পাপান ও নূতন মিস
গোপা সোম
পাপান যে বিদ্যালয়ে পড়ে, সেই বিদ্যালয়টি বিশাল বড়, অনেকখানি জায়গা জুড়ে অবস্থিত। বিদ্যালয়ে অনেক শ্রেণী কক্ষ রয়েছে, কারণ, প্রত্যেক শ্রেণীতে তিনটি করে বিভাগ রয়েছে। প্রত্যেক বিভাগে কম বেশী ত্রিশ জন ছাত্র-ছাত্রী। এক কথায়, শহরের বুকে এক অন্যতম গৌরবময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেই বিদ্যালয়ে অনেক সংখ্যক মাস্টারমশাই দিদিমণি আছেন। পড়াশোনায় ও বিদ্যালয়টির বেশ সুনাম আছে। রেজাল্ট খুবই ভাল হয়।
সম্প্রতি বিদ্যালয়ের অঙ্কের মাস্টারমশাই অবসর নিয়েছেন, তাঁর স্থানে একজন নূতন মিস এসেছেন। নূতন মিস কয়েকদিনের মধ্যেই ছাত্র-ছাত্রী সবার খুব প্রিয়জন হয়ে উঠেছেন। সবসময় লাল পেড়ে শাড়ি পরে আসেন, এছাড়া আর কোনো পোষাকে মিসকে বিদ্যালয়ে দেখা যায়নি। নূতন মিস পাপানদের অঙ্ক ও পদার্থবিদ্যা পড়ান, এত সুন্দর বোঝান, পাপানের খুব ভালো লাগে মিসের পড়ানো। নূতন মিস বলতে পাপান অজ্ঞান। আর নূতন মিসও পাপানকে খুব স্নেহ করেন। নূতন মিসের কাছ থেকে পাপান অনেক কিছু শিখতে পেরেছে।
নূতন মিস খুব নিয়মানুবর্তী, উনি সময় দেখে ক্লাসে আসেন, এবং তাঁর পড়ানোর ভাগ পুরোপুরি বুঝিয়ে, সঠিক সময়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যান। ছাত্র-ছাত্রী অন্ত প্রাণ এই নূতন মিসকে, পাপান যত দেখে, তত যেন তার অবাক লাগে। মিস ছাত্র-ছাত্রীদের যেমন একাধারে স্নেহ করেন, তেমনি অন্যায় দেখলেও ছাত্র-ছাত্রীদের তিরস্কার করতে পিছপা হন না। এই তো, এবারের শ্রেণীর পরীক্ষায়, পাপানদের শ্রেণীরই একটি মেয়ে, নাম রণিতা, মোবাইল ফোন সাথে নিয়ে পরীক্ষা হলে বসে, ফোন থেকে কপি করছিল, নূতন মিস তাকে হাতে নাতে ধরে ফেলেন, বলেন, তুমি না ক্লাসের সেরা পাঁচের মধ্যে থাকো, ছিঃ, তুমিও কপি করছো! এ কথা শুনে, রণিতা খুব অপমানিত বোধ করে, ও মিসের সাথে বিরূদ্ধাচারণ করতে থাকে। পাপান ভালোভাবেই সেটা অনুভব করতে পেরেছিল। রণিতা নূতন মিসের ক্লাসে আসা প্রায় বন্ধ করে দিল। আর সব মাস্টারমশাই দিদিমণির ক্লাস করত, কিন্তু নূতন মিসের ক্লাসে অনুপস্থিত থাকত। কিন্তু, পাপানেরই আরেক সহপাঠী, সৌম্যজিৎ সেদিন ক্লাসের পড়া না শুনে, অন্য খাতা খুলে, কি লিখছিল, নূতন মিস তাকে দেখে ফেললে, তাকেও বকেন, বলেন, এত স্পর্ধা কী করে তার হয়? মিসের পড়ানো না শুনে, মিসের ক্লাসেই বসে অন্য কাজ করার অনুমতি তাকে কে দিয়েছে? তখন সৌম্যজিৎ উঠে দাঁড়িয়ে মিসকে বলে, আর কোনোদিন হবে না এরকম, আসলে, আগের দিন তার ঘুম পেয়ে গেছিল, হোম ওয়ার্ক করে উঠতে পারেনি, পাছে এর পরের ক্লাসে মাস্টারমশাই বকেন, সেই ভয়েতে এই কাজ করেছে সে। নূতন মিস সৌম্যজিৎ এর পিঠে হাত দিয়ে বলেন, "ঠিক আছে, এরকম কাজ আর করো না"।
এইভাবে দিন এগিয়ে যায়, নূতন মিস ও এই বিদ্যালয়ে পুরনো হতে থাকেন। কিন্তু পাপানের নূতন মিস কে আর সবার থেকে, একটু অন্যরকম লাগে। নূতন মিস পাপানের কাছে নূতনই থেকে যান। মিস কোনোদিন বিদ্যালয়ে না এলে, পাপানের খুব কষ্ট হয়। নুতন মিস ও পাপানকে খুব স্নেহ করেন। পাপানের নূতন মিসের ব্যাপারে কৌতূহলটা একটু বেশীই বেড়ে যায়। পাপান লক্ষ্য করে স্টাফ রুমের কাঁচের দরজা দিয়ে, বাইরে থেকে, স্টাফ রুমে, সব মাস্টারমশাই দিদিমণিরা একসাথে টিফিন শেয়ার করছেন, হৈ চৈ করছেন, কিন্তু নূতন মিস একপাশে একলা বসে, নিজের টিফিন সারছেন। তিনি কারোর সাথে অযথা বেশী কথা বলেন না, নিজের মত চলেন। পাপানের ব্যাপারটা কেমন কেমন লাগে, কিন্তু বুঝতে পারে না।
তো একদিন হলো কি, পাপানদের বিদ্যালয় ছুটি হয়েছে, সবাই যে যাঁর মত, কেউ রিকশয়, কেউ বাইকে, কেউ স্কুটি তে চড়ে বাড়ী ফিরছিলেন। নূতন মিসের নিজের কার আছে, তাতেই তিনি যাওয়া আসা করেন। নূতন মিস ও তখন কারএ করে ফিরছিলেন। রাস্তায় বিপরীত দিক থেকে এক বাইক আরোহী একটি মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে যায়, মেয়েটি ছিটকে পড়ে যায়, রাস্তার এক পাশে। যেই না দেখা, মিস তখন গাড়ী থেকে নেমে, সাথে ড্রাইভারকে নিয়ে মেয়েটিকে নিজে কোলে করে তাঁর গাড়ীতে তুলে নেন। রাস্তায় আরো লোকজন তখন জমে যায়, মিস কারোর সাথে কথা না বাড়িয়ে, তড়ি ঘড়ি করে মেয়েটিকে নিয়ে গাড়ী চালিয়ে দিতে বলেন, ড্রাইভারকে। মেয়েটি আর কেউ নয়, সেই রণিতা, মোবাইল ফোন নিয়ে কপি করছিল, পরীক্ষার হলে, আর মিস ধরে ফেলায়, মিসের ক্লাসে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল, যদিও অন্য মাস্টারমশাই, দিদিমণির ক্লাস করত।
পরের দিন পাপান বিদ্যালয়ে যে ঘটনা শুনল, শুনে তো সে হতবাক। নূতন মিসের বাড়ীতে কেউ নেই, শুধু তাঁর মা ছাড়া। নূতন মিসের মা চোখে দেখতে পারেন না। একজন পরিচারিকা কিছু সময়ের জন্যে থাকে, ওনার মায়ের কাছে। চাকরীর সুবাদে নুতন মিসকে ঘর থেকে সকাল সকালই বেরিয়ে পড়তে হয়, আর সন্ধ্যেবেলায় ঘরে ফিরতে হয়। নূতন মিস ঘরে না ফেরা অবধি ওনার মা'র সারাক্ষণ একটা অস্থিরতায় কাটে, যেই নুতন মিস ঘরে ফেরেন, তখন ওনার মা একটু নিশ্চিন্ত হন। গতকাল এই দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ায়, নূতন মিস ঠিক সময়ে বাড়ী ফিরতে পারেন নি, অনেক রাতে বাড়ি ফিরতে হয়েছে। নূতন মিস রণিতা কে নিয়ে যে নার্সিং হোমে নিয়ে গেছিলেন, সেখানে, রণিতার বাবা-মার বণ্ডে সই চেয়েছিল, কিন্তু নূতন মিস নিজের দায়িত্বে সবটূকু নিয়ে নেন, ও নিজেই বণ্ডে সই করে দেন। টাকা-পয়সা সব মিটিয়ে দেন। আসলে রণিতার মাথায় চোট লেগেছিল, আর ভেতরে ভেতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, আর বেশী দেরী করলে হয়তো রণিতাকে বাঁচানো যেত না। রণিতার একটা ছোট সার্জারি হয়, সৌভাগ্যক্রমে, রণিতার ব্লাড গ্রুপের সাথে নূতন মিসের ব্লাড গ্রুপ মিলে যায়, তাই নূতন মিস রণিতার প্রয়োজনীয় রক্ত ও দিয়ে দেন। ফলে রণিতা এই যাত্রা বেঁচে যায়।
এদিকে, বিকেলে রণিতা বিদ্যালয় থেকে বাড়ী না ফেরায়, ওর বাবা-মা তো দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়েন। তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ স্টেশনে রিপোর্ট করেন। রণিতার ঘনিষ্ঠ সাথী মৌমিতাকেও ফোন করেন। মৌমিতা আবার সেদিন বিদ্যালয়েই যায়নি। সে এই ব্যাপারে কিছুই বলতে পারেনা। তখন তাঁরা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মশাইকে ফোন করে জানান, রণিতা আজ ঘরে ফেরেনি। প্রধান শিক্ষকমশাই তাঁদের আশ্বস্ত করে জানান, রণিতা আজ এক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। ওদের নূতন মিস ওকে নিয়ে গেছেন সিটি নার্সিং হোমে, নূতন মিস সময় নষ্ট না করে , নিজেই বণ্ডে সাইন করে রণিতার চিকিৎসার পূর্ণ দায়িত্ব নিজের হাতেই নিয়ে নিয়েছেন। চিন্তার কোনো কারণ নেই। নূতন মিসের সাথে প্রধান শিক্ষকমশায় ফোনে যোগাযোগ রেখেছেন। তিনি আরোও জানান, তিনি এখনি যাবেন ওই নার্সিং হোমে। এদিকে পুলিশ স্টেশন থেকেও খবর আসে রণিতা পালের দুর্ঘটনার খবর, তাঁরা জানান, রণিতা এখন সিটি নার্সিং হোমে, নিরাপদে আছে। রণিতার বিদ্যালয়ের নূতন মিস গোটা ব্যাপারটার দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন। রণিতার বাবা-মা ছুটতে ছুটতে আসেন নার্সিং হোমে। তাঁরা এই ঘটনা বিশ্বাস করতেই পারছিলেন না প্রথমে, যে মিসের নামে রণিতা এত নিন্দে করতো, মিস নাকি ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে ভালোভাবে কথা বলেন না, মিস নাকি ভালো পড়ান না, মিস খুব বদরাগী, সেই মিস রণিতার হয়ে এত কিছু করছেন! বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মশাই একটু আগেই ফিরে গেছেন, নূতন মিসই তাঁকে বাড়ী পাঠিয়ে দিয়েছেন, জোর করে, প্রধান শিক্ষক মশায়ের শারীরিক অসুস্থতার কথা ভেবেই। ফলে, রণিতার বাবা-মার সাথে প্রধান শিক্ষক মশায়ের দেখা হয়ে ওঠে নি। রণিতাকে অপারেশন থিয়েটার থেকে সরিয়ে অন্যত্র দেবার একটু পরেই জ্ঞান ফেরে। রণিতার বাবা-মা নূতন মিসের সাথে দেখা করেন, নূতন মিস তাঁদেরকে আশ্বস্ত করেন, এখন রণিতা বিপদ মুক্ত, ওর এখন বিশ্রামের দরকার। আপনারা আজ ঘরে চলে যান। সকালে আসবেন। নূতন মিসও বাড়ী ফেরেন অনেক রাতেই। রণিতার বাবা-মার মুখ দিয়ে আর কথা বেরোয় না। তাঁরা যে কত বড় অপরাধ করে ফেলেছেন, নূতন মিসের প্রতি, এই ভাবনাই তাঁদের কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে থাকে।
অপরদিকে, নূতন মিসের নামে সম্প্রতি পাপানদের বিদ্যালয়েও একটা গুঞ্জন উঠে গেছে, কেউ কেউ নূতন মিসের নামে মিথ্যে বদনাম দেয়, নুতন মিস নাকি বিদ্যালয়ে আসেন না ঠিক মত, ক্লাস ও নেন না ঠিক মত, পড়া ভালো বোঝাতে পারেন না, রেডিমেড নোটস দেন না। ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁর ভয়ে সবসময় কুঁকড়ে থাকে ইত্যাদি, ইত্যাদি। নূতন মিসের কানেও সম্ভবত কথাগুলি গেছিল, কিন্তু নূতন মিস কারোর কথায় পরোয়া করতেন না। নিজে ঠিক মত নিজের কাজ করে যেতেন। আজ সব্বাইকে আরেকবার তাক লাগিয়ে দিলেন নূতন মিস।
রণিতার অপারেশনের পরের দিন ওর বাবা-মা পাপানদের বিদ্যালয়ে আসেন, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের ঘরে, তাঁরা বসেন বেশ কিছুক্ষণ। রণিতা এখন সুস্থ, ঔষধে সাড়া মিলেছে। নুতন মিসের প্রতি তাঁদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। নূতন মিস আজ না থাকলে, রণিতাকে আজ হারাতে হতো, বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন রণিতার মা। কি বলে নূতন মিসকে সম্বর্ধনা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবেন, এই নিয়েই কথা বলতে এসেছিলেন প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের সাথে। প্রধান শিক্ষক মহাশয় বলেন, এই ঘটনায় আমরা সবাই অভিভূত, আজ নূতন মিসের থেকে অনেক কিছু শিক্ষা আমরা লাভ করলাম। নিজের জীবন বিপন্ন করেও যিনি পরের বিপদে ঝাঁপ দিয়ে দেন, তিনি মানুষ নন, তিনি দেবতা, এই বলে প্রধান শিক্ষক মহাশয় নুতন মিসের উদ্দেশ্যে প্রণাম করলেন।
এরপর বেশ কয়দিন কেটে গেছে, রণিতা এখন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছে, বিদ্যালয়ে আসা শুরু করেছে। নূতন মিসের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু রণিতাকে দেখা যাচ্ছে না। নূতন মিস ও মনে হলো, রণিতাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। ক্লাসের সবাই হতবাক। এত বড় ঘটনার পর ও রণিতা কি নূতন মিসের ক্লাসে আসবে না? সবাই একটু চঞ্চল, কিন্তু কেউই কিছু মুখ ফুটে বলতে পারছে না। ক্লাস শেষ হলো, নূতন মিস এটেন্ডেন্স রেজিস্টার নিয়ে বেরোতে গিয়ে দেখেন, ক্লাসরুমের দরজার কাছে রণিতা একটা বড় ফুলের তোড়া হাতে দাঁড়িয়ে অঝোর ধারায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নূতন মিস বলে উঠলেন, রণিতা, তুমি ক্লাসে যাওনি কেন? এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী করছ? তখন রণিতা মিসকে একটা প্রণাম করে বললো, মিস, আমি সরি, আপনার সাথে আমি যে আচরণ করেছি, তার ক্ষমা নেই, বলে মিসের পায়ের কাছে বসে পড়ল, নূতন মিস রণিতাকে উঠিয়ে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
===============
Comments
Post a Comment