ধ্রুবতারা
শ্রেয়া দত্ত
পলাশপুর গ্রামে সবাই যাকে 'স্যার' বলে জানে, তাঁর আসল নাম ছিল গোপাল চন্দ্র রায়। তিনি ছিলেন এক সাদাসিধে মানুষ, বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি,কিন্তু শিক্ষার প্রতি তাঁর ভালোবাসা আজও টাটকা। ছোট্ট গ্রামটিতে প্রাইমারি স্কুলের বাংলা বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন গোপালবাবু। শহরের চাকরি ছেড়ে গ্রামে ফিরে এসে এই স্কুলটাকেই নিজের জীবন বানিয়ে ফেলেছিলেন।
গোপাল স্যারের প্রিয় ছাত্র ছিল আর্য। আর্যর পরিবার ছিল ভীষণ গরিব, তাঁর বাবা রিক্সা চালাত আর মা অন্যের বাড়ি রান্নার কাজ করত। কিন্তু আর্যর চোখে ছিল ভবিষ্যতে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন। লেখাপড়ার প্রতি ছিল তার অগাধ ভালোবাসা, আর গোপাল স্যারের অফুরন্ত আদরের বন্ধনে স্যার আর ছাত্রের মধ্যে গড়ে উঠেছিল এক অদ্ভুত আত্মিক সম্পর্ক। আর্য স্কুলে আসত পায়ে হেঁটে, ছেঁড়া জুতো পায়ে দিয়ে, মাঝে মাঝে খালি পায়েও আসত। কিন্তু কখনও ক্লাসে অনুপস্থিত হতো না। স্যার বুঝতেন আর্যর মধ্যে একধরনের দীপ্তি আছে যা শুধু শিক্ষায় নয়, জীবনের প্রতিটি ধাপে আলো ছড়াতে পারে। তাই তিনি প্রতিদিন স্কুল শেষে আর্যকে আলাদা করে পড়াতেন, কখনও নিজের বাসা থেকে টাকা নিয়ে এসে তাঁকে ব্যাগ, খাতা, কলম, বই কিনে দিতেন।একদিন আর্য বলল -'স্যার, আমার স্বপ্ন ভবিষ্যতে আমি আপনার মতো শিক্ষক হতে চাই।' স্যার হেসে বললেন - 'তুই গ্রামের ধ্রুবতারা আর্য, তুই একদিন পুরো গ্রামটাকে আলো দেখাবি আমি জানি।' এরপর আর্য গ্রামের পড়াশোনা শেষ করে শহরে চলে গেল। বহু বছর কেটে গেল, গোপালবাবু অবসরপ্রাপ্ত, বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন, ঠিক মতো আর চলতেও পারেন না।সেই স্কুলে আর যাওয়া হয় না, কিন্তু প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার পথেই বসে থাকেন, যেন কারও অপেক্ষায়।একদিন হঠাৎ স্কুলের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে উৎসবের আয়োজন করা হল।সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সবাই এসেছে উৎসবে আনন্দের সাথে অংশগ্রহণ করতে।মাইক্রোফোন হাতে এক ভদ্রলোক মঞ্চে উঠলেন, ঝকঝকে পাঞ্জাবি গায়ে,গলায় ছিল শিক্ষকতার গর্ব।বললেন -'আমি আজ যেখানে দাঁড়িয়ে, তা একজন মানুষের জন্যই আমার স্যার শ্রদ্ধেয় গোপাল চন্দ্র রায় মহাশয়ের জন্য। তিনি আমার জীবনে শুধু শিক্ষকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন আমার পথ প্রদর্শক, আমার জীবনের ধ্রুবতারা।' হচকচিয়ে গোপালবাবু উঠে দাঁড়ালেন। চোখে জল,মুখে ম্লান হাসি। আর্য মঞ্চ থেকে নেমে স্যারের পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। চারদিকে নিস্তব্ধতা। শুধু একটা নামই সকলের হৃদয়ের গভীরে ভেসে উঠেছে তা হল -'ধ্রুবতারা'। স্যারের গলা ভারী হয়ে এলো। বললেন -'তুই আমার গর্ব রে আর্য,আজ আমার জীবন সার্থক হল।'
গল্পটা এখানেই শেষ নয়।আর্য নিজের স্কুলে ফিরে এসে শিক্ষকতার দায়িত্ব নিয়েছিল,আর স্যার? তিনি আবারও প্রতিদিন স্কুলে যেতেন তবে এইবার বুকে গর্ব আর মুখে হাসি নিয়ে। কারণ,একজন ছাত্র যখন শিক্ষকের স্বপ্ন হয়ে ওঠে, তখন সেই সম্পর্ক হয় ধ্রুবতারার মতো চির উজ্জ্বল ও চিরস্থায়ী।
============
Shreya Datta)
Berhampore,Dist-Murshidabad,Pin-742103
Comments
Post a Comment