একটি রাজপথের আত্মকথা
“ওগো পায়ে চলার পথ, অনেক কালের অনেক কথাকে তোমার ধূলিবন্ধনে বেঁধে নীরব করে রেখো না। আমি তোমার ধুলোয় কান পেতে আছি, আমাকে কানে কানে বলো।” —রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ভূমিকা: আমি রাজপথ, পথিক মানুষের চিরসখা। আমার জন্মের কথা আজও আমার ক্ষীণ মনে পড়ে, তবে এ কথা সত্যি আমার শেষ ঠিকানা কোথায় তা আমিও জানি না। বহু যুগ আগে ঘন জঙ্গলের বুক চিরে মানুষ আমাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে এই ক্রমাগত চলাতেই তো আমার আনন্দ। এভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়াই তো জীবন। ধুলো-মাটি দিয়ে তৈরি আমার শরীরে কত কাল ধরে কত কিছুর প্রলেপ পড়ল। ক্রমে শক্ত-জমাট হয়ে উঠলাম আমি। মেঠোপথ থেকে আজ আমি রাজপথ। মেঠো ধূলিবন্ধনে নয়, মোরামের মর্মরে নয়, আজ আমার হৃদয়ের সব কথা প্রযুক্তির পীচের নীচে গুমরে গুমরে কাঁদে। হে পথিক, তুমি শুনতে চাও, তাই হৃদয়-উজাড়ি বলব তোমাকে আজ আমার আত্মকথা।
আত্মকথা: আমি ই.এম. বাইপাস। উত্তর কলকাতার উল্টোডাঙ্গা থেকে শুরু করে বারুইপুর পুরাতন বাজার পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার আমার বিস্তৃতি। আমি পশ্চিমবঙ্গের একটি অন্যতম প্রধান রাজ্যসড়ক। আমার দু-পাশে কত গাছপালা, কৃষিক্ষেত, কলকারখানা, দোকান, বাড়ি! দিনরাত শত-সহস্র মানুষ ও তাদের বিচিত্র যানবাহন আমার বুকের ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে। এক একজনের এক-একরকম ছন্দ। তাদের গতিময় ছন্দের স্রোতের ভিন্ন ভিন্ন দোলা আমার প্রাণে তোলে শিহরণ। পৃথিবীর আর সব পথের মতো ‘চরৈবেতি’ ‘চরৈবেতি’ আমার জীবনমন্ত্র।
অতীত স্মৃতি: আজকে আমি রাজপথ নামে পরিচিত হয়েছি ।এক সময় ছিলাম মাটির তৈরি কাঁচা রাস্তা। দুপাশে ছিল হোগলা বন। প্রথম দিকে দু'-একজন মানুষ পায়ে হেঁটে আমার উপর দিয়ে যাতায়াত করত। সাইকেল ছাড়া অন্য কোনো রকমের গাড়ি এ-পথে চলত না। প্রায় চার বছর এভাবে কাটল। এখানকার লোকসংখ্যা বাড়তে থাকল। আস্তে আস্তে জায়গাটা শহরে পরিণত হলো। আমার তখন কদর বাড়লো। ইট-সুড়কি ফেলে আমাকে চওড়া ও উঁচু করা হল। এভাবেও কাটল বেশ কয়েক বছর। একদিন দেখলাম মিউনিসিপ্যালিটির ইঞ্জিনিয়াররা এসে মাপজোক করলেন। তাদের কথাবার্তা থেকে বুঝলাম যে, শহরের অন্যান্য সব রাস্তা আমার থেকে সরু। একমাত্র আমি চওড়া এবং সুদীর্ঘ রাস্তা। তাই আমাকে রাজপথের মর্যাদা দেওয়া হবে। সে কথা শুনে আমার আনন্দবোধ হল।
বর্তমান অবস্থা : এরপর রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, বালি ফেলা, ইট পাতা, পাথর ফেলা ইত্যাদি চলতে থাকল। শেষ হতে কয়েক বছর লাগল। তারপর এগিয়ে এলো উদ্বোধনের দিন। ফুল, মালা প্রভৃতি দিয়ে আমাকে সাজানো হল। মুখ্যমন্ত্রী ফিতে কাটলেন। আমার আনন্দের সীমা রইল না। আমার মর্যাদা বাড়ল। আমার ওপরে পিচের প্রলেপ পড়ল। দুপাশে পথচারীদের যাওয়ার জন্য আলাদা পথ। এখন দিনরাত্রি অসংখ্য ছোটো-বড়ো গাড়ি ছুটে চলেছে আমার বুকের ওপর দিয়ে। আমি নাকি এখন এই শহরের গর্ব।
অনুভূতি: মানুষের পায়ের শব্দের অপেক্ষায় আমি অধীর হয়ে থাকি। মানুষের পদশব্দ শুনলেই আমার শিরায় শিরায় উত্তেজনার শিহরণ অনুভূত হয়। আমি মানুষের জন্মমৃত্যু, প্রেম-বিরহ, হর্ষ-বিষাদের প্রত্যক্ষদর্শী। মানুষের আনন্দের উল্লাসে আমি যেমন আত্মহারা হই, তেমনই দুর্ঘটনার রক্তপাতে, মানুষের হাহাকারে কেঁদে ওঠে আমার মন। মানুষের আনন্দ ও বিষাদের সঙ্গে আমার সুখ ও যন্ত্রণাও আবর্তিত হয়। আবার লক্ষ লক্ষ মানুষের পদভার, দুর্দম গুরুভার লৌহ-শকটের নির্মম আঘাত আমাকে ক্ষত-বিক্ষত করে। চূর্ণবিচূর্ণ হয় আমার বক্ষপট। তবুও মানুষের সেবায়, সমাজের দেশের সেবায় লাগতে পারায় আমার জীবন সার্থক। এই অনুভূতিটুকু আমি মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত করতে চাই।
উপসংহার: আমাকে ভালো রাখার সঙ্গে তোমাদের ভালো থাকাও নির্ভর করে। তাই আমাকে ভালো রেখে তোমরাও ভালো থেকো – এটাই আমার একান্ত চাওয়া।
Comments
Post a Comment