
শিবানন্দ স্যারের মহাপ্রয়াণ
সমীর কুমার দত্ত
শিবানন্দ স্যার গতরাতে দেহ রাখলেন। বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সারা জীবন শিক্ষায় নিয়োজিত থেকে অকৃতদার রয়ে গেলেন। জন্ম থেকে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে গিয়ে তিনি তখন যৌবনে পদার্পণ করে পায়ের তলায় জমি খুঁজে পেতে চলেছেন। কিন্তু কলেজ পাশ করার অব্যবহিত পরেই তাঁর পিতৃ মাতৃ বিয়োগ ঘটেছে। সংসারে থাকার মধ্যে গ্রামে একখানি দোচালা খোড়ো চালের ঘর। পিছনে ফেলে রেখে ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে পড়লেল এক কাপড়ে কিছু বইপত্র ঝোলায় ভরে নিয়ে। পকেটে সম্বল মাত্র টিউশন থেকে অর্জিত একমাসের বেতন শ পাঁচেক টাকা। কোথায় যাবেন কিছুই ঠিক করতে পারলেন না।
একটা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে বসে আছেন অনেকক্ষন। বসে বসে একটা বই 'Vivekananda's influence on Subhash' মনযোগ সহকারে পড়ে চলেছেন। পাশে এসে বসলেন এক দিব্য দর্শন সন্ন্যাসী। তিনি লক্ষ্য করছিলেন শিবানন্দকে। কিন্তু শিবানন্দের সেদিকে কোন হুঁশ নেই। একসময় নিজেই পাঠ ভঙ্গ করে মুখ তুলে সামনেটা দেখার চেষ্টা করলেন। সন্ন্যাসীর দিকে তাঁর চোখ পড়লো। সন্ন্যাসীও অনেকক্ষণ উসখুস করছেন শিবানন্দের সঙ্গে কথা বলার জন্য।কিন্তু পারছিলেন না তাঁর একাগ্রতা ভঙ্গ করতে। শিবানন্দের সঙ্গে তাঁর দৃষ্টি বিনিময় হতে সন্ন্যাসী মহারাজ প্রশ্ন করলেন," নমস্কার, মহাশয়ের কোথায় যাওয়া হবে জানতে পারি ? "
নমস্কার বিনিময় করে ঘাড় নেড়ে শিবানন্দ বললেন, " জানি না।" বিস্মিত হয়ে মহারাজ বললেন," পরিব্রাজকের বৃত্তি? কেন না হাতে বিবেকানন্দ?"
—বলতে পারেন।
— মহাশয়ের কোথায় থাকা হয়?
শিবানন্দ সবিস্তারে সব কথা বললেন। সব শুনে মহারাজ বললেন," যদি আপত্তি না থাকে আপনি আমার সঙ্গে যেতে পারেন। আজ আপনার মতো লোকের দরকার। দেশের আজ বড়ো দুর্দিন। ডিগ্রি সর্বস্ব শিক্ষায় শিক্ষিত বেকাররা বিপথে চালিত হয়ে গর্হিত কাজ করে চলেছে। ধর্মাধর্ম সব একাকার। রাষ্ট্র নেতারা দেশের যুব সমাজকে ধ্বংসের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বিবেকানন্দ এতো তাড়াতাড়ি চলে না গেলে দেশ এতো পিছিয়ে পড়তো না।"
সব কথা শুনে শিবানন্দ বললেন, " আপনি একদম উপযুক্ত কথাই বলেছেন। আমি আপনার পরিচয় জানতে পারি কি যদি অবশ্য আপনার আপত্তি না থাকে?"
—নিশ্চয়ই জানতে পারেন। আমি বিবেকানন্দের শিক্ষায় শিক্ষিত এক সন্ন্যাসী। আমার নাম দীপ্তানন্দ।এ নাম আমার গুরু শ্রদ্ধেয় বরানন্দজীর দেওয়া। পিতৃদত্ত নাম অনিমেষ ঘোষাল। পূর্ব বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিবেকানন্দ মঠ মিশনে দীক্ষিত হয়ে মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত এক গ্রামে বিবেকানন্দ আশ্রমিক বিদ্যালয় নামের এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক রূপে নিযুক্ত আছি। আমার অবর্তমানে এই স্কুলের দায়িত্ব আমি এমন এক যুবকের হাতে তুলে দিয়ে যেতে চাই , যিনি বিবেকানন্দের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সকল ছাত্রকে আলোর দিশা দিতে পারেন। আমি যখন আমার এই কর্মযজ্ঞ শুরু করি তখন আমার গুরু পরম শ্রদ্ধেয় বরানন্দজী মহারাজকে প্রশ্ন করেছিলাম এই কর্মযজ্ঞের ভার আমি কার হাতে দিয়ে যাব। উত্তরে গুরুজী বলেছিলেন, " তোমায় খুঁজতে হবে না। ঠিক সময়ে তার সঙ্গে তোমার যোগাযোগ হয়ে যাবে। আজ আমি খুঁজে পেয়েছি। না হলে আমি আপনাকে দেখে পাশে বসে পড়লাম কেন? আমি গিয়েছিলাম একটি কাজে।কাজ সেরে ফিরছিলাম। আপনাকে দেখে আটকে গেলাম কেন?
সকল কথা মন দিয়ে শোনার পর শিবানন্দ বললেন আমি আমার যথার্থ কাজ পেয়ে গেছি। আমার পিছন ফিরে তাকাবার কেউ কিংবা কিছু নেই। আমি আপনার সঙ্গে যাবো। আমি আপনার কাছে দীক্ষিত হতে চাই। আপনি আমায় আর 'আপনি'' ' আপনি' করবেন না। আমি এতে লজ্জিত বোধ করছি।
শিবানন্দ ওরফে শিবদাস মৈত্র
দীপ্তানন্দজীর কাছে দীক্ষিত হয়ে 'শিবানন্দ' নাম ধারণ করে বিবেকানন্দ আশ্রমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে শুরু করেন। দীপ্তানন্দজী মহারাজের মুখাশ্রিত বাণী শ্রবণ করতে করতে শিবানন্দ কখন যে ছাত্রদের কাছে একান্ত আপন হয়ে উঠেছেন তাঁর মনে নেই।
দীপ্তানন্দজী বলেন," যেদিন নিজের শিকড় ছিঁড়ে এদেশে এসে পৌঁছলাম বড়ো অসহায় লাগতো। তারপর যখন দীক্ষিত হলাম বিশ্বভ্রাতৃত্বের সাধ পেলাম। এখানে মানুষের নির্দিষ্ট কোন শিকড় নেই। শিকড় আছে এক জায়গায় যেখান থেকে এসেছি। আবার সেই খানেই ফিরে যাবো। সুতরাং সবাইকে নিজের বলে ভাবতে হবে। নিজের বাবা কি শাসন করেন না? ছেলে কি অবাধ্য হয় না? ভাইয়ে ভাইয়ে কি ঝগড়া হয় না? তাহলে এরা কি পর হয়ে যায়? যায় না। তদ্রূপ সবাইকে আপন ভাবলে কোন দুঃখ কষ্ট নেই। অনেক সময় আপনের থেকে পর ভালো হয়।কেউ তো চিরদিনের নয়। তাহলে কিসের এতো দ্বন্দ্ব ? আমরা মিছিমিছি দ্বন্দ্ব করে মরি।"
আশ্রমিক বিদ্যালয় কঠোর অনুশাসনে পরিচালিত হয়।সকল বিষয়ের এক একজন করে শিক্ষক আছেন। তবে তদারকি করার দায়িত্ব সবাই নিতে পারেন না।
এখানে ছেলেরা সকলই বাবা মাকে ছেড়ে এসে একান্নবর্তী পরিবারের মত বেড়ে উঠেছে। সুতরাং সকলেই সহানুভূতি সম্পন্ন, এবং প্রত্যেকে ওরা পরের তরে।
রাত নটার মধ্যে প্রার্থণা সেরে খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে সকলকে শুয়ে পড়তে হয়।আবার ভোর পাঁচটায় উঠে মুখ ধুয়ে প্রার্থণা করে তবে দিন শুরু হয়।
বিকেলে স্কুলের ক্লাসের পরে ব্রতচারীতে সকলকে অংশ নিতে হয়। এ ছাড়া থাকে সপ্তান্তে একদিন ধর্মীয় পাঠ, বৃক্ষরোপণ ও বাগিচা পরিচর্চার ক্লাস । শুরুতে এ সবই দীপ্তানন্দজী দেখতেন। শিবানন্দ স্যার আসার পর দীপ্তানন্দজী অসুস্থ হয়ে পড়লে শিবানন্দ স্যার এই দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন । মাঝখানে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো দীপ্তানন্দজীর মহাপ্রয়াণ সকলকে অকূল সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে গেছে। তার থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে সকলে এই শিবানন্দ স্যারের অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্য। শিবানন্দ স্যার ছিলেন সকলের কাছে পিতৃতূল্য। রাতে সকলে শুয়ে পড়লে শিবানন্দ স্যার রাউন্ডে আসতেন সকলে ঘুমচ্ছে কিনা দেখতে। এতদিনে শিবানন্দ স্যার সার্থক উত্তরসূরীও তৈরি হয়ে গেছেন। কিন্তু কাকেও ছোট না করে বলা যায়,এমন এমন মানুষ আছেন যাদের অনুপস্থিতি ভীষণ ভাবে অনুভূত হয়। তা যদি না হতো আমরা আরও একজন বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্র কিংবা রবীন্দ্রনাথ পেয়ে যেতাম। যাই হোক শিবানন্দ স্যারের মহাপ্রয়াণে সকল আশ্রমিক শোকে মুহ্যমান। তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সকল ছাত্রেরা পুত্রসম আচার অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে তাদের প্রিয় শিক্ষককে চোখের জলে বিদায় দিলো।
================
Samir Kumar Dutta
Pune, Maharashtra
Comments
Post a Comment