কবিতাগুচ্ছ ।। নীল ডায়েরি
।। অজানা অক্ষরের নগরী ।।
কাগজের বুক খুললেই এক অক্ষরের বন,
যেখানে ব্যাকরণ নয়, শব্দের জন্মগৃহ।
আমি হাঁটছি কোলাহলহীন বর্ণমালার রাস্তায়,
হরফেরা ঝরে পড়ছে শরতের পাতার মতো।
সেখানে ব্যঞ্জনবর্ণদের চোখে ধূলো জমে আছে,
স্বরবর্ণেরা লেগে আছে আয়নার কাচে।
একটি অজানা অক্ষর হঠাৎ আমার নাম ধরে ডাকে,
কাঁপতে থাকে ডায়েরির পৃষ্ঠায় ধোঁয়া হয়ে।
আমি ভয় পাই, তবু লিখতে থাকি।
শব্দেরা আমার আঙুলে খোঁপা বাঁধে।
অচেনা ভাষা দাঁড়ায় নদীর পাড়ে
আর জলে ছিটিয়ে দেয় স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি।
তখন আমি দেখি—
ভাষাহীন পাখিরা ছায়া খুঁজছে আকাশে।
বর্ণেরা ছিঁড়ে ফেলছে শূন্যতার দেহ।
অক্ষরবৃষ্টির শব্দে পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়ে।
কেউ জানে না—
এই বৃষ্টি কাগজে নয়, মস্তিষ্কে ঝরে।
আমি লিখতে লিখতে হারাই কল্পনায়,
গড়ে তুলি শব্দের নগরী।
যেখানে প্রতিটি বাক্য একেকটি আকাশচুম্বী ভবন,
জানালার ওপারে ঝুলে আছে বিরামচিহ্নের প্রদীপ।
পাঠকের চোখ ছুঁয়ে যায় জানালার কাঁচ,
অথচ আমি অদৃশ্য থাকি।
সেই অদৃশ্যতাই আমার কবিতা।
যেখানে প্রতিটি প্রশ্নচিহ্ন একেকটি দরজা,
প্রতিটি বিস্ময়বোধক একেকটি বজ্রপাত।
আমি এই নগরীর স্থপতি—
অথচ বাসিন্দা কেউ নয়।
শুধু শব্দেরা জানে, আমি বেঁচে আছি।।
।। সমুদ্রের কাচঘর ।।
ঢেউয়ের ভেতর লুকানো কাচের দরজা,
আমি তাতে হাত রাখতেই আঙুলে লবণের ঝড়।
সাগরের বুক ভরে আছে অদ্ভুত সিঁড়িতে,
প্রতিটি ধাপের নীচে কাঁকড়ার কোলাহল।
আমি নামতে নামতে দেখি—
একদল মাছ লিখছে অক্ষর জলরঙে।
তারা বানাচ্ছে গোপন অভিধান,
যা কেবল সমুদ্রই বোঝে।
সেখানে না ছিল ব্যাকরণ, না ছিল যতিচিহ্ন,
শুধু ছিল শূন্যতার নাচ।
আমি হঠাৎ দেখি,
একটি শঙ্খের ভিতরে আটকে আছে সূর্যের কণ্ঠস্বর।
শব্দেরা ঝরে পড়ছে নীল অন্ধকারে।
প্রতিটি ঢেউ যেন কাচের জানালা।
আমি তাকালে দেখি নিজের প্রতিচ্ছবি,
অথচ তা আমার নয়।
হয়তো সমুদ্র ধার নিয়েছে অন্য কোনও জীবন থেকে।
হয়তো আমি আর আমি নেই।
জলের নিচে ঘড়ির কাঁটা পুড়ে গেছে,
সময় দাঁড়িয়ে আছে মৃত প্রবালের মতো।
তবু একদিন কেউ আসবে,
কাচঘর ভেঙে ঢুকে পড়বে।
তখন সমুদ্র কেঁপে উঠবে আলোয়,
ভেঙে যাবে লবণের সাম্রাজ্য।
আমি দাঁড়িয়ে থাকব একা—
প্রমাণ হিসেবে কেবল একটি ফসিল।
পাঠকের চোখে আমি কেবল এক মিথ।
অথচ আমি জানি,
আমার দেহ এখনো ভিজে আছে ঢেউয়ের সুরে।
সেই সুরই আমার কবিতা।।
।। নক্ষত্রের অশ্রুবিন্দু ।।
আকাশ কেঁপে ওঠে যখন নক্ষত্র কাঁদে,
ছড়িয়ে যায় আলোকের ছাই।
আমি তা কুড়িয়ে নিই মুঠোয়—
হাত কেটে যায় রুপালি ধারায়।
একদিন হয়তো তুমি দেখবে—
সেই অশ্রুবিন্দু পুড়ছে আমার কপালে।
মনে হবে ট্যাটু,
অথচ তা এক আকাশের অভিশাপ।
নক্ষত্রেরা জানে,
প্রত্যেক প্রেমিকই একদিন ধূমকেতু হবে।
আমি তোমার চোখে তাকিয়ে
খুঁজেছি সেই অগ্নির রেখা।
সেখানে জ্বলছে আমার নাম।
তুমি উচ্চারণ করোনি কোনওদিন।
শুধু রাতের অন্ধকার লিখেছে—
তোমার ঠোঁটের নীরবতা।
আমি হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়ি গ্যালাক্সির গুহায়,
দেখি, সময় সেখানে ভাঙা আয়না।
প্রতিটি প্রতিচ্ছবিতে আমি অন্য কেউ।
তোমার ছায়ার গন্ধে ভিজে আছি।
নক্ষত্রেরা শিখিয়েছে—
ভালোবাসা মানে আলো নয়, ছাই।
আমি তাই আগুনকে আলিঙ্গন করি,
অশ্রুকে বানাই শব্দ।
হয়তো কবিতা মানেই এই—
যে আগুন ছুঁয়ে যায় অচেনা চামড়া।
তুমি যদি পড়ো একদিন,
অবাক হবে, কেন আকাশের কান্না এত তীক্ষ্ণ।
তখন বুঝবে—
আমি নক্ষত্রের শেষ উত্তরাধিকার।।
।। অদৃশ্য রঙের ছায়া ।।
তুমি কি দেখেছ রঙের ছায়া?
যাদের চোখ নেই, তবু দৃষ্টি আছে।
আমি দেখেছি মধ্যাহ্নের ভিড়ে—
সাদা দেয়ালের গায়ে এক কালো লাল।
সে আমাকে ডেকে বলল—
"তুমি তো রঙহীন, আমার সঙ্গে চলো।"
আমি ছুটলাম তার পিছু পিছু,
রঙেরা খুলে দিল অদৃশ্য দরজা।
সেখানেই প্রথম দেখলাম—
হলুদ কাঁদছে কাগজে,
নীল পুড়ছে কাঁচে,
সবুজ আত্মহত্যা করছে আয়নায়।
রঙেরা বেঁচে থাকে ছায়া হয়ে।
মানুষ তা বোঝে না।
তারা ভাবে রঙ কেবল রঙিন কালি।
অথচ আমি দেখেছি রঙেরা কবি।
তারা লেখে অদৃশ্য কবিতা—
যা কেবল চোখহীনরা পড়তে পারে।
আমি সেদিন অন্ধ হয়েছিলাম কিছুক্ষণের জন্য।
হঠাৎ আমার বুক কেঁপে ওঠে,
দেখি রঙেরা আমার ভেতরে বাসা বেঁধেছে।
প্রতিটি শিরায় আঁকে নতুন ছন্দ।
আমি বুঝলাম—
এই দেহ আসলে এক ক্যানভাস।
আমি হাঁটছি রঙের ছায়াদের সঙ্গে,
তারা আমার নাম লিখছে হাওয়ায়।
পাঠকরা দেখবে শুধু ফাঁকা কাগজ।
অথচ আমি জানি,
ছায়ারা এখনো সেখানে লুকিয়ে আছে।
তাদের নিঃশ্বাসেই জন্ম নেয় কবিতা।।
।। ঘড়ির ভাঙা দাঁতের শপথ ।।
সময়ের দাঁত ভেঙে গেছে হঠাৎ।
ঘড়ি থেমে আছে কালো রক্তে।
প্রতিটি মিনিট কাঁপছে কঙ্কালের মতো।
আমি শুনি টিকটিক নয়, শপথের গর্জন।
শপথ ছিল—
আমি তোমাকে ভুলব না কখনো।
অথচ ভাঙা দাঁত হাসছে আমার দিকে।
সময় জানে,
শপথ মানে ক্ষণস্থায়ী প্রতারণা।
আমি ছুঁয়ে দেখি ঘড়ির কাচে রক্তের ছাপ,
সেখানে লেখা অচেনা নাম।
তুমি কি আমিই?
নাকি সেই শূন্যতা, যাকে সময়ও ধরতে পারেনি?
আমি শুনি ভাঙা দাঁতের ঝংকার।
যেন কেউ মুদ্রা ফেলছে মৃত্যুর থালায়।
আমি হেসে উঠি,
বুঝি সময় আসলে জোকার।
সে আমাদের হাসায়, কাঁদায়, ভয় দেখায়।
আমরা তার দাঁতের মধ্যে আটকে থাকা হাড়।
কবিতা আসলে সেই হাড়ের প্রতিধ্বনি।
আমি লিখতে লিখতে খুঁজে পাই—
ভাঙা দাঁতের নিচে এক নদী।
তার স্রোতে ভেসে যাচ্ছে ঘুমন্ত মুহূর্ত।
প্রতিটি মুহূর্ত মৃত মাছের মতো।
আমি কুড়িয়ে নিই একটি মাছ,
দেখি তার চোখে এখনো জ্বলছে আলো।
হয়তো সেটাই তোমার স্মৃতি।
আমি রেখে দিই বুকের ভেতর।
যখন ঘড়িতে আবার দাঁত গজাবে,
তখনই সে স্মৃতিকে চিবিয়ে ফেলবে।।
=====================
নীল ডায়েরি, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ
Comments
Post a Comment