অমৃতা সাহা
শিক্ষক শব্দটির ব্যুৎপত্তি √শিক্ষ+ অক অর্থাৎ যিনি শিক্ষা দান করেন। শিক্ষক শব্দটি সংস্কৃত শিক্ষ ধাতু থেকে উদ্ভুত যার অর্থ বিদ্যা গ্রহণ করা, শেখা বা বিদ্যা দান করা। শিক্ষ ধাতুর সঙ্গে ক প্রত্যয় যোগে উৎপন্ন শিক্ষক যার অর্থ শিক্ষা সম্পর্কিত।
শিক্ষককে বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে প্রায় ছয় মাস বা আট মাস সে সহজাত প্রবৃত্তি অনুযায়ী শিক্ষা লাভ করে থাকে। তারপর থেকে মা বাবাই তাকে জীবনের প্রথম পাঠ দেন। কী কী করতে হয় আর কী কী করতে নেই তাই দিয়েই শিশুর প্রথম শিক্ষা শুরু হয়। অনুকরণই হলো তখন তার একমাত্র শিক্ষার মাধ্যম। তারপর কথা বলতে শেখা, আশেপাশের সামগ্রী চিনে নিয়ে তাদের নাম বলতে শেখা এভাবে ক্রমান্বয়ে শিক্ষা প্রক্রিয়া চলতেই থাকে।
প্রাচীন কালে পঞ্চম বর্ষে উপনয়ন অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে শিশুর শিক্ষা জীবন শুরু হতো। গুরুগৃহে বসবাস করে, ব্রহ্মচর্য পালনের মাধ্যমে বাল্য ও কৈশোর কাল অতিবাহিত হতো। পুঁথিগত অধ্যয়ন, শ্রুত্বয়ন এর পাশাপাশি জীবনের অন্যান্য বিষয়েও শিক্ষা গ্রহণ করতে হত। গুরু আর গুরুপত্নী হতেন তখন শিশু শিক্ষার্থীর দ্বিতীয় পিতা মাতা। তাঁদের সান্নিধ্য, সাহচর্য ও সুশিক্ষায় শিশুর জীবনের ভিত গড়ে উঠত মজবুত ভাবে।
বর্তমানে শিশুর জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের প্রথম শৈশব। দুই বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই শিশু আটকে পড়ছে প্লে স্কুল বা কিন্ডারগার্টেনের চার দেওয়ালের মধ্যে। সেখানে শিক্ষক আর শিক্ষার্থী উভয়েই নিয়মের বন্ধনে আবদ্ধ। বাড়ি ফিরেও নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে বাবা মায়ের ব্যস্ত জীবনে শিশু তার আয়ার সান্নিধ্যে বড় হয়ে উঠছে। তার জন্য না আছে পার্কের বিশুদ্ধ হওয়া, না আছে দৌড়ানোর মতো মাঠ , না আছে খেলার সঙ্গী সাথী। মোবাইল আর টিভির সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতেই শৈশবের সোনালি দিনগুলো পার হয়ে যাচ্ছে। অত্যন্ত সৌভাগ্যবান শিশু হলে তারা দাদু, ঠাকুমা বা দাদু দিদা কে সঙ্গী হিসাবে লাভ করার সুযোগ পায়, যাদের স্নেহে যত্নে কিছুটা হলেও শৈশবের উপলদ্ধি ঘটে।
এরপর কালের অনিবার্য নিয়মে আর সামাজিক ইঁদুর দৌড়ের তাড়নায় শিশুকে শিক্ষালয়মুখী হতেই হয়। প্রত্যেক বাবা মা চায় তার শিশুটি পরীক্ষায় প্রথম হবে তাই প্রতি মুহূর্তে শিশুর পরীক্ষা চলতে থাকে। সকাল হতে না হতেই বিরস মুখে ঘুম ভাঙ্গার পরীক্ষা, নিজের থেকে বৃহত্তর ওজনের ব্যাগ বহন করার পরীক্ষা, স্কুলের খাতায় সম্পূর্ণ ভাবে সব কাজ করে আনার পরীক্ষা, বাড়ি ফিরেই খেলা ভুলে হোম ওয়ার্ক সেরে রাখার পরীক্ষা দিয়েই চলতে হয়। নিয়ম মেনে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়েও নিতে হয়। তারপর মা বাড়ি ফিরলেও খেলাধুলা, পার্কে ছোটা, মায়ের আদর সব ছেড়ে পড়তে বসতে হয়। যতক্ষণ সব পড়া তৈরী না হচ্ছে ততক্ষণ কোনও প্রকারেই ছাড় নেই। স্কুলে পরীক্ষা, হল থেকে বেরিয়ে আবার মায়ের কাছে পরীক্ষা, তার সাথে নাচের পরীক্ষা, গানের পরীক্ষা, আঁকার পরীক্ষা এই করতে করতেই ব্যতিব্যস্ত শিশুর কোথা দিয়ে যে শৈশব পার হয়ে যায় বুঝতেই পারেনা।
শিক্ষার বর্তমান অবস্থা:
এতো পড়াশোনা, এতো পরিশ্রম, এতো প্রতিযোগিতা... কিন্তু তারপর? আগে তবুও শিক্ষার্থীরা নিশ্চিত থাকতো যে ভালো রেজাল্ট হলে, চাকরির পরীক্ষা ভালোভাবে দিলে চাকরী পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তমানের পরিস্থিতি তো আরও ভয়াবহ! প্রতিবছর এতো শিক্ষার্থী পাশ করে এক বিরাট জিজ্ঞাসা চিহ্নের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। সরকারি চাকরী কোথায়? পরীক্ষা হবে? পরীক্ষার পর আদৌ প্যানেল বেরোবে? না কি একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে? চাকরি পেতে হলে কতো টাকা লাগতে পারে? চাকরি পাওয়ার পরেও সেটা থাকবে তো? নাকি আবার প্যানেল ক্যান্সেল হয়ে যাবে? এইসব প্রশ্ন একজন শিক্ষার্থীকে সরকারি চাকরি থেকে বিমুখ করে তুলেছে।
যারা খুব উন্নত মেধাযুক্ত তারা ভিনরাজ্যে চলে যাচ্ছে চাকরির সন্ধানে। কিন্তু বেশিরভাগ মধ্যম মানের শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত কী হবে? ছোট ছোট বেসরকারি সংস্থা গুলিতে শরীরের রক্ত জল করছে তারা। নয়তো মুখে রক্ত তুলে দিবারাত্র পরিশ্রম করছে। আবার সরকারি চাকরিতেও কোনো নিশ্চয়তা নেই। বেশ কিছু বছর চাকরি করার পর চাকরি চলে যায় এই নমুনা সামনে রেখে তাই নতুন প্রজন্ম ভীষণ ভাবে দিশেহারা।
আমার জীবনে শিক্ষকের প্রভাব:
আমরা যে সময়ে শিক্ষা লাভ করেছি সেই সময়টাকে golden age বলা যেতে পারে। ছোটবেলা থেকেই আমার উপরে আমার পিতৃদেবের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। বোটানির ছাত্র আমার বাবার প্রাকটিক্যাল খাতাগুলো আমাকে সবথেকে বেশি আকর্ষণ করতো। তাই অক্ষর পরিচয় হওয়ার আগেই আমার আঁকায় হাতেখড়ি হয়েছিল। এর সুপ্রভাব পড়েছিলো আমার হাতের লেখাতে। সারাজীবন ধরে বাবাই আমার প্রধান শিক্ষক, বন্ধু আর সমালোচক।
ছোটবেলায় আমি একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করি। স্কুলটি সেই বছরই স্থাপিত হয়। শিক্ষিকারা ভীষণ ভালোবেসে মায়ের মত স্নেহে যত্নে আমাদের ভিতটা গড়ে দিয়েছিলেন। সেই ভালোবাসার বন্ধন আজও অটুট।
মাধ্যমিক স্তরে পড়তাম একেবারে বাড়ির কাছে ভদ্রকালী দেশপ্রিয় বালিকা বিদ্যামন্দিরে। পড়াশুনা খেলাধুলা সবই করতাম। সময়ের কাজ সময়ে করাতে কোনো অসুবিধা তেমন হতনা।
তবে জীবনের একটি দুঃখজনক ঘটনা এখনে ঘটেছিল। আমাদের অংকের শিক্ষিকা ছিলেন স্নেহকণা দি। আমি তাঁকে খুব বেশি পছন্দ না করলেও তিনি আমাকে বেশ ভালোবাসতেন। আমাদের মাধ্যমিকের আগে শেষ শিক্ষক দিবসের দিন, আমরা যারা স্টেজে নাচ, গান ইত্যাদি করেছিলাম, প্রত্যেককে উনি নিজের হাতে মিষ্টি খাইয়েছিলেন। আমি মিষ্টি খাবোনা বলেছিলাম। তাই উনি আমাকে জোর করে আমার মুখে মিষ্টি ঢুকিয়ে দিয়ে বলেছিলেন এই খাইয়ে দিলাম আর তো দেবোনা। সেদিন বুঝেছিলাম উনি আমাকে কতোটা স্নেহ করেন। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য পরের দিনই স্কুলে গিয়ে জানতে পারলাম আগেরদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় স্নেহকণা দির অ্যাক্সিডেন্ট হয় এবং উনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। এমন দুঃখজনক ঘটনা সারাজীবনে কোনওদিন ভোলার নয়।
আমার জীবনকে সবথেকে বেশি প্রভাবিত করেছে হাওড়া বিজয় কৃষ্ণ গার্লস কলেজ। বাংলা অনার্স নিয়ে আমি যাঁদের পেলাম তাঁরা সকলেই প্রণম্য। তাঁদের মধ্যে দুজন স্বনামধন্য সাহিত্যিককে পেয়েছিলাম বানী বসু এবং বিনতা রায় চৌধুরী। বানী বসু ম্যাডামের কাছে মাত্র এক বছর ক্লাস করলেও তার অসাধারণত্ব জীবনে ভোলার নয়। আর বিনতা রায় চৌধুরী ম্যাডামের কাছে তিন বছর অনার্স ক্লাস করে আমার জীবন সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে গেছে। অন্যান্য ম্যাডামরাও আমাকে এখনও যথেষ্ট ভালোবাসেন। তবে একজন সাহিত্যিককে এতো কাছ থেকে পেয়েছি, উনার পড়ানোর স্টাইল পরিপূর্ণ রূপে আত্মস্থ করেছি, আর উনাকে জীবনের লক্ষ্য হিসাবে স্থির করেছি। তখন থেকেই উনার এক একটা গল্প উপন্যাস পড়তাম, ভীষণ ভালো লাগতো। তখন থেকেই নিজে লেখার চেষ্টা করতাম। কতবার পছন্দ হতনা, কেটে দিতাম, আবার নতুন করে লিখতাম। কখনও বেশ পছন্দ হতো। ম্যাডাম সংশোধন করে দিতেন কখনও কখনও। এই করতে করতেই সাহিত্য রচনায় হাতেখড়ি হয়ে গেলো। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করবো এই মানসিকতাও তখন থেকেই দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করলাম।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পেলাম আরও একগুচ্ছ সাহিত্যিক, লেখক, অধ্যাপককে। নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী, মানস মজুমদার, পবিত্র সরকার, বিমল মুখোপাধ্যায়, হিমবন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় এদের মত প্রণম্য অধ্যাপককে একসঙ্গে পেয়ে আমার জীবন ধন্য হয়ে গেছে। কী আসমুদ্র এঁদের পাণ্ডিত্য আর কী অসাধারণ বাগ্মিতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি দিন যেন স্মৃতির প্রতিটি পাতায় সোনার অক্ষরে লেখা হয়ে আছে।
================
অমৃতা সাহা
৭৫, দেশবন্ধু নগর রোড
হিন্দমোটর, হুগলি।
পিন ৭১২২৩৩
Comments
Post a Comment