মিঠুন মুখার্জী
আজ থেকে পঁচিশ বছর আগেকার কথা। আমি তখন সপ্তম শ্রেনীতে পড়ি। আমার স্কুলের নাম ছিল 'লক্ষীপুর স্বামিজী সেবা সংঘ উচ্চ বিদ্যালয়'। দশের মধ্যে না থাকতে পারলেও খুব বেশি রোল ছিল না আমার। কিছু কিছু শিক্ষকদের খুবই স্নেহভাজন ছিলাম আমি। তারা আমাকে খুবই ভালোবাসতেন। তবে কয়েকজন শিক্ষকের প্রতি আমার খুবই ভয় ছিল। শুধু আমি কেন যারা দশের মধ্যে থাকত তারাই ওদের ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকত। আমার তিন বন্ধু ছিল । যাদের সঙ্গে খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল আমার। হীরক, গোবিন্দ ও মৃত্যুঞ্জয়। আমরা প্রত্যেকেই কম-বেশি পড়াশোনা করতাম। তবুও ভয় পেতাম ওই সকল শিক্ষকদের। কোনো ছাত্র পড়া না করে আসলে খুব মারতেন, কেউ দুষ্টুমির জন্য নানান প্রকার শাস্তি দিতেন আবার কোনো স্যার বিনা কারনেও মারতেন। তবে একদম বিনা কারণে বললে ভুল হবে। আচরনে ভদ্র-সভ্যতার ঘাটতি দেখলেও মারতেন।
আমরা চারজন যাদের খুবই স্নেহের ছিলাম তাদের প্রতিমুহূর্তে আমরা সম্মান ও শ্রদ্ধা তো করতামই, আর যাদের ক্লাস করতে ভয় পেতাম তাদেরও ভয়ে হোক কিংবা ভিতর থেকে হোক শ্রদ্ধা-সম্মান করতাম। তখন আমাদের বয়স খুবই অল্প ছিল। তাই বাস্তব হিতাহিত জ্ঞান আমাদের মধ্যে তেমন ছিল না। অন্যান্য বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে আমরাও কখনো কখনো দুষ্টামি করতাম। তারজন্য মারও খেতাম। আমরা মার খেলে মনে করতাম আমাদের শুধরানোর জন্যই তিনি আমাদের মেরেছেন। কিন্তু কিছু ছাত্র ছিল যাদের শিক্ষকেরা মারলে তাদের মুখে মুখে তর্ক করত, লাঠি হাত দিয়ে ধরে ফেলত। ফলে সেই শিক্ষক রেগে গিয়ে তাকে আরও বেশি মারতেন। কেউ কেউ মারার চোটে লাঠি ভেঙে ফেলতেন।
আমার মা সবসময় বলতেন শিক্ষকদের সঙ্গে কখনো খারাপ আচরন করবি না। আমাদের স্কুল জীবনে ভালো - খারাপ সমস্ত ছাত্রদের শিক্ষকের প্রতি কমবেশী শ্রদ্ধা ছিল। যা বলত শিক্ষক ক্লাস ছেড়ে চলে গেলে শিক্ষকের পিছনে। শিক্ষকদের সামনে দাঁড়িয়ে কটু কথা বলার সাহস কারো ছিল না। স্যারের ভয়তে টিফিনের সময় আমাদের স্কুলের পাশের মাঠে খাবার কিনতে যেতে ভয় পেতাম।
যে সকল শিক্ষকদের আমরা খুবই ভয় পেতাম তার মধ্যে প্রথমেই নাম করতে হয় টি বি স্যারের। পুরো নাম ত্রিপুরেশ্বর ভট্টাচার্য। উনি আমাদের ইংরেজি নিতেন। ইংরাজি ক্লাসে উনার ভয়ে কেউ টুশব্দটি পর্যন্ত করতে পারত না। পড়া না করে আসলে ও ইংরাজি পাঠ্য বই রিডিং পড়তে না পাড়লে তিনি খুবই রেগে যেতেন। বাঁশের সরু কঞ্চি থাকত তার টেবিলে। কি মার না মারতেন, মুখে বলে ঠিক বিশ্বাস করানো যাবে না। একেবারে পশুর মতো মারতেন। একদিন আমি ওই শিক্ষকের পড়া করে স্কুলে যাই নি। আগের দিন বাড়িতে পুজোর জন্য পড়তে পারিনি। আমাকে যখন পড়া ধরেন তখন আমি ভয়ে ভয়ে বলি -- " স্যার আমাদের বাড়িতে মনসা পুজো হওয়ার জন্য আমি পড়াটা ঠিক করতে পারিনি।" এই কথা বলার সময় ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, বুক ধড়ফড় করছিল, দুই পা কাঁপছিল। স্যার কোনো কথাই শোনেন নি। খুব মার মেরে ক্লাসের বাইরে বের করে দিয়েছিলেন। আমি কান্না করে দিয়েছিলাম। তারপর থেকে আমি যত সমস্যাই থাকুক স্যারের পড়া করে যেতাম। হীরক একদিন পড়া না করে টি বি স্যারের ক্লাসে গিয়েছিল। স্যার যখন ওকে মারতে যান তখন ও ভয়ে চিৎকার করে কান্না করতে থাকে। বলে-- 'স্যার আজকের মতো ছেড়ে দিন। আমি কাল থেকে পড়ে আসব।' হীরকের বাবার সঙ্গে টি বি স্যারের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। তবুও সেদিন ওকে ছেড়ে দেন নি। মারের চোটে জ্বর এসেছিল ওর। ডাক্তার দেখাতে হয়েছিল। যেখানে যেখানে মেরেছিল সেখানে সেখানে ফুলে উঠেছিল। হীরকের বাবা ছেলেকে বলেছিলেন --- " পড়া যেমন করে যাস না, তেমন মার খেয়েছিস। এবার যদি তোর শিক্ষা হয়। আমার কিছু বলার নেই।" হীরকের বাবা এমন বললেও হীরকের দিদি কিন্তু বিষয়টিকে খুব সাধারণ ভাবে নেননি। তিনি পোষ্টাপিসে চাকরি করতেন। তিনি প্রধান শিক্ষক মাখন লাল দাস মহাশয়ের কাছে গিয়ে পুরো বিষয়টি জানান। মাখন স্যার বুঝতে পারেন আজ একজন এসেছেন কালকে আরও অভিভাবক - অভিভাবিকা আসবেন অভিযোগ জানাতে। তাছাড়া কোনো ছাত্রের যদি খারাপ কিছু হয়ে যায় তবে তাদের সকলের চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। এখনি ত্রিপুরেশ্বর বাবুকে থামাতে হবে। প্রধান শিক্ষক ইংরাজি শিক্ষক ত্রিপুরেশ্বর ভট্টাচার্যকে অনেক বুঝিয়ে ছিলেন। বলেছিলেন -- "ছাত্রদের না মেরে মুখে বলতে। এভাবে গরুর মতো যেন না পিটান তিনি। আর মারলে সেটা যেন মাত্রাতিরিক্ত না হয়।" প্রধান শিক্ষকের বোঝানো তেমন কাজে আসে নি। তারপরও তিনি ছাত্রদের মারতেন। আজ তিনি ইহজগতে নেই। তার কথা মনে করলে এখন খুবই খারাপ লাগে। এখন বুঝি তিনি আমাদের ভালোর জন্যই মারতেন।
দ্বিতীয় যে শিক্ষকের কথা আমার মনে পড়ে তিনি হলেন অমেলেন্দু বিশ্বাস। তিনি আমাদের ইতিহাস নিতেন। খুব সুন্দর করে আমাদের ইতিহাস বোঝাতেন তিনি। পড়া না করে আসলে তিনি চুলের মুঠি ধরে পিঠে ধপাধপ চড় কষাতেন। পিঠ একেবারে রিরি করে জ্বলে যেত। তিনি কখনো লাঠি নিতেন না। হাত দিয়েই মারতেন। রেগে গেলে একেবারে লাল হয়ে যেতেন। পড়া বোঝানোর সময় কেউ কথা বললে তার অবস্থা মেরে শোচনীয় করে দিতেন। একদিন মৃত্যুঞ্জয় অভয় নামে একজন বন্ধুর সঙ্গে শুধু বলেছিল--'ষস্যার কোনটি পড়াচ্ছেন?' অমলেন্দু স্যার দুজনকেই খুব মেরে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিলেন। পরে স্যার আমার কাছ থেকে পুরো বিষয়টি শুনে ওদের দুজনকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন ও ওদের ভালোবেসে কেক খাইয়েছিলেন। কঠিন হলেও অমলেন্দু স্যারের মনের এক কোনে নরম ব্যাপারটি ছিল।
এরপর যে শিক্ষকের কথা বলব তাকে আমরা ছাত্ররা যমের মতো ভয় করতাম। তিনি হলেন আমাদের স্কুলের সহ প্রধান শিক্ষক সূর্য ঘোষ। তিনি মাঝে মাঝে আমাদের অঙ্ক নিতেন। উনি ক্লাসে আসলে সকলে একেবারে চুপ হয়ে যেতাম। খুব ভালো অঙ্ক করাতেন তিনি। আমরা শুধু নই পুরো স্কুল উনাকে খুবই ভয় পেতেন। ছাত্র-শিক্ষক- অফিসকর্মী- মাসি - সনাতন দা - শিশু দা সকলেই। চুন থেকে পান খসলে সারা স্কুল তার ভয়ে কাঁপত। টিফিনের সময় পেরিয়ে গেলে ক্লাসের বাইরে ছাত্ররা থাকলে স্যার একবার লাঠি নিয়ে উনার ঘরের বাইরে বেরতেন, তৎক্ষনাৎ ছাত্ররা যে যেখানে থাকত ক্লাসে ঢুকে যেত। না ঢুকলে প্রচন্ড মারতেন তিনি। একবার আমার বন্ধু গোবিন্দ টিফিনের পরে উনার সামনে পরে গিয়েছিল । সেদিন কঞ্চি দিয়ে কী মার মেরেছিলেন গোবিন্দকে উনি, আজও আমাদের সকলের মনে আছে। মেরে কেমন আছে তা ছাত্রদের দিয়ে খোঁজ নিতেন তিনি। গোবিন্দর বাবাও সেদিন সূর্যবাবুর নামে প্রধান শিক্ষকের কাছে অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু কোনো লাভ হয় নি। কারণ প্রধান শিক্ষক তার কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করতেন না।
এরপর আমার মনে পড়ছে দুজন শিক্ষকের মুখ, যাদের আমরা ভয় করলেও ভালোবাসতাম, শ্রদ্ধা করতাম। তারা হলেন ইংরাজির শিক্ষক সুমিত ভক্ত ও ভূগোলের শিক্ষক সুনীল মন্ডল। তারা ছাত্রদের মারলেও নির্দয়ের মতো কখনো মারতেন না। দুজনেই খুব মিষ্টি কথা বলতেন। পাঠ্য পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অনেক ছোট ছোট গল্প শোনাতেন। যে গল্প শুনে আমাদের শিক্ষা হত। কোনো খারাপ কাজ করার সাহস পেতাম না। সুনীল স্যারের মার দেখে আমাদের হাসির উদ্রেক হত। হাসির কারনে আমরা প্রত্যেকেই কমবেশি মার খেয়েছি। সুমিত স্যার তার জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা আমাদের ক্লাসে বলতেন। আমরা সকলে খুব মন দিয়ে তা শুনতাম। ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধা নিয়ে আমরা স্যারকে নানান প্রশ্ন করতাম। স্যার উত্তর দিতেন আমাদের। শুধু কেউ অমনোযোগী হলে তাকে বকতেন ও অল্পবিস্তর মারতেন।
আজ আমরা সকলেই সংসারি। স্যারেরা সবাই রিটায়ার্ড হয়ে গেছেন। আমাদের কথা হয়তো তাদের মনে নেই। কেউ বা মারা গেছেন। আমাদের জীবনে তাদের এই ভয় যে কত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তা আমরা আজ অনুভব করতে পারি। আমরা কেউ চোর-গুন্ডা নেশাখোর হই নি। যাদের উপকার হয়েছে তাদের মধ্যে আমরা চার বন্ধু ছিলাম। তাদের শিক্ষায় ও ভয়ে একজন মানুষ হতে পেরেছি।
===================
মিঠুন মুখার্জী
গ্ৰাম : নবজীবন পল্লী
পোস্ট+থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগণা
Comments
Post a Comment