অসবর্ণ
দেবাংশু সরকার
ইন্টারভিউ দেওয়ার পর অরূপের মনে হয়েছিল চাকরিটা হয়তো সে পেয়ে যাবে। বেশ ভালোভাবেই সে ইন্টারভিউতে করা প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছিল। সেইসঙ্গে ক্যাশ হ্যান্ডেলের তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাও বলেছিল। অরূপের মনে হয়েছিল ইন্টারভিউ বোর্ডে যারা ছিলেন তাদের হয়তো অরূপের কথাবার্তা বেশ ভালো লেগেছে। বারে বারে তাদের মাথা নাড়া, মুখের হাসি দেখে অরূপের মনে হয়েছিল তারা হয়তো অরূপের প্রতি কিছুটা হলেও সন্তুষ্ট। বেসরকারি চাকরি হলেও এই অফিসটা সব রকম সরকারি নিয়মকানুন মেনে চলে। প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচুইটি, বোনাস সব রকম সুবিধা কর্মচারীরা পায়। চাকরির শেষে পেনশনের ব্যবস্থাও আছে। হয়তো সরকারি চাকরির মত বড় অঙ্কের পেনশন এই কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীরা পায় না। কিন্তু পেনশন বাবদ প্রতি মাসে কিছু টাকা তাদের হাতে আসে। মাহিনাও খুব একটা খারাপ নয়। অর্থাৎ সরকারি চাকরির মত অত সুবিধা না থাকলেও, তুলনামূলকভাবে খুব একটা খারাপও নয়। কিন্তু একটাই অসুবিধা তাকে বাড়ি ছেড়ে থাকতে হবে। কারণ এই অফিসটা অরূপের বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে। বাড়ি থেকে প্রত্যেক দিন অফিসে যাতায়াত করা সম্ভব নয়। অফিসের কাছাকাছি কোনও বাড়ি ভাড়া করে থাকতে হবে।
ইমেল মারফত চাকরির অফার লেটারটা পাওয়ার পরে অরূপ এসেছে তার নতুন অফিসে। ফ্যাক্টরি সংলগ্ন অফিস। সহরাঞ্চল থেকে বেশ কিছুটা দুরে। আশপাশের পরিবেশটা অনেকটাই গ্রাম্য। কিছু কাগজপত্র জমা দিতে হবে। তাছাড়া আরও কিছু অফিসের নিয়ম কানুন তাকে পূরণ করতে হবে। সেইসঙ্গে একটা ভাড়া বাড়ির ব্যবস্থাও সে করে যাবে বলে ঠিক করেছে। এক কামরার খুব ছোট ঘর হলেও তার চলবে। সে রান্নাবান্না মোটামুটি করতে জানে, একা থাকলেও তার অসুবিধা হবে না। নতুন অফিসে এসে প্রথম দিন অরূপের ভালোই লেগেছে। প্রথম দিনেই তার মনে হয়েছে অফিসের অন্যান্য কর্মচারীরা খুব মিশুকে। প্রথম দিনেই তারা অরূপের সঙ্গে মন খুলে কথা বলেছে। তার সম্বন্ধে যথেষ্ট আগ্রহ দেখিয়েছে। এমনকি কোনও কিছু প্রয়োজন হলে, কোনও রকম দ্বিধা না করে অরূপ যেন তাদের বলে সে কথাও জানিয়েছে। সহকর্মীদের আন্তরিক ব্যবহারে অরূপ মুগ্ধ হয়।
শ্যামল নামের এক সহকর্মী যে অরূপের প্রায় সমবয়সী তাকে অরূপ একটা ছোট খাটো ভাড়া বাড়ি দেখে দেওয়ার জন্য বলে। শুনে শ্যামল বলে, "ভাড়া বাড়ি নিয়ে কোনও চিন্তা করোনা। আমাদের নবীনদার কয়েকটা ছোট ছোট বাড়ি আছে। ভাড়া দেয় তুমি একা থাকবে, খুব বড় বাড়ির প্রয়োজন নেই। ছোট এক কামরার ঘরেই তোমার হয়ে যাবে। এখানে খুঁজলে তুমি অবশ্য বড় বাড়িও পেয়ে যাবে। তবে বড় বাড়ি তোমার মনে হয় না খুব একটা প্রয়োজন। তাছাড়া বড় বাড়ির ভাড়াও বেশি পড়বে। তুমি নবীনদার সঙ্গে কথা বলে দেখো। নবীনদারন্ত যদি বাড়ি খালি থাকে, তোমার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। না হলে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।"
- "নবীনদাকে আমি চিনি না। তুমি একটু কথা বলে দেবে?"
- "এক্ষুনি কথা বলে দিচ্ছি। এসো আমার সঙ্গে।"
শ্যামল অরূপকে নিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে নবীন বাবুর সঙ্গে অরূপের আলাপ করিয়ে দেয়। নবীন ব্যানার্জি বয়স্ক মানুষ। তার তিন মেয়ে, ছেলে নেই। অবসরের কাছাকাছি চলে এসেছেন। অফিস থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে তার বাড়ি। ছাপোষা মানুষ, রোজগার করে যেটুকু টাকা জমাতে পেরেছেন তার অনেকটাই খরচ হয় গেছে বড় দুই মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে। ছোট মেয়ে জয়ী কলেজে পড়ে। এবারে তাকেও পাত্রস্থ করতে হবে। সেইজন্য ভেবে চিন্তে হিসাব করে সংসার চালান। একটু একটু করে টাকা জমাচ্ছেন। নবীন বাবু সাত্বিক ব্রাহ্মণ। আজন্ম নিরামিষাশী। প্রতিদিন জপ আহ্নিক না করে অন্নজল গ্রহণ করেন না। বড় দুই মেয়েকে কুলীন ব্রাহ্মণ ঘরে বিয়ের দিয়েছেন। ছোট মেয়েটির বিয়েও দেখে শুনে সেই রকম কোনও উচ্চ বংশের সন্তানের সঙ্গে দেবেন বলে মনস্থির করে রেখেছেন। তবে ছোট মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে তিনি কিছুটা হলেও চিন্তিত। চিন্তার একটাই কারণ টাকা। নিজের পছন্দ মত কুলীন ঘরের পাত্র পেতে হলে আজকের দিনেও খরচ খরচা বেশ ভালই হয়। পণপ্রথা নিয়ে এত আন্দোলন, এত প্রচার, এত আইনের ব্যবস্থা হলেও পুরোপুরি পণপ্রথা এখনও সমাজ থেকে উঠে যায়নি। বরং কোথাও কোথাও যেন আরও জাঁকিয়ে বসেছে। বাড়ি ভাড়ার কথা বলতে নবীন বাবু অরূপকে জানালেন যে তার একটা এক কামরার ঘর কিছুদিন হল খালি হয়েছে। তিনিও ভাড়াটে খোঁজা শুরু করেছেন।
বললেন, "আমরা সহকর্মী হতে চলেছি। এক অফিসে একসঙ্গে দুজনে কাজ করব। আমাদের মধ্যে বোঝাপড়া এমনিতেই তৈরি হয়ে যাবে। তাই আপনাকে ভাড়াটে হিসেবে পেলে আমার সুবিধাই হবে।"
- "আমাকে আর 'আপনি' বলবেন না নবীনদা। আমি প্রায় আপনার ছেলের বয়সী।"
- "ঠিক ঠিক। আমার ছেলে না থাকলেও তুমি আমার বড় মেয়ের বয়সী। তোমাকে আমি তাহলে তুমি বলে ডাকব। তুমি অবশ্য আমাকে 'নবীনদা' বলে ডেকো। অফিসে এসে কাকা জ্যাঠা সম্মোধনটা ঠিক ভালো লাগে না।" নবীন বাবুর কথা শুনে অরূপ শ্যামল দুজনেই হেসে ওঠে। "কিন্তু অরূপ, আমার বাড়ি এই অফিস থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে। অটোতে আসতে আমার অনেক টাকা খরচ হয়। সেইসঙ্গে কিছুটা হাঁটতেও হয়। এ ব্যাপারে তোমার কোনও অসুবিধা হবে না তো?"
- "তেমন অসুবিধা হবে না। আমার একটা মোটর বাইক আছে। সেটা না হয় এখানে নিয়ে আসব। আপনাকেও তাহলে আর রোজ অটোতে চড়তে হবে না।"
- "সে তো ভালই হবে। তাহলে চলো ঘরটা দেখে আসবে। ভাড়া নেওয়ার আগে দেখা দরকার। পছন্দ অপছন্দের একটা ব্যাপার আছে। এবারে আধঘন্টার টিফিনের ব্রেক হবে। এরমধ্যে আমরা দেখে আসি।" নবীন বাবু অরূপকে নিয়ে বেরিয়ে যান। অন্যান্য কলিগদের বলে যান যে ফিরতে একটু দেরি হতে পারে, তারা যেন সামলে নেয়। সেইসঙ্গে তার স্ত্রীকে ফোন করে জানিয়ে দেন যে তিনি একজনকে নিয়ে ঘর দেখাতে যাচ্ছেন। ঘর দেখে মোটামুটি ভালো লাগে অরূপের। ভাড়ার ব্যাপারে কথাবার্তা বলে নেয়। নবীন বাবুর স্ত্রীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বাড়ি দেখার পর তারা নবীন বাবুর ঘরে আসে। নবীন বাবুর স্ত্রী আগে থেকেই রান্না করে রেখেছিলেন। তিনি কিছুতেই অরূপকে না খাইয়ে ছাড়বেন না। অগত্যা অরূপকে বসতেই হয় ডাইনিং টেবিলে।
- "বৌদি আমার মা বেশ কয়েক বছর আগে গত হয়েছেন। আজ মনে হল অনেকদিন পর যেন মায়ের হাতের রান্না খেলাম। সত্যিই পেটের সঙ্গে মন ভরে গেল।"
- "ঠিক আছে, এবারেতো এখানেই থাকবে। মাঝে মাঝে আমার রান্না খেয়ে দেখবে।"
নবীন বাবু ঘড়ির দিকে তাকান। ভাবেন আর সময় নষ্ট করা যাবে না। তাহলে অফিসে পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। বেরিয়ে পড়েন তারা। বের হওয়ার আগে নবীন বাবুর স্ত্রী অরূপকে বলেন, "আজ একজনের সঙ্গে দেখা হল না। আমার ছোট মেয়ে জয়ী, কলেজে গেছে। কলেজ করে, প্রাইভেট পড়ে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাবে। রোজ অবশ্য দেরি হয় না। সপ্তাহে একদিন দেরি হয়। সেদিন আমি একটু চিন্তায় থাকি। মেয়ে ঘরে ফিরলে নিশ্চিন্ত হই।"
- "আজ আপনার মেয়ের সঙ্গে আলাপ হল না। পরে নিশ্চয়ই হবে।"
- "সে তো হবেই। পাশাপাশি বাড়িতে থাকলে দেখা সাক্ষাৎ আলাপ পরিচয় হবে।"
পরের মাসে অরূপ নতুন চাকরিতে যোগ দেয়। সেইসঙ্গে চলে আসে নবীন বাবুর ভাড়া বাড়িতে। ভাড়া বাড়িতে অরূপ নিজেই রান্না করে খায়। খুব সকালে তাকে ঘুম থেকে উঠে রান্না করতে হয়। তারপর সাড়ে নটা নাগাদ সে বেরিয়ে পড়ে তার অফিসের উদ্দেশ্যে। নবীন বাবুও অটোর বদলে অরূপের বাইকে চড়ে প্রতিদিন অফিসে যাতায়াত করেন। অটোর ভাড়াটা বেঁচে যায়। এমন এক ভাড়াটেকে পেয়ে তিনি বেজায় খুশি। নবীন বাবুর স্ত্রী মাঝে মাঝে অরূপের খোঁজ খবর নেন। কোনও কিছু অসুবিধা হচ্ছে কিনা জানতে চান। নবীন বাবুর ছোট মেয়েকে অরূপ দু একবার দেখতে পেলেও, তার সঙ্গে অরূপের এখনও আলাপ হয়নি। কলেজ যাওয়া, পড়তে যাওয়া ছাড়া নবীন বাবুর ছোট মেয়ে জয়ী খুব একটা বাড়ির বাইরে বের হয় না। সপ্তাহে একদিন তার কলেজের পর প্রাইভেট টিউশনি পড়ে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।
সকালে সময় অল্প, তাই মাঝে মাঝে সন্ধ্যার পর অরূপ অফিস থেকে ফিরে আবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। স্টেশন সংলগ্ন বাজার থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কাঁচা আনাজ এবং রান্নার অন্যান্য জিনিস সে সন্ধ্যার পর কেনাকাটা করে। রাতেই সে রান্নার জন্য শাকসবজি, আনাজ কেটে রাখে। সকাল হতে না হতেই রান্না চাপিয়ে দেয়।
- "ম্যাডাম, শুনছেন।" ঘুরে তাকায় জয়ী। দেখে তাদের নতুন ভাড়াটিয়া তাকে ডাকছে।
- "আমি এখন বাড়ি যাব। অটোর জন্য লম্বা লাইনে না দাঁড়িয়ে আপনি আমার সঙ্গে যেতে পারেন।"
- "যেতে পারি, কিন্তু..."।
- "কিন্তু কি?"
- "আমি এর আগে কারও বাইকে উঠিনি। তাই ভয় করছে।"
- "ঠিক আছে, উঠে আসুন খুব আস্তে চালাব।"
- "আসতে চালাবেনতো?"
- "কোনও ভয় নেই। খুব আস্তে চালাব।"
- "তবুও ভয় লাগছে। যদি আস্তে চালাতে গিয়ে ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যান! আমিওতো পড়ে যাব। খুব চোট লাগবে।"
জয়ীর কথা শুনে হেসে ফেলে অরূপ। বলে, "আমি খুব খারাপ ড্রাইভার নই ম্যাডাম। এখন আমার কাছে বাইক চালানোর সার্টিফিকেট নেই। বাড়িতে চলুন, আপনার বাবা রোজ আমার বাইকে চড়েন। ওনার থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে আপনাকে দেখাব।"
বাইকে উঠে পড়ে জয়ী। বাইকে বসে প্রশ্ন করে, "কিছু ধরার জায়গা নেই?"
- "আছেতো। পুলিশ যেভাবে চোরের কলার ধরে টেনে নিয়ে যায়। আপনিও সেভাবে আমার জামার কলারটা ধরুন।"
- "ঠিক আছে। তবে খুব আস্তে চালাবেন। আমার সত্যিই খুব ভয় করছে।" পুরো রাস্তাটা জয়ী প্রায় দম বন্ধ করে বাইকে বসেছিল। বাড়ির সামনে এসে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে, "আপনি ভালোই গাড়ি চালান। আমি একটুও টলমল করিনি। অকারণে ভয় পাচ্ছিলাম।"
- "প্রথমবার বাইক চড়াটা আপনার কাছে রীতিমতো একটা অ্যাডভেঞ্চার হল।"
- "সত্যিই বাইকে উঠে প্রথমে খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। এখন মনে হচ্ছে তেমন ভয়ের কিছু নেই বরং বেশ মজাই লাগল। মাঝে মাঝে চড়ব আপনার বাইকে। মাকেও চড়াব।"
সন্ধ্যার পর অরূপ নিজের ঘরে বসে টিভি দেখছে। এমন সময় দরজায় টোকা। উঠে গিয়ে সে দরজা খোলে। নবীন বাবুর স্ত্রী এসেছেন। হাতে একটা বাটি। তার পেছনে জয়ী।
- "আজ ফ্রাইড রাইস করেছিলাম। ভাবছিলাম তুমি কখন বাড়ি ফিরবে।"
- "আমি যে বাড়ি ছেড়ে এত দূরে একা আছি। আপনার জন্য সে কথা বুঝতেই পারিনা।"
অরূপের কথার মাঝেই জয়ী বলে, "জানো মা, আজ একটা এডভেঞ্চার হল। আমি স্টেশন থেকে অরূপের বাইকের চড়ে বাড়ি ফিরেছি। যতক্ষণ বাইকে বসে ছিলাম, কি ভয় করছিল! যখন নামলাম তখন মনে হল ভয়ের কিছুই নেই। তুমি একদিন চড়বে অরূপের বাইকে?"
- "না বাবা, আমার দরকার নেই। তারপর পড়ে গিয়ে বুড়ো বয়সে হাত পা ভাঙব?"
- "ঠিক করে বসলে পড়ে যাওয়ার কোনও চান্স নেই। তুমি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছ। প্রথমে আমিও ভয় পেয়েছিলাম। তারপর বেশ মজা লাগল। কি রকম হুশ করে চলে এলাম। সত্যি পরের দিকে আমার বেশ মজা লাগছিল। অরূপ তুমি কি রোজ সন্ধ্যাবেলা স্টেশনের দিকে যাও?"
- "রোজ না হলেও, প্রায়ই যাই।"
- "ঠিক আছে, আমি যেদিন পড়ে ফিরব সেদিন অন্তত যাবে। আমি তোমার বাইকে ফিরব। বেশ মজা হবে।"
- "সেইসঙ্গে অটোর ভাড়াটাও বাঁচবে। ওই টাকায় ফুচকা খাব। সত্যি কি ধান্দাবাজ আজকালকার মেয়েগুলো!" ফোড়ন কাটেন নবীন বাবু স্ত্রী।
নবীন বাবুর স্ত্রীর কথাগুলো শুনে হেসে ওঠে অরূপ। বলে, "এতে অসুবিধের কিছু নেই। এমনিতেই আমাকে সপ্তাহে তিন চার দিন বাজার করতে যেতে হয়। জয়ী পড়তে যাওয়ার দিন আমি বাজার করতে যাব। তাহলে আমিও ফুচকার ভাগ পাব।"
কেবল পড়ে ফেরার দিন নয়। মাঝে মাঝেই জয়ীকে অরূপের বাইকে চেপে ঘুরতে দেখা যায়। সেইসঙ্গে স্টেশন চত্বরে গজিয়ে ওটা নতুন রেস্টুরেন্টে আড্ডাও চলে।
- "অরূপ তুমিতো আমার বাবাকে নবীন দা বলো। মাকে বৌদি বলো। তাহলে তোমাকে আমার কাকা বলা উচিত।"
- "এই না, একদম নয়। কখনো আমাকে কাকা বলে ডাকবে না।"
- "কাকা নয়। তাহলে কি বলব?"
- "জ্যাঠা।"
- "এই ফোট এখান থেকে। এইটুকু ছেলেকে জ্যাঠা বলতে হবে! মামার বাড়ির আবদার।"
- "তাহলে যা বলছ, তাই বলো। 'হ্যাঁগো', 'ওগো' করে চালিয়ে যাও।"
- "এই অরূপ বলো না, কবে সত্যি সত্যি 'হ্যাঁগো', 'ওগো' বলে ডাকব?"
- "জানি জানি সব জানি। প্রথম প্রথম সবাই সোহাগ করে মিষ্টি সুরে 'হ্যাঁগো', 'ওগো শুনছো' বলে। তারপর যখন পুরানো হয়ে যাব, তখন 'মুখ পোড়া মিনষে' বলে ডাকবে।"
- "ধ্যাৎ! ওসব বুড়ো বুড়িরা বলে।"
- "তুমি কি কোনও দিন বুড়ি হবে না? চিরদিন একরকম থাকবে?"
- "কি রকম?"
- "এই যে রকম আছো। সুন্দরী, সেক্সি।"
- "এক চড় মারব। খালি উল্টোপাল্টা কথা।"
- "কেন? উল্টোপাল্টা কেন? যখন তুমি আমার বাইকে চড়ে যাও, তোমাদের পাড়ার ছেলেরা করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে! হয়তো ভাবে...।"
- "কিভাবে?"
- "ভাবে, কোন ধ্যাড় ধাড়ে গোবিন্দপুর থেকে এসে পাড়ার এক নম্বর মালটাকে তুলে নিল! আর আমরা পাড়ায় থেকে ইয়ে ছিঁড়লাম।"
- "আবার আজে বাজে কথা। তবে আমাদের বিয়েতে খুব ঝামেলা হবে। সেই ঝামেলা সামলানো খুব মুশকিল হয়ে উঠবে। আমি খালি ভাবি কি করে আমাদের সম্পর্কের কথাটা বাড়িতে বলব!"
- "কেন? না বলার কি আছে?"
- "তুমি দাস, মাহিষ্য। আমরা বামুন। বাবা মেনে নেবে না আমাদের সম্পর্কটা।"
- "ধুর, আজকের দিনে কেউ ওসব নিয়ে মাথা ঘামায় না।"
- "তুমি আমার বাবাকে চেনো না, তাই এ কথা বলছ। আমার বাবা হচ্ছে গোঁড়া বামুন। মাছ মাংসের ধার মাড়ায় না। দিনে তিনবার পুজো আর্চা করে। কপালে চন্দনের তিলক কাটে। সেই লোক অসবর্ণ বিয়ে মানবে?"
অফিসের লোকজনদের বলব তোমার বাবাকে বোঝাতে। এমনকি এমডিকে বলব। এমডি এখন আমার হাতে আছে। মানে আমার কাজে খুব সন্তুষ্ট। আমাকে ক্যাশ হ্যান্ডেল করতে হয়। আগে অনেক বেহিসেবী খরচ হত। সেগুলোকে আটকে দিয়েছি। অনেক টেন্ডারে জালিয়াতি, কারচুপি হত। সেগুলো সব বন্ধ করে দিয়েছি। এরজন্য অবশ্য অফিসের অনেকেই আমার উপর রেগে আছে। কিন্তু আমার কাজে কোম্পানির এমডির পুরোপুরি মদত আছে। এমডি আমাকে বলেছেন এভাবে চালিয়ে যেতে। বাজে খরচ, অপচয় আটকাতে। যেখানে এমডি আমার ফেভারে আছে, সেখানে কোন কলিগ আমার এগেনস্টে গেল, না গেল তাতে আমার কিছু আসে যায় না। এমডি মানে কোম্পানির মালিকের কথাই শেষ কথা। সেরকম প্রয়োজন হলে এমডিকে বলব তোমার বাবাকে বোঝাতে যে এইসব পুরানো ধ্যান ধারণার কোনও মূল্য নেই আজকের দিনে।"
- "তবে আমার বাবা যা রাগী আর গোঁয়ার! এমনিতে ভালো, কিন্তু রেগে গেলে আর দেখতে হবে না। একেবারে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে ছাড়বে। ওসব এমডি ফেমডি কাউকে মানবে না। এইসব লোকেদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা খুব কঠিন।"
- "দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। কোনও ঝামেলা হবে না। তাছাড়া তোমার বাবার বয়স বাড়ছে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সবারই গরম রক্ত ঠান্ডা হয়ে যায়। অত চিন্তা করার কিছু নেই। পরীক্ষাটা ভালোভাবে দাও। তোমাকে কিছু বলতে হবে না। যা বলার আমি বলব।"
ব্যাপারটা নবীন বাবুরও চোখে পড়েছে। জয়ী কেবল টিউশনি পড়ে ফেরার পরেই অরূপের মোটরসাইকেলে চড়ে বাড়ি ফেরে না। মাঝে মাঝে সন্ধ্যার সময় তাদের দুজনকে বাইকে চড়ে ঘুরতে দেখা যায়। পাড়া প্রতিবেশীদেরও নজরে পড়েছে ব্যাপারটা। অনেকেরই দৃষ্টিকটু লাগছে, কিন্তু কেউ ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামায় না। তবে পাড়ার বিলাস বাবু একদিন নবীন বাবুকে ডেকে বললেন, "নবীন তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে।"
- "বলুন বিলাস দা।"
- "ইদানিং তোমার মেয়েকে দেখছি তোমাদের নতুন ভাড়াটের সঙ্গে উড়ে বেড়াচ্ছে। তারমানে তোমাদের নতুন ভাড়াটে কি তোমার ছোট জামাই হচ্ছে?"
- "আরে না না, ওসব কিছু নয়। জয়ী টিউশনি পড়ে ফেরার পথে মাঝে মাঝে অরূপের বাইকে ফেরে। অটোর ভাড়াটা বেঁচে যায়। তাই আমি বাধা দিই না।" কথাটা বলে হেসে ওঠেন নবীন বাবু।
- "কেবল অটোর ভাড়া কেন, এখন দেখে শুনে মেয়ের বিয়ে দেওয়া মানে লাখ লাখ টাকার খরচ। হয়তো দেখবে তোমার সেই খরচটাও বেঁচে যাবে।"
- "বিলাস দা, আমরা কুলীন ব্রাহ্মণ। অরূপরা দাস, মাহিষ্য। আমি মরে গেলেও এসব মেনে নেব না।"
- "যদি ওরা বিয়ে করবে বলে মনস্থির করে। তখন তুমি কি করবে?"
- "ব্যাপারটা একটু আঁচ পেয়েই আমি ব্যবস্থা করে রেখেছি। ঘোরাফেরা করছে করুক, তবে অরুপ যদি বামুন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর চেষ্টা করে, তাহলে আমার হাত থেকে রেহাই পাবে না।"
- "কি করবে তুমি? মানে কি করতে পারবে? একটা এডাল্ট ছেলে, আর একটা এডাল্ট মেয়ে যদি বিয়ে করবে বলে মনস্থির করে, তাহলে তোমার কিছু করার নেই।"
- "আছে বিলাসদা, সব ব্যবস্থা করা আছে।" কথা বলতে বলতে নবীন বাবু তার পকেট থেকে কিছু একটা বের করে বিলাস বাবুকে দেখান।
জয়ীর পরীক্ষা শেষ হয়েছে। নবীন বাবুও মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করেছেন। পাত্র দেখাশোনা শুরু করেছেন। প্রথমে জয়ী চুপচাপ থাকলেও, একদিন সে তার মাকে সব খুলে বলে।
- "মা এভাবে আমাকে সাজিয়ে গুজিয়ে আর পাত্রপক্ষের সামনে বসাবে না। আমার একদম ভালো লাগেনা। আমি একজন শিক্ষিত মেয়ে। এইভাবে পাত্রপক্ষের সামনে রঙ মেখে নিজেকে দেখানোটা আমার খুব অপমানজনক মনে হয়।"
- "তাহলে কিভাবে তোকে দেখাব?"
- "দেখাতে হবে না। যখন আমার ইচ্ছা হবে, তখন বিয়ে করব।"
- "তার মানে?"
- "তার মানে।" ক্ষণিক চুপ করে থেকে জয়ী বলে, "আমি অরূপকে ভালোবাসি মা। আমি অরূপকে বিয়ে করব।"
- "চুপ কর বেয়াদব মেয়ে। তোর বাবা শুনতে পেলে তোকে কেটে ফেলবে।"
- "সে যা করার করবে। আমি অরূপকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করতে পারব না।"
সেই রাতেই নবীন বাবু তার স্ত্রীর মুখে সব শুনে প্রথমে রেগে গেলেও, মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে চুপ করে যান। পরবর্তী পদক্ষেপের পরিকল্পনা করতে থাকেন।
বেশ সমস্যায় পড়ে গেছে অরূপ। এতদিন ধরে কাজ করছে, কোনও দিন এরকম ভুল তার হয়নি। কিন্তু এবারে যে কিভাবে হল, সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছে না! বরাবরই সে দক্ষতার সঙ্গে ক্যাশ হ্যান্ডেল করে। কিন্তু এবারে কি করে এত বড় ভুল হল কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না! প্রায় লাখ খানেক টাকার হিসেব মিলছে না! কোথায় গেল এতগুলো টাকা? কাকে দিল সে? কিছুই মনে পড়ছে না! সে তো অফিসের বিশেষ আলমারিতেই টাকাগুলো রেখেছিল। সেই আলমারির চাবি তার কাছেই থাকে। তাহলে টাকাগুলো গেল কোথায়? এত আর্থিক তছরূপ। খবর যায় থানায়। পুলিশ আসে। তদন্ত হয়। কিন্তু অরূপ পুলিশের জেরায় কিছুই ঠিক করে বলতে পারে না!
খবরটা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে জয়ীর। কি করবে সে বুঝতে পারে না। কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। তার মা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, "অন্যের অপরাধের ফল তুই ভোগ করছিস কেন? যে অপরাধ করেছে সে তো শাস্তি পাবেই।"
- "না মা, না, অরূপ অপরাধী নয়। যে কদিন আমি ওর সঙ্গে মিশেছি, তারমধ্যেই আমি বুঝতে পেরেছি অরূপ অত্যন্ত নির্লোভ, সৎ ছেলে। কাজের জায়গা নিয়ে ওর মনে কত উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে সেটা আমি জানি। ও এরকম বোকার মত টাকা সরানোর ছেলে নয়। আমার বিশ্বাস এরমধ্যে কোনও চক্রান্ত রয়েছে। নিশ্চয়ই রয়েছে, না হলে এসব হতে পারে না।"
এখন সে কি করবে, কি করা উচিত, অরূপের মুক্তির জন্য কার সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত, কোনও কিছু স্থির করতে পারে না জয়ী। সারাদিন সে ঘরে বসে থাকে, ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে অরূপের জন্য।
- "শোনো জয়ীর মা, আর আমি অপেক্ষা করব না। এবারে জয়ীর বিয়ে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হব। আর কোনও দিন কোনও চ্যাংড়া ছেলেকে বাড়ি ভাড়া দেব না। কেবল মাত্র পুরো সংসার ভাড়া চাইলে, তবেই ভাড়া দেব।"
- "মেয়ের বিয়ে দেবে বলছ। কিন্তু অত টাকা জোগাড় হয়েছে?"
- "হয়ে গেছে। টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। সব টাকা আমি ব্যাঙ্ক থেকে তুলে এনে আলমারিতে রেখেছি। দিনকাল ভালো নয়, চারিদিকে টাকা তছরূপের কেলেঙ্কারি ঘটছে। আমাদের অফিসে যা কোনও দিন ঘটেনি, এবার সেটা ঘটল। কাউকে বিশ্বাস নেই। এমনকি ব্যাঙ্কেও বিশ্বাস নেই। ব্যাঙ্কে যদি টাকা চুরি হয়, তখন কি হবে? আমি গরিব মানুষ, টাকার জন্য কার কাছে যাব? ব্যাঙ্কে যা টাকা ছিল সব তুলে এনেছি। এতে জয়ীর ভালোভাবে বিয়ে হয়ে গিয়ে, হাতে বেশ কিছু টাকা থেকে যাবে।"
ঘরের ভেতরে থাকা জয়ীর কানে যায় তার বাবার কথাগুলো। শুনে অবাক হয় সে। তার বাবা সারাদিন অফিসে ব্যস্ত থাকেন বলে ব্যাঙ্কের কাজ জয়ী করে। ব্যাঙ্কে টাকা জমা করা, টাকা তোলা, পাস বই আপডেট করা সব কাজ সে করে। সে ভালোভাবে জানে তার বাবার ব্যাঙ্কের খাতায় ত্রিশ হাজারের মতো টাকা আছে। এই সামান্য টাকায় তার বাবা তার বিয়ে দেবে! তারপরেও হাতে টাকা থাকবে! কেমন যেন একটা খটকা লাগে জয়ীর মনে। সে বুঝতে পারে কিছু একটা গোলমাল রয়েছে পুরো ব্যাপারটার মধ্যে। সবকিছু তাকে ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। সত্যিটা সামনে আনতে হবে। কিন্তু এখন কিছু করা যাবে না। সে অপেক্ষা করতে থাকে।
মধ্যরাত। অনেক আগেই সকলে রাতের খাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু জয়ীর চোখে ঘুম নেই। সে অপেক্ষা করছে। পাশের ঘর থেকে তার বাবার নাক ডাকার শব্দ আসতে শুরু করেছে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই তার মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। উঠে পড়ে জয়ী, অতি সন্তর্পনে সে গিয়ে ঢোকে তার বাবার ঘরে। দেখে নেয় তার মা ঘুমিয়েছেন কিনা। নিশ্চিত হওয়ার পর সে আলমারি খোলে। আলমারি খুলে সে দেখতে পায় একটা তাকে বান্ডিল বান্ডিল টাকা রাখা আছে। এত টাকা! এত টাকাতো তার বাবার ব্যাঙ্কে ছিল না! তাহলে কোথা থেকে এল? আলমারিটা খুঁটিয়ে দেখে সে। দেখে একটা চাবিও পড়ে আছে টাকার বান্ডিলের পাশে। ওটা কি? হাতে তুলে নেয় জয়ী। একটা শুকনো সাবান, তার উপর একটা চাবির ছাপ। ক্রমশ সবকিছু পরিষ্কার হতে থাকে তার কাছে। পুরো চক্রান্তটাই তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সে বুঝতে পারে অরূপের সরলতার সুযোগ নিয়ে তার বাবা অফিসের আলমারির চাবির নকল বানিয়ে এই কাজ করেছেন। এত নিচে তার বাবা যে নামতে পারেন, সে কথা ভেবে তার বাবার প্রতি তীব্র ঘৃণায় তার মনটা ভরে ওঠে। তবে সে ছাড়বে না। একটা নিরাপরাধ ছেলেকে সে বিনা দোষে জেল খাটতে দেবে না। তারপর সব কিছু জেনে অরূপ তাকে গ্রহণ করবে নাকি চিরতরে পরিত্যাগ করবে সেসব নিয়ে সে ভাবতে চায় না। তবে রাত পোহালে সে একটা হেস্তনেস্ত করবে। রাতেই সে একটা ব্যাগে সমস্ত টাকা, চাবি, সাবান ভরে রাখে। সকাল হলেই সে অফিসের মালিকের বাড়ি যাবে বলে ঠিক করে।
দেখতে দেখতে রাত কেটে ভোর হয়। সূর্যের প্রথম কিরণ পৃথিবীর মাটি ছোঁয়ার অনেক আগেই বিছানা ছেড়েছে জয়ী। পুরানো রাতকে দূরে সরিয়ে সামনে এসেছে নতুন ভোর। এরমধ্যে কিছুটা সময় অতিবাহিত হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে জয়ীর মনে জ্বলে ওঠা আগুন অনেকটা স্তিমিত হয়েছে। যদিও অরূপের জন্য তার মন খুবই ভারাক্রান্ত। এরকম অন্যায়ভাবে অরূপের জেল খাটা সে দেখতে পারবে না। আবার অরূপকে মুক্ত করতে গেলে সত্য উদঘাটন করতে হবে। সেটা করতে গেলে তার বাবার হাতে দড়ি পড়বে। সেটা কি সে সহ্য করতে পারবে? সেই মানসিক শক্তি কি জয়ীর আছে? না নেই। সে পারবে না। তার বাবার জেল হাজত সে দেখতে পারবে না। সহ্য করতে পারবে না। এখন কি করবে জয়ী? কি করা উচিত! ভাবতে থাকে সে। ভাবতেই থাকে। কিন্তু কোনও উত্তর, কোনও সমাধান সে খুঁজে পায় না।
অন্যান্য দিন বিভিন্ন কাজ সেরে দুপুরের পর অফিসে আসেন সৌমেন সেনগুপ্ত। কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর তথা মালিক সৌমেন বাবুর অফিসে এসে বসা ছাড়া আরও অনেক কাজ রয়েছে। সেইজন্য অফিসে আসতে তার বেশ দেরি হয়। কিন্তু আজ সকালেই অফিসে এসে গেছেন। অফিসে এসে তলব করেন নবীন বাবুকে।
ইদানিং সব সময় একটা খুশি খুশি ভাব দেখা যায় নবীন বাবুর মধ্যে। যেন এক যুদ্ধ জয়ের দামামা বেজে চলেছে তার মনের মাঝে। আর বাজবে নাইবা কেন? অনেক ভেবে চিন্তে বুদ্ধি খাটিয়ে বিদায় করতে পেরেছেন আপদটাকে। না হলে জাত, মান, কুল সব খোয়া যেত। খুব জোর বেঁচে গেছেন এই যাত্রায়। নবীন বাবু ঠিক করেছেন এবারে খুব ভেবে চিন্তে বাড়ি ভাড়া দেবেন। অবশ্য জয়ীর বিয়ে হয়ে গেলে আর ওসব চিন্তা থাকবে না। এমডির তলব পেয়ে তার ঘরে আসেন নবীন বাবু।
- "নবীন বাবু, আপনি এই অফিসের সব থেকে সিনিয়র স্টাফ। তাই বেশিরভাগ ব্যাপারে আপনার সঙ্গে আলোচনা করি। আজ আমি সকালে অফিসে এসেছি। তবে এক্ষুনি বেরিয়ে যাব। একটা বিয়ের ব্যাপারে ব্যস্ত আছি। মানে আমার কন্যাসমা একজনের বিয়ে দিচ্ছি।"
- "ভালো ভালো, খুব ভালো।" পুরো কথা না শুনেই মন্তব্য করেন খুশিতে ডগমগ করতে থাকা নবীন বাবু।
- "তবে এই বিয়েতে একটা সমস্যা আছে। মানে মেয়ের বাড়ির অমতে, বিশেষ করে মেয়ের বাবার অমতে এই বিয়ে হচ্ছে। অসবর্ণ বিয়েতে মেয়ের বাবার ঘোরতর আপত্তি। নবীন বাবু, আপনি বলুনতো আজকের দিনে এইসব বস্তা পচা চিন্তাভাবনার কোনও মূল্য আছে?"
কি যেন বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেন নবীন বাবু। তিনি জানেন বেসরকারি ক্ষেত্রে কাজ করার অনেক হ্যাপা। এখানে সব সময় মালিকের মন যুগিয়ে চলতে হয়। মালিকের কথাই এক্ষেত্রে শেষ কথা। বরাবর সেভাবেই চলার চেষ্টা করে এসেছেন। আর আজ তিনি কেন ভিন্ন মত পোষণ করে মালিকের বিরাগ ভাজন হবেন? এমডিকে সমর্থন করে নবীন বাবু বলেন, "ঠিকই তো, আজকের দিনে এসবের কোনও মানে নেই, যুক্তি নেই। এসব নিয়ে মাথা ঘামানো মানে ক্রমশ পিছিয়ে যাওয়া। আজকাল হাজার হাজার অসবর্ণ বিয়ে হচ্ছে। বামুনের ছেলে মেথরের মেয়েকে বিয়ে করছে। মুচির মেয়ে কায়েতের ছেলেকে বিয়ে করছে। এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।" বলতে থাকেন নবীন বাবু। ধৈর্য সহকারে শুনতে থাকেন সৌমেন বাবু, "ওসব জাতপাত সব বাজে কথা। আসল কথা হল মানুষ..."।
- "সত্যি নবীন বাবু আপনার মত কনসিডারেট ব্যক্তিত্ব আমি খুব কম দেখেছি। আপনি সব সময় যুক্তির উপর চলেন। আপনার মত চিন্তা ভাবনা যদি সবার মধ্যে থাকতো তাহলে দেশের চেহারা অন্যরকম হত।"
মালিকের কথায় অতি উৎসাহিত হয়ে নবীন বাবু আবার বলতে শুরু করেন, "সেই জন্যইতো বলছি স্যার, আসল কথা হল মানুষ। সেই কোন যুগে আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট বিয়াস নদী পার হতে হতে তার প্রধান সেনাপতি সেলুকাস কে বলেছিল - 'এট টু ব্রুটাস' যার বাংলা মানে সবার উপরে মানুষ সত্য। আর মানুষের উপরে....।" উৎসাহের আতিশয্যে নবীন বাবু কথা বলতে বলতে খেই হারিয়ে ফেলছেন। একেতো অরূপ জেলে গেছে। তার উপর অফিসের মালিক তাকে এতটা প্রাধান্য দিয়ে কথা বলছেন! দুটো আনন্দের ধাক্কায় নবীন বাবু একেবারে বেসামাল হয়ে গেছেন। কি বলতে কি বলছেন, নিজেই বুঝে উঠতে পারছেন না। সবকিছু পুরোপুরি তালগোল পাকিয়ে ফেলছেন তিনি। সবকিছু তার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।
- "ব্যাস ব্যাস, আর বলতে হবে না। ইতিহাস আর সাহিত্যে আপনার প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের কথা আমরা সবাই খুব ভালোভাবে জানি। তবে আমার মত সাধারন মানুষের মাথায় এত ভারী ভারী কথা ঢুকবে না। যাইহোক কালকে আপনাকে আর অফিসে আসতে হবে না। কালকে আপনি সারাদিন আমার সাথে বিয়ে বাড়িতে থাকবেন, আমার এক নম্বর হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে। আর একটা ব্যাপার, মেয়ের পরিবারের কেউ থাকবে না। ব্যাপারটা খুব দৃষ্টিকটু, তাই আপনাকে মেয়ের কাকা, মামা, জ্যাঠা কিছু একটা বলে পাত্রপক্ষের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। তাহলে মান সম্মান বজায় থাকবে। তাছাড়া সবকিছুইতো একদিনের ব্যাপার। তারপর কে আপনার খোঁজ নিতে আসবে? আপনার আপত্তি নেই তো?"
- "আপনি স্যার যেটা ভালো বুঝবেন, সেটাই করবেন। এতে আমার আপত্তি কেন থাকবে?"
- "থ্যাঙ্ক ইউ। কাল সকালে আমার বাড়িতে চলে আসবেন। তারপর আমরা একসঙ্গে বিয়ে বাড়িতে যাব।"
- "ঠিক আছে স্যার।"
- "দেরি করবেন না যেন।"
পরের দিন সকালে এক রাশ খুশি, এক রাশ আনন্দসহ নবীন বাবু পৌঁছে যান সৌমেন বাবুর বাড়ি। সৌমেন বাবু বসতে বলেন নবীন বাবুকে। অনেকক্ষণ বসে আছেন নবীন বাবু। বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে সৌমেন বাবু যেন কিছুটা বেশি সময় নিচ্ছেন। ক্রমশ ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে নবীন বাবুর। কিন্তু তিনি ধৈর্য ধরে একই জায়গায় বসে আছেন। এছাড়া এই মুহূর্তে আর কিছু করার নেই তার। বেশ কিছুক্ষণ পর বিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন তারা। কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যান বিয়ে বাড়িতে। বাড়িতে ঢোকার মুখে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছেন। সৌমেন বাবুকে দেখে তারা এগিয়ে আসেন।
সৌমেন বাবু তাদের নবীন বাবুকে দেখিয়ে বলেন, "ইনি নবীন বাবু, পাত্রীর বাবা।"
একটু চমকে ওঠেন নবীন বাবু। ফিসফিস করে সৌমেন বাবুকে বলেন, "মামা, জ্যাঠা, কাকা অব্দি ঠিক ছিল। একেবারে মেয়ের বাবা বানিয়ে দিলেন আমাকে!"
- "উত্তেজনায় মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। বাদ দিন ওসব কথা। চলুন, ভেতরে চলুন।"
যেতে যেতে সৌমেন বাবু নবীন বাবুকে বলেন, "ওই ঘরে বর বসে আছে। চলুন ওদিকে যাই।"
বরের ঘরে ঢুকে ভূত দেখার মত চমকে ওঠেন নবীন বাবু, "অরূপ! স্যার এরতো জেলে থাকার কথা!"
- "গতকাল ছাড়া পেয়েছে। ছাড়া পেয়েই ব্যাটা বিয়ে করতে চলে এসেছে! ছাড়ুন একে। চলুন ওদিকে যাই। ওদিকে কনে আছে, কনের মা আছে। সবার সঙ্গে কথা বলি।"
দুরু দুরু বুকে যেতে থাকেন নবীন বাবু। তিনি যা আশঙ্কা করেছিলেন ঠিক তাই। সেই ঘরে ঢুকে দেখেন জয়ী সেজেগুজে বসে আছে। জয়ীর মাও আছেন!
- "নবীন বাবু আপনি যে অপরাধ করেছেন সেটা সত্যিই শাস্তিযোগ্য। প্রথমে ভেবেছিলাম আপনাকে জেলে পাঠাব। পরে ভেবে দেখলাম শাস্তিতো কেবল অপরাধী একা পায় না। তার পরিবারের অন্যান্যদেরও শাস্তি ভোগ করতে হয়। জয়ীর দিকে তাকিয়ে পারলাম না আপনাকে শাস্তি দিতে। তাছাড়া অপরাধতো আপনি করেননি। অপরাধ করেছে আপনার মনে জমে থাকা কুসংস্কার। তাই শাস্তি দিতে হলে আপনার কুসংস্কারকে শাস্তি দিতে হবে। মানে আপনার মন থেকে আগে কুসংস্কারকে তাড়াতে হবে। কাল সকালে জয়ী আমার বাড়িতে এসে টাকা, চাবি সব দিয়ে বলল যে অরূপকে মুক্ত করতে। সেইসঙ্গে বলল তার বাবা যেন শাস্তি না পায়। কারণ তার জন্য তার বাবা জেলে গেলে সে আর নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবে না। এইটুকু একটা মেয়ের কথা কি করে ইগনর করি বলুন? তাই কাজকর্ম ছেড়ে অরূপের জামিনের ব্যবস্থা করলাম। অরূপের বাড়ির লোকদের বলে বুঝিয়ে বিয়ের ব্যাপারে রাজি করালাম। এবার আপনি সামনের দিকে তাকান। কুসংস্কার মুক্ত হয়ে মেয়ে জামাইকে আশীর্বাদ করে বাড়িতে নিয়ে যান। আমার দায়িত্ব এখানে শেষ। এখান থেকে শুরু আপনার দায়িত্ব। তবে সব সময় মনে রাখবেন ওসব জাতপাত সব কুসংস্কার। সবার উপরে মানুষ সত্য। আপনার আর আলেকজান্ডারের ভাষায় 'এট টু ব্রুটাস' হা হা হা।"
কথা শেষ করে সশব্দে হেসে ওঠেন সৌমেন বাবু। হাসিটা সংক্রামক রোগের মত ঘরে উপস্থিত অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
।। সমাপ্ত ।।
দেবাংশু সরকার
M G.ROAD,
BUDGE BUDGE,
KOLKATA - 700137
Comments
Post a Comment