে শিক্ষকদের অপমান, আন্দোলন। এর কারণ রাজনৈতিক দুনীতি। এই ফাঁসে যোগ্যরা বঞ্চিত হচ্ছেন আর শিক্ষার্থীরা হারাচ্ছে উপযুক্ত শিক্ষকদের। শিক্ষকদের হাতে সমাজ গড়ার ক্ষমতা দিলে তাদের সন্মান, মর্যাদা , অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরতাও দিতে হবে। তাই স্বচ্ছ শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া , যোগ্য শিক্ষকদের পুর্নবহাল, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা , শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা দেওয়া আশু প্রয়োজন।
জাতির মেরুদণ্ড হলো শিক্ষা আর শিক্ষক হলো সেই মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী করে তোলার প্রধান স্থপতি। তাই শিক্ষকদের অবদানকে মর্যাদা দেওয়া উচিত।
=================
অর্পিতা মল্লিক
Sonarpur Station Road, Kolkata-700103
Comments
Post a Comment