শিক্ষার সেকাল এবং একাল
✍️মোফাজ্জল মণ্ডল
শিক্ষা কেবল আলোকপ্রাপ্তির উপায় নয়, বরং একটি জাতির সামগ্রিক উন্নয়নের মাপকাঠি। "সেকালে" যখন শিক্ষক-শিষ্যের সম্পর্ক ছিল মমতা, শৃঙ্খলা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার ওপর প্রতিষ্ঠিত, তখন "একালে" শিক্ষাকে ঘিরে দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব, অব্যবস্থাপনা ও দায়সারা মনোভাবই মুখ্য হয়ে উঠেছে। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থা আজ তীব্র সংকটের মুখে, যেখানে সেকাল-একালের ব্যবধান স্পষ্ট। শিক্ষা পাওয়া সকল শিশুদের অধিকার। কিন্তু তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে অনেক ক্ষেত্রেই নানাভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এবিষয়ে মালালা ইউসুফজাই বলেছেন– "One child, one teacher, one book, one pen can change the world."
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে শিক্ষার চিত্র-
দিল্লি: শেষ আপ সরকারের সময়ে সরকারি স্কুলে অবকাঠামো অভাবনীয় উন্নয়ন হয়েছে। প্রতিনিধি পাঠিয়ে বিদেশ থেকে আধুনিক শিক্ষা রপ্ত করিয়েছে। সেই এক্সটা কারিকুলাম যোগ হয়েছে, "হ্যাপিনেস ক্লাস" ইত্যাদি উদ্যোগে শিক্ষার মান অনেক বেড়েছে।
গুজরাট: নিয়োগ করেছে, সিলেবাস উন্নত করেছে। দক্ষতা ও শিল্পভিত্তিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
উত্তরপ্রদেশ: গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষক শূন্যতা থাকলেও প্রসার ঘটছে। তবে শিক্ষক নিয়োগ নিয়েও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
তামিলনাড়ু: মধ্যাহ্নভোজ প্রকল্প শিক্ষার প্রসারে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সেই সাথে শিক্ষার মান উন্নয়ন ঘটিয়েছে।
কেরল: দেশের সর্বোচ্চ সাক্ষরতার হার ও ডিজিটাল স্কুল প্রবর্তন। শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষাদান সব ক্ষেত্রেই অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে।
বিহার: ধীরে ধীরে উন্নতির পথে, তবে রাজনৈতিক প্রভাব ও অবকাঠামো ঘাটতি প্রকট। পশ্চিমবঙ্গ থেকে এগিয়ে যাচ্ছে।
পাঞ্জাব: রাজ্য সরকার শিক্ষার সংস্কার চালাচ্ছে, তবে গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার মান এখনও প্রশ্নবিদ্ধ।
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থা: সেকাল বনাম একাল
সেকাল (১৯৫০–১৯৮০ দশক পর্যন্ত)
শিক্ষক সমাজে সর্বাধিক সম্মানীয় ছিলেন।
শৃঙ্খলার প্রতীক বেত শিক্ষকের হাতে থাকত।
নিয়োগ হতো মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে।
সরকারি স্কুলই ছিল মানুষের প্রধান ভরসা। পড়ুয়ারা শিক্ষকদের যথেষ্ট সম্মান করত, শিক্ষকরাও পড়ুয়ারাদের ভালোবাসত। পাস-ফেল থাকায় পড়ার কোয়ালিটিরউন্নয়ন ঘটেছিল। যদিও ইংরাজী শিক্ষা প্রাথমিকস্তরে বাম আমলে তুলে দিয়েছিল। শিক্ষা ছিল নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও কর্মদক্ষতা অর্জনের উপায়।
একাল (১৯৯০–বর্তমান)-
বাম আমল থেকে ১৯৯৫ সাল থেকে শিক্ষক নিয়োগের জন্য ssc পরীক্ষা চালু হয়েছিল। নিয়মিত নিয়োগ হত।
শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি: ২০১১ সাল থেকে তৃণমূল সরকার আসার পরে যে সব শিক্ষক নিয়োগ করেছে সেগুলোতে কোটি টাকার বিনিময়ে অযোগ্যদের চাকরির অভিযোগ উঠেছে, যোগ্যরা বঞ্চিত হয়েছে।
এতে নেতা-মন্ত্রী আমলা জেলে গিয়েছেন। অভিযোগের ভিত্তিতে আদালতের রায়ে ২০২৪ সালে ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি চলে গিয়েছে। অভিযোগ, ssc বা রাজ্য সরকারকে আদালত বারংবার স্বচ্ছ ও অস্বচ্ছ তালিকা দিতে বলে ছিল কিন্তু তারা দেননি। এমনকি ২০১৭ সালের ৩২০০০ প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগও সরু সুতোয় আদালতের মামলায় ঝুলছে। এর দায় রাজ্য সরকার এবং তার শিক্ষা দপ্তরের।
শিক্ষকের মর্যাদা হ্রাস: নিয়োগে অভিযোগ ওঠায় পুরো শিক্ষক সমাজকে সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। সরকার দায়সারা মনোভাব নিচ্ছে।
শিক্ষক শূন্যপদ- রাজ্যের সরকারি এবং সরকার পোষিত স্কুল গুলিতে কয়ে লক্ষ শূন্যপদ পড়ে রয়েছে অথচ নিয়োগের পরীক্ষা নেই, তাই নিয়োগ নেই। শিক্ষক নিয়োগ না থাকায় স্কুলগুলি ধুকছে। শিক্ষিত বেকররা দিশেহারা হচ্ছে। নিয়োগ করলেও অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে। বিরাট এক সংকট দেখা দিচ্ছে রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থায়।
পাশ-ফেল তুলে দেওয়া: পড়ুয়াদের মধ্যে শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব কমেছে। পড়ুয়ারা পড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। শিক্ষকরা চাপ দিয়ে পড়ানোর চেষ্টা করছেন।
অবৈজ্ঞানিক সিলেবাস: যুগোপযোগী সংস্কারের অভাব।
রাজ্যস্তরে মান্ধাতার আমলের সিলেবাস চলছে। উপযুক্ত ও আধুনিক সিলেবাস সংষ্কার হয়নি।
শিক্ষককে অশিক্ষণমূলক কাজে ব্যবহার:শিক্ষকদের পড়ানোর পাশাপাশি জামা, জুতো ও ব্যাগ বিতরণ, কন্যাশ্রী, শিক্ষাশ্রী, বিডিও অফিসের কাজকর্ম থেকে হরেকরকম কাজে যুক্ত করা হয়েছে। সম্প্রতি শিক্ষকদের বুথ লেভেল অফিসার (বিএলও) হতে কাজে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছে। এতে স্কুলগুলি বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এতে প্রকৃত পাঠদানের ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
অবকাঠামোগত ঘাটতি: গ্রামীণ স্কুলে শ্রেণিকক্ষ, টয়লেট, বেঞ্চ, পানীয় জলের অভাব।
প্রাথমিক স্তরে ভরতি সমস্যা- বেসরকারি স্কুলগুলি ৩ বা ৪ বছর বয়স থেকে স্কুলে ভরতি নেয়। অন্যদিকে সরকারি স্কুলগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ৫ বছর বয়েসের নীচে কোন পড়ুয়াকে ভরতি নেওয়া যাবে না। এই দ্বিচারিতায় স্কুলগুলি সমস্যায় পড়েছে। সচেতন অভিভাবকরা পড়ুয়াদের ৩ বা ৪ বছর বয়েসেই স্কুলে ভরতি করছেন। সরকারি স্কুল ভরতি না নেওয়ায় বেসরকারি স্কুলে ভরতি করছেন, এতে প্রাথমিক স্কুলগুলিতে ছাত্র সংখ্যা কমছে।
সরকারি ইংরাজি মাধ্যমের স্কুলের অভাব- শেষ এক দশকে ক্রমশ ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু সরকারিভাবে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল হাতেগোনা। সবাই দেখছে হু হু করে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ুয়া বাড়ছে অন্যদিকে বাংলা মিডিয়ামে কমছে। কিন্তু সরকার বা শিক্ষা দপ্তর প্রায় উদাসীন। অঞ্চল ভিত্তিক বা ব্লকভিত্তিক একটি করে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল বা বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ইংরেজি মিডিয়াম চালু করার উদ্যোগ নিতে পারে কিন্তু সম্পূর্ণ উদাসীন। সরকার বা শাসকদল শুধু জনমোহিনী স্কিম চালু করে ভোট কিনতেই ব্যস্ত। সরকারে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যা খুশি করছে শুধু স্কুলগুলির প্রতি নজর নেই বললেই চলে৷
নতুন সংকট
১. শিক্ষায় রাজনীতিকরণ:
শিক্ষক নিয়োগ, স্কুলের পরিচালন সমিতি, পড়াশোনা, বদলি থেকে শুরু করে স্কুল পরিচালনা—সবখানেই রাজনৈতিক দলের প্রভাব প্রকট। স্কুলের খেলা, পরিচালন সমিতি সবক্ষেত্রেই শাসকদলের নেতা ও সদস্যরা ছড়ি ঘোরান। শিক্ষকদের নিয়োগ থেকে অবিসর সময় অব্দি রাজনীতির ফাঁদে পড়তে হয়। চাকরিতে যোগদানের সময় দূরে পোস্টিং দেয়। বাড়ির পাশে স্কুলে বদলির জন্য নেতাদের তেল মারতে হয়। আবার এখন উচ্চ বিদ্যালয়গুলিতেও ছাত্র সংগঠনগুলো অনেক সময় রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়। আবার বিরোধী দলের সদস্য হলে সেই শিক্ষকদের উপর হুশিয়ারি ও নানান অত্যাচার চলে।
২. ফান্ডের অপব্যবহার ও কাটছাঁট:
স্কুল পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট ফান্ড বরাদ্দ থাকলেও তার প্রায় ৫০% প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক কারণে খরচ হয় না, কেটে নেওয়া হয়।
অবকাঠামো উন্নয়ন, গ্রন্থাগার, ল্যাবরেটরি, টয়লেট বা স্মার্ট ক্লাসরুমের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করা হয় না।
অন্য খাতে বিপুল ব্যয়:
সামাজিক স্কিমের নামে ভোটব্যাংক রক্ষায় ভর্তুকি বিলি।
মন্দির নির্মাণ, প্রাসাদ বিতরণ, মেলা আয়োজনসহ অশিক্ষামূলক কাজে কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে।
এর ফলে শিক্ষার মতো মৌলিক খাত বঞ্চিত হচ্ছে।
একালের শিক্ষার ফলাফল
সরকারি স্কুলে পড়ুয়া সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। ইংরাজি মিডিয়ামে পড়ানোর ট্রেন্ডে অনেক অভিভাবকই ঝুঁকছেন। এতে বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলি ঝুঁকছে। বেসরকারি স্কুলগুলির পড়ার থেকে ঠাটবাট বেশি তাই সবার চোখে পড়ছে। অনেক অভিভাবকরা সেই ফাঁদে পড়ে বেসরকারি স্কুলের দিকে ঝুঁকছেন, যা অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়াচ্ছে। পড়ুয়াদের নৈতিক শিক্ষা, কর্মদক্ষতা ও প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা কমছে। শিক্ষক সমাজের সম্মান ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
শিক্ষা বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন – "Education is the manifestation of the perfection already in man."
(শিক্ষা দিলে মানুষ জেগে উঠবে, তাই শাসকরা শিক্ষা নয়, অন্য উপহার দিয়ে মানুষকে ঘুম পাড়ায়।)
পরিশেষে বলা যায়, "সেকাল"-এর শিক্ষাব্যবস্থা ছিল শৃঙ্খলাপূর্ণ, যোগ্যতাভিত্তিক ও সমাজের কাছে সম্মানজনক। আজ "একালে" রাজনীতিকরণ, দুর্নীতি, অব্যবস্থা, ফান্ড কাটছাঁট এবং দায়সারা মনোভাব শিক্ষার মানকে ধ্বংস করছে। দিল্লি, কেরল বা তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যে যেখানে শিক্ষার উন্নয়ন ঘটছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গ দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে।
শিক্ষা থেকে যদি রাজনীতি ও দুর্নীতি দূর না করা যায়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। এর দায় কার? রাজ্য সরকার এবং তার শিক্ষা দপ্তর কী তার দায় এড়াতে পারে?
================
Comments
Post a Comment