ভাস্কর সিনহা
বিকেলের আলো জানালার শিক ভেদ করে ঢুকে পড়েছিল শ্রেণিকক্ষে। টেবিলের ওপর হাত রেখে বসে ছিলেন আনন্দবাবু—স্কুলের সবচেয়ে পুরোনো শিক্ষক। তাঁর সাদা পাঞ্জাবির কোণায় হলুদ দাগ, চশমার কাঁচ ঘোলাটে, তবু চোখের ভেতর অদ্ভুত দীপ্তি।
আজ স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠান। বক্তৃতার জন্য শিক্ষক-শিক্ষিকারা প্রস্তুত, ছাত্ররা ব্যস্ত মঞ্চসজ্জায়। কিন্তু আনন্দবাবুর বুকের ভেতর অস্বস্তি জমেছে—কারণ তিনি জানেন, আর বেশিদিন তিনি এখানে থাকবেন না। তাঁর কর্মের অবসর আসন্ন।
তিনি জানালার বাইরে তাকালেন। খেলার মাঠে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলছে। তাঁর মনে পড়ল নিজস্ব ছাত্রজীবনের কথা—স্বাধীনতার পরপর সময়। তখন শিক্ষকেরা ছিলেন সমাজের বাতিঘর। একটা গ্রামের মানুষ নিজেদের সন্তানকে গর্বে তুলে দিতেন শিক্ষকের হাতে—"গড়ে দাও মানুষ করে।"
আজকের দিনে সে দৃশ্য কোথায়?
বিংশ শতকে শিক্ষক ছিলেন সমাজের অভিভাবক; এখন একবিংশ শতকে তাঁদের জায়গা নিয়েছে কোচিং সেন্টার, ডিজিটাল অ্যাপ। ছাত্ররা বলে, "স্যার, ইউটিউবেই সব আছে।" আনন্দবাবুর বুক মোচড় দিয়ে ওঠে।
এই সময়ই শ্রেণিকক্ষের দরজা দিয়ে ঢুকল অর্ণব—শেষ বেঞ্চের ছাত্র। বছরভর চুপচাপ থাকে, পরীক্ষায় মাঝারি মানের নম্বর পায়, কিন্তু চোখ তার বুদ্ধিদীপ্ত। হাতে একখানা খাতা। বলল, "স্যার, একটা লেখা লিখেছি আপনার জন্য।"
আনন্দবাবু অবাক, "আমার জন্য?"
খাতা খুলে পড়তে লাগল অর্ণব, "আমাদের জীবনপথে অনেকেই আসে, কিন্তু শিক্ষক মানে অন্য কিছু। বাবা-মা জীবন দেন, শিক্ষক জীবনকে দিশা দেন। পশ্চিমবঙ্গের স্কুলগুলোতে এখন অনেক সমস্যা—পরিকাঠামো নেই, বই নেই, চাকরির নিশ্চয়তা নেই। তবু শিক্ষকরা প্রতিদিন পড়ান। কম টাকায়, কম সম্মানে, কিন্তু অশেষ ধৈর্যে। সমাজ ভুলে যায়, শিক্ষকেরা শুধু চাকুরে নন—তাঁরাই সভ্যতার নির্মাতা।"
আনন্দবাবুর চোখ ভিজে উঠল। তিনি বললেন, "তুমি কি জানো, সমাজেরও দায়িত্ব আছে শিক্ষকের প্রতি? সম্মান দিতে হয়, সহযোগিতা করতে হয়। শিক্ষক যদি অবহেলায় ভাঙেন, সমাজও অন্ধকারে যাবে।"
অর্ণব থেমে বলল, "তাহলে ছাত্রের দায়িত্ব কী, স্যার?"
আনন্দবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, "ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক বিশ্বাসে গড়া। তুমি যদি বিশ্বাস করো আমি তোমার পাশে আছি, তবে আমিও বিশ্বাস করব তুমি আলোয় যাবে। শিক্ষক যদি বাতিঘর হন, ছাত্র হলো জাহাজ। আলো না থাকলে জাহাজ পথহারা যাবে, আর জাহাজ না থাকলে বাতিঘরের কোনো মানেই হয় না।"
এই বিশেষ মুহূর্তে শ্রেণিকক্ষে এসে জড়ো হয়েছিলেন অন্য শিক্ষকেরাও, মন দিয়ে শুনছিলেন তাঁর কথা। বাইরে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে, মাইক থেকে ভেসে আসে সংস্কৃতে বন্দনার সুর। তবু এই ছোট্ট কথোপকথন যেন সবাইকে নাড়িয়ে দিল।
অর্ণব শেষবার বলল, "স্যার, একবিংশ শতকে আমরা আপনাদের হারাতে চাই না। ডিজিটাল বই পড়ব, কিন্তু মনের বই কেবল শিক্ষকই পড়াতে পারেন।"
আনন্দবাবুর বুক ভরে গেল। তিনি জানলেন—সত্যিকারের জয় শিক্ষকতার নয়, ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা বদলেছে—সেকাল থেকে একাল। কিন্তু শিক্ষক যদি দায়িত্ব নিয়ে পড়ান, আর সমাজ যদি সম্মান দিয়ে তাঁদের পাশে দাঁড়ায়, তবে শিক্ষা কখনোই অধোগামী হবে না।
শেষ মঞ্চে যখন পুরস্কার দেওয়া হচ্ছিল, প্রধান শিক্ষক মাইকে ঘোষণা করলেন—"এই বছর বিশেষ সম্মাননা যাচ্ছে আনন্দ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের হাতে, যিনি পঁয়ত্রিশ বছর ধরে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে আলোর মতো বাঁচিয়ে রেখেছেন।"
করতালি পড়ল চারদিকে। আনন্দবাবু মঞ্চে উঠলেন, ভিড়ের মধ্যে তাঁর চোখ গেল শেষ বেঞ্চের দিকে। অর্ণব দাঁড়িয়ে, দুইহাত জোড় করে বলছে, "স্যার, আলো জ্বালিয়ে রাখবেন।"
আনন্দবাবু মনে মনে বললেন, "আলো ছাত্রের ভেতরেই থাকে। শিক্ষক শুধু সেই আলোয় হাত বাড়িয়ে দেন।"
*****
ভাস্কর সিনহা
বিশ্ব ভারতী এবং আই আই টি দিল্লীর প্রাক্তনী। দুবাই নিবাসী।
Comments
Post a Comment