ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে দুরত্ব বাড়ছে
অলোক আচার্য
আমাদের দেশে শিক্ষকের সাথে ছাত্রছাত্রীর সম্পর্ক অনেক আগেই নিম্নমুখী
হয়েছে। সমাজ পরিবর্তন না হলে এর থেকে উত্তরণ সম্ভব না। এর পেছনে রয়েছে
সামাজিক একাধিক কারণ এবং শিক্ষকদের নিজেদের দায়। আবার যদি বলি এদেশে
শিক্ষকদের অপমান করাটা সম্ভবত সবচেয়ে সহজ। এদেশে শিক্ষকদের কেবল বইয়ের
পাতায় মা বাবার পরের স্থানটি দেওয়া হয়েছে বাস্তবে ভিন্ন। শিক্ষকরা অভিভাবকের
চড় থাপ্পড় খেয়েছেন, শিক্ষার্থীর হাতে মার খেয়েছেন, কমিটির সদস্যদের দ্বারা
শারীরিকভাবেও লাঞ্চিত হয়েছেন। এরকম বহু ঘটনা রয়েছে যেখানে শিক্ষকরা
নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মানসিক চাপের কথা আর নির্যাতনের ভিতন
আনতে চাই না। একজন মানুষ হিসেবে কিছু ভুল শিক্ষকরাও করেছেন এবং করেন।
আমি ধরেই নিচ্ছি যার যার সাথে এমনটা করা হয়েছে তারা সকলেই দোষী। তা
হলেও কি এই ব্যবহার কোনো ছাত্র বা ছাত্রী তার শিক্ষকের সাথে করতে পারে?
প্রশ্ন এই সমাজের কাছে। এই সভ্যতার কাছে। কোথাও আমরা সভ্যতাকে নগ্ন
করলাম না তো? যারা পিছন থেকে এটাকে সহায়তা বা সমর্থন করেছেন তারাও
কি নিজেদের দায় অস্বীকার করতে পারেন। সত্যি বলতে শিক্ষকদের মধ্যেও রয়েছে
দুর্নীতিবাজ শিক্ষক। নানা অনিয়মের সাথে তারা জড়িত হয়েছেন। তার এই
অপরাধের তো বিচারের একটি প্রক্রিয়া ছিল যার আইনি ভিত্তি রয়েছে।
নিজেকে আত্নসমর্পণের সুযোগ দেওয়া যেত। আবার তাকে একটা সুযোগও
দেওয়া যেতো। কিন্তু সব মিলিয়ে তিনি একজন শিক্ষক। আমার শিক্ষক যত বড়ই
অপরাধী হন না কেন আমি কিন্তু নিজে তাকে কোনোদিনই অপমান করতে পারবো
না।
যদি তিনি কোনো জঘন্যতম অপরাধীও হন আমি তাকে ঘৃণা করতে পারবো তবে
নিজ হাতে বা নিজে উপস্থিত থেকে তাকে টানা হেচড়া করতে পারবো না।
আমার হাত কাঁপবে। হতে পারে আমি সাহসী নই। আর হতেও চাই না। তিনি
আমাকে অন্তত একদিনের জন্য হলেও শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি আমার শিক্ষক। এখন
প্রশ্ন হলো একজন শিক্ষকের অপরাধের ফিরিস্তি লম্বা হওয়ার পেছনে কি
সামাজিক রাজনীতি দায়ী থাকে না? বেসরকারি শিক্ষকদের রাজনীতি করার
সুযোগ থাকার প্রকৃতপক্ষে কি দরকার আমার বোধগম্য না। একজন প্রতিষ্ঠান
প্রধানকে ইউনিয়ন চেয়ারম্যানও হতে দেখেছি। তাহলে তিনি স্কুল এবং
ইউনিয়ন কিভাবে সামলাবেন? বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সভা, সেমিনারে
শিক্ষককে যেতে হবে কেন? মোট কথা শিক্ষক কেন রাজনৈতিক কোনো
কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবেন? সেই প্রশ্ন কি দেশের রাজনীতিবিদরা করেছেন?
এছাড়াও জবাবদিহির যে জায়গা সেখানে যদি হাত দেন তাহলে দেখবেন একজন
প্রধান শিক্ষক কিন্তু একা কোনো অনৈতিক কাজে দায়ী থাকেন না। যাই হোক
আমরা দেখছি শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য হতে। মায়ের মত একজন শিক্ষিকাকে
কিভাবে নাজেহাল হতে হয়েছে ফেসবুকের কল্যাণে আমরা দেখেছি। তাতে
মর্মাহত হয়েছি। এই যে অভিভাবকগণ যারা এসব ছাত্রছাত্রীর এই ধরনের কাজকে
কোনোভাবে সমর্থন দিলেন তারা মনে করবেন না এই বিষে কেবল একজন শিক্ষকের
বিদায় হলো, মনে রাখবেন একদিন এই সমাজটাও এভাবে নষ্ট হবে। তার পথ
সুগমে সাহায্য করছেন মাত্র। আমি আবারও বলছি শিক্ষকরাও অন্যায় করেন। কিন্তু
তার শাস্তি প্রক্রিয়াটি কি এভাবে হওয়া ঠিক হলো? এই শিক্ষক কি একদিনের
জন্যও এই ছেলেমেয়েদের নিজের সন্তানের মত দেখেননি। অবশ্যই দেখেছেন। একজন
শিক্ষক মানেই একজন অভিভাবক। তার চোখের জল হয়তো কেউ গুরুত্ব দেননি কিন্তু
সেই জলই একদিন না ধ্বংসের কারণ হয়। শিক্ষকের গাল আছে থাপ্পড় দেওয়ার জন্য,
সমাজেরও কি গাল আছে? এই থাপ্পড় কি সমাজেরও গালেও লাগেনি? এত শিক্ষা
ভিড়ে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে নৈতিক শিক্ষার অভাবে আজ সমাজ নিচের দিকে
ধাবমান। কেউ দেখছে আবার কেউ দেখছে না। যারা দেখছে তারাও চুপচাপ বসে
আছেন। কারণ কিছুই করার নেই।
এখন শিক্ষককে চড় দেওয়া যায়, শিক্ষককে পেটানো যায়, জোর করে পদত্যাগ
করানো যায় এবং আরও নানাভাবে হয়রানি করা যায়! কারণ তাদেরও রক্তমাংসের শরীর
এবং প্রায় শান্তস্বভাবের মানুষ। চাইলেও তারা উগ্রভাবে প্রতিবাদ করতে পারে না।
কারণ তারা শিক্ষক। শিক্ষকতা একটি পেশা। অন্য পেশার মতো এখান থেকেও একজন
পেশাজীবির সংসার নির্বাহ হয়। তবে অন্য পেশার সাথে এর কিছুটা পার্থক্য
রয়েছে। কারণ শিক্ষকের দায়িত্ব অন্য পেশার থেকে অনেক বেশি। অনেক বেশি
চ্যালেঞ্জ নিয়ে তাকে এই পেশায় আসতে হয়। সন্তান মানুষ না হলে যেমন বাবা-
মা’র ওপর দায় চাপে, সেই সমপরিমাণ দায় শিক্ষকের ওপরও আসে। তাকে শেখাতে না
পারার ব্যর্থতার গ্লানি থাকে। আবার সফলতা আসলে বিপরীত চিত্র থাকে। এটাই
শিক্ষকতা। অনেকদিন আগের কথা মনে আছে? ছাত্রের নির্মম আঘাতে উৎপল
কুমার নামের একজন শিক্ষকের করুণ মৃত্যু ঘটে। তার মৃত্যুর পর থেকে সামাজিক
যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই ঘটনাটিকে নৈতিক অধঃপতনসহ আরও নানাভাবে
ধিক্কার জানায়। ধিক্কারের মতোই একটি ঘটনা এটি। আমিও ধিক্কার জানাই। কিন্তু
এই ঘটনা কেন ঘটলো বা একজন শিক্ষকের গায়ে আঘাত করার মানসিকতা কি
একদিনে তৈরি হয়েছে বা হওয়া সম্ভব? এই মানসিকতা তৈরির পেছনে শুধু ঐ
অপরাধী ছাত্রকে দায় দিয়ে বসে থেকে কোনো লাভ নেই। সমাজটা পঁচে যাচ্ছে
সে খেয়াল রাখি নি। সমাজে শিক্ষকের যে অবস্থান ছিল আজ তা নেই। ছাত্র-
শিক্ষকের সম্পর্ক ক্রমেই আলগা হয়েছে। যত সম্পর্ক ঢিলা হয়েছে তত শ্রদ্ধা,ভক্তি
কমেছে। সেই বাদশা আলমগীরের মতো এখন আর শিক্ষকের পায়ে পানি ঢালার মতো
অবস্থা নেই! তার জন্য কেউ এককভাবে দায়ী নয়। পুরো সমাজ ব্যবস্থা
সামগ্রিকভাবে দায়ী। যখন আমি আমার সন্তানকে কাউকে সম্মান করাতে
শেখাতে পারিনি তখন সে তার শিক্ষককেও অসম্মান করবে। একজন শিক্ষকের যে তার
সন্তান তুল্য ছাত্রকে শাসন করার অধিকার আছে সেই বোধটাই সমাজ থেকে
হারিয়ে গেছে। আর এখানেই সমস্যা তৈরি হয়েছে। আমি একজন শিক্ষক এবং
গত পনেরো বছর ধরেই ছাত্রছাত্রী পড়ানোর কাজটি করেছি। শিক্ষা দিতে গিয়ে
ব্যক্তিগতভাবে সবার কাছে ভালো হতে পারিনি। হওয়ার চেষ্টাও করিনি। সেটা
সম্ভবও নয়।
শিক্ষককে লাঞ্চিত করার ঘটনা কিন্তু আমাদের দেশে প্রথম নয়। প্রায়ই ঘটছে। সে
ছাত্র করুক বা অন্য কেউ। তবে ছাত্রের হাতে লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনা আরও বেশি
দুঃখজনক, ন্যাক্কারজনক এবং মানসিক কষ্টের। আমি একজন শিক্ষক এবং আমার
সাথে এই ধরনের ঘটনা ঘটলে শিক্ষকতা পেশায় থেকে যেতাম কি না সন্দেহ। এ
ধরনে কয়টি ঘটনার প্রতিবাদ হচ্ছে? কোনো শিক্ষকের অনৈতিক কর্মকান্ডের
বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা আর তাকে লাঞ্চিত করা এক কথা নয়। আবার এটা যে কেবল
এই সময়েই ঘটছে মানে ছাত্র তার শিক্ষাগুরুর গায়ে হাত তুলছে বা হয়রানি
করছে তা নয়। অনেক আগে থেকেই এই নৈতিক অধঃপতনের শুরু হয়েছে। একটু
একটু করে ক্ষয়ে গেছে সেই নৈতিকতার স্থান। যার ফলে আজ একজন শিক্ষককে
কোনো অপরাধ ছাড়াই ছাত্রের হাতে প্রাণ দিতে হলো। আমরা যদি এখনও ঘুরে না
দাড়াই তাহলে ভবিষ্যতে কোনো শিক্ষক তার ছাত্রছাত্রীকে শাসন করতে যাবেন কি
না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ শাসন মানেই সেই ছাত্রের বিরাগভাজন হতে
হবে। আবার শুধু ছাত্রছাত্রী কেন অনেক অবিবেচক অভিভাবককেও দেখেছি তুচ্ছ
কোনো কারণে তার সন্তানের হয়ে শিক্ষককে অপমান করতে ছাড়েন না। এক্ষেত্রে
সেই ছাত্র আরও বেশি সাহস পায়। অবশ্য ছাত্রকে শাসন করা যদি অপরাধের ভেতর পরে
তো অন্য কথা! একসময় মানে আমাদের সময় বাবা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে
শিক্ষকদের বলে আসতো- আমার সন্তানকে রেখে গেলাম। ওকে পড়ানোর প্রয়োজনে
যা শাসনের দরকার হয় করবেন। এখন ছাত্রছাত্রীকে শারীরিক বা মানসিকভাবে আঘাত
করা নিষেধ। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন শিক্ষকরা বেত নিয়েই ক্লাসে যেতেন।
পড়া না হওয়ার জন্য,দুষ্টুমির জন্য বেতের বাড়ি খেতে হয়েছে। কিন্তু শিক্ষকদের
প্রতি একটুও ক্ষোভ ছিল না বা এখনও নেই। শিক্ষকের হাত ধরেই একজন শিক্ষার্থী
দক্ষতা অর্জন দেশকে কিছু দেওয়ার সুযোগ অর্জন করে। একটি শ্রেণিকক্ষ
যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর আন্তরিকায় স্বার্থক শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হয়।
সেখানে থাকবে বিশ্বাস,ভালোবাসা ও আন্তরিকতা। আর না হলে একসময়
আমাদের আরও খারাপ সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
============
অলোক আচার্য
প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
পাবনা।
Comments
Post a Comment