[ভ্রমণ]
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ষ্টেশন চত্তর। চলমান সিঁড়ি দিয়ে ওপারে পেরিয়ে গেলাম। পরিপাটি করে সাজানো গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা। আমাদের নির্ধারিত গাড়ির চালক, ইমরান আনসারি। কালোসাদা বড় মাপের রুমালটি নাড়িয়ে নিশ্চিত করলেন। আমরা দুটো গাড়িতে উঠে পড়লাম। কে কোন গাড়িতে উঠবে আগেই ঠিক করা ছিলো। গাড়ি ষ্টেশন ছেড়ে সরু পথের মধ্যে দিয়ে গিয়ে হাইরোডে ছুটে চলল।
তখন চারিদিকে শুনশান পরিবেশ। রাঁচি শহরে তখনও অধিকাংশ চোখের পাতা খুলবার সময় হয়ে ওঠেনি। বেশ কিছুটা পথ যাওয়ার পর হনুমানের কারুকার্য করা অসম্পূর্ণ মন্দিরের পাশ ঘেঁষে অপ্রসস্ত গলিপথে ঢুকে পড়ল। সামনে চলমান বিজ্ঞাপিত লেখায় হোটেল নটরাজ [Hotel Nataraj] আবাসিক দেখতে পেলাম। পথের পাশে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। প্রথমে এই জায়গাটি কোথায় ড্রাইভার বুঝতে পাচ্ছিল না। যাক শেষ পর্যন্ত পাওয়া তো গেল।
পীযূষবাবু ফোনের পর ফোন করে হোটেলের দরজা খোলালো। দেখলাম দায়িত্বে যাকা কম বয়সি দুইছেলে চোখ কজলাতে কজলাতে দোর খুলে দিল। আমরা যে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে চলেছি ঠিক তার দুহাত দূরে মেঝেতে বিছানা করে ঘুমচ্ছিল এরা। যে যেখানেই ঘুমুগ্যে না, আমরা পয়সা দিয়ে ভালো পরিসেবা পেলেই হলো। পাশ কাটিয়ে ওপরে উঠে গেলাম।
এখানে আমার অর্ধাঙ্গিনী নেই। ঘর বাছাইয়ের প্রশ্ন ওঠে না। সবাই জানে আমি সাহিত্যমনস্ক মানুষ। যে ঘরটাই পাবো তাতেই খুশী। আমাদের কক্ষ পড়েছে চলতি রাস্তার ধারে। আমাদের বলতে, গোপালদা। আমি দাদা বলেই ডাকি। সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ। আপাতদৃষ্টিতে গুরুগম্ভির। মিশলে বুঝবেন বাইরের খোলশ দেখে মনগড়া ধারণা করা ভুল, তা প্রমাণ হবে।
আমাদের কক্ষের ঝুল বারান্দা আছে। কাচের পাল্লা খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখান থেকে রাঁচি শহরের অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখা যায়। পুরোনো পাকা জরাজীর্ণ বাড়ির পাশাপাশি হাল আমলের ঝকঝকে বহুতল আবাসিক। বিভিন্ন নামে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। যেহারে জায়গার দাম বাড়ছে। প্রোমটারের থাবা থেকে পুরোনো বাড়িগুলো বাঁচানো কতদিন যাবে। আরও কতকিছু মনে আসছিল। এমন সময় দাদা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। শিবু, সকালের ঠাণ্ডায় বেশিক্ষণ থাকা ঠিক না। দাদার কথা অন্যথা না করে ভিতরে ঢুকে গেলাম।
গরম জলে স্নান সারা হয়ে গেছে সবার। বাইরে থেকে চা এনে পানের পর্ব সমাপ্ত। নেতার হাটে দশম ফলস ( Ten Water Fall ) দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। দর্শনীয় স্থানে পৌঁছিয়ে গেলাম। দেখলাম অনেকটা উঁচু থেকে জলের খরধারা প্রবাহিত হচ্ছে। অমি, ডাক্তারবাবু ও ঈশানী অনেকটা নিচুতে নেমে গেলাম। ঝর্ণার জল ছুঁয়ে ছবি তুললাম।
দ্বিতীয়বার পাঁচমুখী বা পঞ্চ ঘাঘ জলপ্রপাত (Panchghagh Water Fall) লক্ষ্য করার মতো। এর বৈশিষ্ট্য আবার আলাদা। এই ঝর্ণাটি যে পাথর খণ্ডগুলো মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে অনেককিছু মনে করিয়ে দেয়। প্রতিটি পাথরখণ্ড আড়ায়াড়ি ভাবে আছে। বিভিন্ন আঙ্গিকে তার অবস্থান। এই পাথরগুলো দেখে আমার যা মনে হয়েছিল সেটাই বলি। সকর্মে যুক্ত ব্যক্তিরা তার প্রিয়বস্তু লক্ষ্য করলে দেখতে পাবে। চকখড়ির আকার। গ্রন্থের আদল। আস্ত কঠের গুঁড়ি। আরও কতো বিচিত্র রূপে পড়ে থাকা পাথরগুলোকে চিন্তিত করে যায় বা কল্পনায় ভেবে নিতে পারি। যেমন বৈকালিক অস্তগামী ভাসমান মেঘগুলো এক দৃষ্টে দেখলে প্রতিমুহূর্তে কতকিছু চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়। তেমন এই পঞ্চঘাঘের পাথরখণ্ডগুলো।
সারাদিনের পাহাড়ি ঝর্ণা দেখার আনন্দ নিয়ে রাঁচি শহরের মধ্যে দিয়ে রাঁচিতে অবস্থিত আবাসের দিকে চলেছি। চারিদিকে আলো ঝলমল করছে। এখন বিবেকানন্দ রকে বিপরীত দিক দিয়ে ফিরছি। বিবেকানন্দের পূর্ণাঙ্গ মর্মর মুর্তি জলের মধ্যস্থলে দণ্ডায়মান। হনুমানজির মন্দিরে সকালে যেখানে ফাঁকা পড়ে ছিল এখন নেই। সেখানে চারচাকার ঠেলা ডালায় গরম পোষাকের ঢালাও ব্যবসা চরছে। তাই আমাদের গাড়ি উলটো দিকের পথে গলির মধ্যে ঢুকেছিল। ভেবেছিলাম সকালের মতো ভুল পথে ঘুরছে নাকি। আমাদের খাবার হোটেল হনুমানির মন্দিরের পিছনে। সরু পথ পেরিয়ে এই হোটেলটি। আমরা খাওয়ার আগে ও পরে পোষাকের বাজারে ঘুরলাম। দামও করলাম। ভীষণ ভালো সোয়েটার অনেক কম দামে এখানে পাওয়া যাচ্ছে। যখন দেখছি একে একে দোকান গুঠিয়ে নিচ্ছে, আমরাও রাত্রি যাপনের জন্য আস্তানার দিকে পা বাড়ালাম। সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে।
২৬শে ডিসেম্বর। দাদা, ভোর পাঁচটায় প্রাতঃভ্রমণে যাওয়ার জন্য ছটফট শুরু করে দিয়েছে। সাহিত্যসম্মেলনে যাওয়া শান্তিনিকেতনে প্রাতঃভ্রমণের ভূত রাঁচিতে ভীষণ ভাবে মাথায় চেপে বসেছে। সেখানেও এই অধম সঙ্গী। আমি বললাম দাদা ওরা এখনো গেট খোলেনি। আমাদের সবাই এখনো ঘুমিয়ে আছে।
-চল, না গেলে খুলে দেবে কি? বাইরে এসে ঘুমিয়ে কাটালে, বাড়িতে থাকতে কি হয়েছে। -আমি তা বলছি না।
-কিছু বলতে হবেনে, চলো নিচে যাই।
হালকা আলোর মধ্যে সাবধানে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে গেলাম। নিজেরাই গেট খোলার নিষ্ফর চেষ্টা চালালাম। যদিও উচিত হয়নি এমন অস্বাভাবিক আচরণ করা। যাইহোক ওপরে উঠে যাবো কিনা ভাবছি। রিসেপশানের ওদিকে থেকে মেঝে ফুঁড়ে কেউ যেন উঠে দাঁড়িয়েছে। ' উধার নেহি' বলে অনেকটা দৌড়ে যাওয়ার মতো করে অন্ধকারের দিকে চলে গেল। আমরা ভাবছি 'উধার নেহি কিউ, ইধার যানা পড়ে গা' বাংলায় কিছু বলে গেলে নিরাপদ বোধ করতাম। ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। কী করব এখন। যে পথে এসেছি, সেই পথে ফিরে যাবো।
এমন সময় ছেলেটি সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আর কোথাও নয়, প্রাতঃকৃত্য সারতে গিয়েছিল।এসে জানালো, সামনের দরজা খোলার এখনো সময় হয়নি। দাদা তাকে হিন্দিতে বুঝিয়ে দিলেন। প্রাতঃভ্রমনের জন্য বাইরে যেতেই হবে। আমি বুঝতেই পারলাম না। দাদা তো নির্মল বাংলায় শব্দগুলো উচ্চারিত করলেন। যেখানে ছিটেফোঁটা হিন্দিভাষার টান নেই। আমাকে তো সুযোগ পেলেই বলেতে ছাড়েনা, 'শিবু লেখালেখি করছ, বাইরে বেরুচ্ছ। একটু আধটু অন্তত হিন্দি বলতেই হবে'। দাদা ছেলেটাকে আচ্ছা করে বোঝাচ্ছিলেন। হোটেলে বিভিন্ন ভাষার মানুষজন নিয়ে কাজ করবার। তাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। বাধ্য হয়ে বাথরুমের পাশ দিয়ে পথ দেখিয় দিল। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। ভাষার বেড়াজালে থেকে মুক্তির স্বাদ পেলাম। এখন পথে বেরিয়ে হনুমানজির মন্দিরের দিকে যেতে থাকলাম। রাতের খাওয়া হোটেলের সামন দিয়ে হনুমানজির বিপরীত দিকে মন্দিরের গা ঘেঁষে চায়ের দোকান। সেখানেও দাদা নির্মল বাংলায় শারীরিক ভাষা সহযোগে দোকানীকে বুঝিয়ে দিলেন। 'দু'কাপ চা দিন আমরা এখানে খাবো। দশ কাপ আপনাদের কোনো জায়গায় দিন নিয়ে যাবো। আমরা পনেরো জন নটরাজ হোটেলে আছি। আরও অনেক চা লাগবে। বোঝানোর পালা প্রায় শেষ, এখন অপেক্ষায় থাকা।
এই সুযোগে দুএকটি কথা জানিয়ে রাখি। হনুমানজির মন্দির বলছি বটে। আদপে কয়েক তলা বিল্লিং। যখন বাদ্যযন্ত্র বাজে বহুতল কাঁপে। এই কাঁপন ভক্তদের কাঁপায় বলে তো প্রণামিতে কৃপণতা করার অবকাশ থাকেনা। মন্দিরের সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখেছি। একভদ্রলোক শেতবস্ত্র পরিবৃত হয়ে, হাতে চামর নিয়ে মনে হয় ছোটছুটি করছে ভিতরে। কী বলব কাশ্মীরী আপেলের মতো গায়ের রঙ। আর ভক্তদের রুক্ষ্ণ শরীর না হলে তো ভক্তি মাঠে মারা যাবে। ধর্মব্যবসায় কতকিছুর প্রয়োজন হয়। ভাবলে অবাক হতে হয়।
এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সকালে এখানে পাইকারি সবজির বাজার। এখন থেকে ছোট ছোট দোকানীদেরে প্রয়োজন মতো কিনে নিয়ে যায়। সারাদিন ফাঁকা পড়ে থাকে। সন্ধ্যায় মন্দিরের ওপারে গরম পোশাককের অস্থায়ী দোকান আগের দিন জেনে গেছি। আমরা চা বিস্কুট খেয়ে, ফ্লাক্সে চা নিলাম । এখন ওপরে ওঠার মুক্ত দরজা পেয়ে গেলাম। ততক্ষণে নটরাজে নটরাজের নৃত্য শুরু হয়ে গিয়েছে। ঈশানী অস্থির করে তুলেছে, দাদাই দাদাই করে। দাদাকে দেখে শান্ত হলো।
কাজলদি দুজনের দেখে জানতে চাইল, বাবুরা সব কোথায় গেছেলে। যখন জানল সকালে বেড়াতে গিয়ে ছিলাম। চা বিস্কুট খেয়ে অল্প চা নিয়ে এসেছি। এই চা'য়ে সবার হবেনা। আরও চা আনতে হবে। আমি যেতে রাজি, দাদা আমাকে একা ছাড়বে কী করে হিন্দি বলয়ে।
চায়ের সঙ্গে যার যা সঙ্গে ছিল খেয়ে নিচে নেমে এলাম। আমাদের গাড়ির চালক ইমরানদা। আমার নাম যে শিবু জেনে গেছে। রাঁচির প্রাক্তন মূখ্যমন্ত্রী শিবু সোরেন। আমাকেও শিবু সোরেন নামে মজা করে ডাকতে শুরু করেছে। আমিও মুচকি হেসে উপভোগ করছি। যাইহোক দুটো গাড়ি ভ্রমণের জন্য বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। আমরা হুড্রু ওয়াটার ফলস (Hundru Water Fall) দেখার জন্য মূল জায়গায় পৌঁছে গেলাম। এখন ঝর্ণা দেখতে যাওয়ার জন্য যাওয়া-আসায় মোট ১৪৮৪ টা পোটে ভাঙতে হবে। শুনে প্রথমে দিদি ও পীযুষাবু না করে দিল। অনেকেই মনের জোরে নামতে শুরু করলেও শেষ পযর্ন্ত নামতে পারেনি। অতৃপ্ত মনে উঠে আসতে হয়েছে।
আমি নেমে গিয়েছিল শেষ ধাপে। যেখানে সবাইকে দাঁড়িয়ে দু'দণ্ড ভাবতে হবে এবার কী করবে। 'ওই দেখা যায় বাবার মন্দির-' বলে প্রণাম করে ফিরবে। না ঝর্ণা প্রপাতের তলদেশে গিয়ে দাঁড়াবে। বিপদ যদি হয়, সেই বিপদের সম্ভবনা এবার প্রবলভাবে রয়েছে।ঈশানী পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ডাক্তারবাবু প্রায় কাছেই আছে। মেয়ে বাবার কাছে আবদার করললো ঘুর্ণিয়মান চাকতির ওপর দাঁড়িয়ে রানিং ক্যামেরায় ছবি তুলল। ঈশানী টাইটানিকের নায়িকা যেভাবে দুদিকে হাত মেলে ছুটন্ত জাহাজে দাঁড়িয়ে ছিল তেমন পোজ দিয়েছে। ছবি তোলা হয়ে গেলে মনে হবে। আমাদের বড়মেয়ের চারদিকে পুরো পাহাড় গাছপালা সমেত ঘুরছে। এই বয়সে এরা তুলবে না তো ষাট পেরিয়ে যাওয়াদের মতো ভয়ে কুঁকড়ে থাকবে। ছোটদের নিষেধের বেড়িতে আটকে রাখলে তারা তা মানবে কেন।
চাকতিতে ঘুরে ছবি তোলা বিপদের ছিলনা। ওই ঘুর্ণিয়মান চাকতি বসানো ছিলো ভগ্ন পাহাড়ের কানা ঘেঁষে। মেয়ের ছবি তোলা শেষ। আমি এই সময়টায় ভাবছিলাম কী উপায়ে অসংখ্য ভ্রমণার্থী গভীর খাদে ওপর থেকে ঝরে পড়া ঠান্ডা ঝর্ণার জল নিয়ে কতভাবে যে জলকেলি করছে। কঠিন হলেও সহজে নামার পথে তখনও আবিষ্কার করে উঠতে পারিনি। ঈশানী যেদিকে ঘুরছিল, এদিকে টুকরো টুকরো পাথরখণ্ডের ওপর দিয়ে অনেকেই নামতে দেখে আমিও দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। মেয়ে বলল,ও শিবুমামা চলো ওদিকে যাই। হ্যাঁ বলে পা বাড়িয়ে দিলাম।
আর পেছনে তাকানোরও সময় নেই। দুজনের মনের ইচ্ছে ওই ঝর্ণার তলায় যাওয়ার। একের পর এক পাথরখণ্ডের ওপর দিয়ে দুজনে চলেছি। এক পাথরে দুজনে নেই। এগিয়ে চলেছি আমি, মেয়ে পেছনের পাথরে। মেয়ের পায়ে সু। আমার পায়ে নতুন চামড়ার জুতো। জুতার তলার খাঁজ ক্ষয়ে জায়নি। মেয়েকে বলে দিয়েছি। হঠাৎ শরীর টলে গেলে হাত ছড়িয়ে বসে পড়বে। যেন পাকা প্রশিক্ষকের ভূমিকায় নিজেকে ভাবছি। সামনে পেছনে তাকাতে তাকাতে পা ফসকে অল্পের জন্য বিপদমুক্ত হলাম। একটু থেমে আরও একটি পাথরখণ্ডে পা বাড়াতে যাবে আপাতত থেমে গেলাম। ওপর থেকে আমার নাম ধরে বলছে, ফিরে যাওয়ার জন্য। কার গলা আবার - দাদার। আর দু'তিনটে পাথরের চাঁই পার হলে আমাদের উদ্দেশ্য সফল হয়। দাদা তো পোটের সংখ্যার শুনে নামতে নারাজ ছিল। ওইযে বাৎসল্য কতটা দুর্বল করে করে দিতে পারে এই মানুষটাকে না দেখলে বুঝতে পারবেন না। দুটো মেয়ে কৌশানী ও ঈশানী বাবা মায়ের সঙ্গে গেলেও দাদাইয়ের মনে সর্বদা সংশয়। ঠিক চলে এসেছে। আমি ঈশানীকে বললাম। মেয়ে তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে থাকো। আমি একা ঘুরে আসছি। পারলে ওখান থেকে ছবি তুললে তুলতে পারো।
যেভাবে নেমেছিলাম সেই ভাবে ওপরে দুজনে উঠে গেলাম। কৌশানী ঝাঁকে মিশে গেল। কিছু কেনাকাটায়, খাওয়াখায়িতে সঙ্গীদের অনেকে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমি কোথাও হ্যাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনা। ধাপে ধাপে একাই এগিয়ে চলেছি। যা ভালো লাগছে ছবি তুলছি। পথের চওড়া রেলিংএ আশপাশের পাহাড়ি বন থেকে সংগ্রহ করা গামার কাঠ। সেই কাঁচা কাঠে তলোয়ার তৈরি করে সাজিয়ে রেখেছে বেচার জন্য। সংগ্রহ করে আনা ফল, ফুল ছাড়াও স্থানীয় কতকিছু জিনিস পত্র বেচার জন্য খরিদ্দারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এইসব দোকান যারা দিয়েছে তাদের দেখে আমার মনে হলো অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষজন। আর্থিক অনটনের মধ্যে জীবন যাপন করে।
এক বাচ্চা মেয়ে হাত বাড়িয়ে কিছু চাইছে না। ছোট্ট কাঠের টুকরো যাকে সে তলোয়ার বলছে। কিছু শিল্পীর ছবির তলায় না লিখে দিলে কীসের ছবি বোঝা যায়না। ওই বাচ্চা মেয়টি অস্পষ্ট ভাষায় তলোয়ার না বললে সত্যি কিছুই বুঝতাম না। তলোয়ার নামক কাঠের টুকরো দশ টাকায় আমার কাছে বেচতে চায়। ইচ্ছে না থাকলেও দশ টাকা দিয়ে ওটা কিনে বাড়িতে এনেছিলাম। আমার ওই মেয়টির বয়সি নাতি খেলনা মনে করে কী খুশী না হয়েছে। কদিন ওটাই হাতছাড়া করেনি। শয়ণে, স্বপনে, খেলার অঙ্গনে হাতের কাছে রাখত।
আমি তলোয়ার ছাড়া আর কিচ্ছুটি কিনিনি। হিড্রু জলপ্রপাত দেখে বা না দেখে সবাই একত্র জড়ো হলাম। ওখানকার পথের হোটেলে খেয়ে গাড়িতে বসলাম। এখন চলেছি জোহানা ওয়াটার ফলস (Jonhana Water Falls) দেখার জন্য। আমরা গন্তব্যে পৌঁছে ওখানকার দোকানীদের থেকে ফলমূল কিনে খাওয়ার ব্যস্ততায় কিছুটা সময় কাটালাম। এবার ধাপে ধাপে ওপরে উঠে দেখলাম সুন্দর পার্ক বানানো। পার্কের ভিতর থেকে এগিয়ে গেলাম ঝর্ণা দেখার জন্য। বাঁদিক ঘুরে পাহাড়ের গা কেটে তৈরি পথ দিয়ে এগিয়ে চলেছি কতো নিষেধ নির্দেশিকা মেনে। প্রথম বুঝতেই পারিনি ঝর্ণা কোথায়। কতদূর গেলে দেখতে পাবো। আমাদের পনেরো জনের কে কার সঙ্গে কোথায় ছড়িয়ে পড়েছে বোঝা যাচ্ছে না। এমন অন্য কোথাও হয়নি। শারীরিক অক্ষমতা মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি দেখছি সামনে দিদির সঙ্গে অনেকে বসে আছা। সামনে একটা দল এগিয়ে গেছে। আমি সামনে পেছনে না ভেবে একাই চলতে শুরু করেছি। বুঝে ফেলেছি এখানে দ্বিতীয় পথ নেই। যারা বসে আছে,আর যারা ঝর্ণা দেখতে গেছে তাদের জন্য অপেক্ষা করবেই। পৃথিবী গোলের তথ্য এখানে খাটবে।
আমি গাছপালার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম খুব উঁচু থেকে ঝর্ণার জল ঝরে পড়ছে। আমার মনে হলো হুড্রুর থেকেও অনেক উঁচু। সামনে ঝুলন্ত সাঁকো। দেখতে পাচ্ছি পিঁপড়ের সারের মতো দর্শনার্থীরা যাতায়াত করছে।এই ঝুলন্ত পাহাড়ি পথে দুই পাহাড়ের মানুষজন যাতায়াত করতে পারে। এক সময় মাওবাদীরা ওই পথটাই নিজেদের কাজে লাগিয়েছে। আমি আর এগিয়ে না গিয়ে মাঝ পথে পায়ে হাঁটা পথ দিয়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে গেলাম। ওই ঝর্ণার জল বয়ে চলেছে আমার সমন দিয়ে। একদম কাছে না গেলেও স্পষ্ট ঝর্ণা দেখতে পাচ্ছি। পাথরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি। জলে হাত দিয়ে দেখছি বেশ ঠাণ্ডা। পা ডুবিয়ে নিলাম। কতটা সময় পেরিয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। কে কোথায় আছে জানিনা। এখন আমি একা, সত্যি আমার একা লাগছেনা। গাছপালা পাথর, মাথার ওপর খোলা আকাশ, পায়ের তলায় প্রবাহিত শীতল জলধারা আমার আপন হয়ে উঠেছে।
হঠাৎ ঘোর কেটে গেল। কে কোথায় অপেক্ষা করছে বুঝতে পারার কথা নয়। তাড়াতাড়ি সংকীর্ণ পাথরের চাঁইয়ের ফাঁক গলে ওপরে উঠে এলাম। ফেরার পথের দিকে এগিয়ে যেতে দেখলাম দিদির উদ্বিগ্ন। কী ব্যাপার জানতে চাইলাম। মানতু,মহুয়া তারা কোথায়? ওই পথ দিয়ে নামতে তো দেখলুম ওদের। আমার মতো নিচে নামার পাগলামীতে পেয়ে বসেছে। অনেক্ষণ বলছে, দুটো মেয়ের তো যাওয়া উচিত হয়নি। আবার ফোন ধরছে না। কী হলো বুঝতে পারছিনা। অতো গড়েনে কেউ নামতে সাহস পাচ্ছে না। আমি বললাম নেমে দেখছি কোথায় গেছে। চারদিকে নজর রেখে সাবধানে নামছি। ওইতো প্রবাহিত ঝর্ণার শীতল জলধার পাথরের নুড়িতে ধাক্কা খেতে খেতে বয়ে চলেছে। আর কোথায় নেমে খুঁজবো। তবে বেশ কয়েটা বড়ো পথরখণ্ড সামনের কিছুটা জায়গা আড়াল করে আছে। আমি তার ওপর দিয়ে খাদের জল দেখছিলাম। নিচের দিকে লক্ষ্য পড়লো গায়ের সোয়েটার ঝাঁটি গাছের ওপর পড়ে আছে। বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে উঠলো। কাউকে তো দেখতে পাচ্ছি না। দিদির কাছে ফোন করেছি। কানে রিংএর শব্দ শুনতে শুনতে চলেছি। তেমন হলে ফোন কেড়ে নেওয়ার আগে দুঃসংবাদ জানাতে পারব। পাথরের বাধা দৃষ্টি থেকে সরে যেতে দেখি মানতু ডুবন্ত পাথরে বসে আছে, ঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে। দুহাতে জল ছিটুচ্ছে। কি বলব, কী সুন্দর দেখতে লাগছে। যেন কোন রাজকন্যা সখীর সঙ্গে নিয়ে জলখেলা করছে। গুঠিয়ে নেওয়া বসনে মুক্ত চরণ স্বচ্ছ জলে মুক্তর মতো মনে হচ্ছে। তবে সঙ্গীটি জল খেলছে না। সম্ভবত ঘষে পায়ের ময়লা তুলছে। দেখে মনে হলো সময়ের অপচয় করেন না। এতো দূরে এসেও হিসাব বরাবর রেখেছেন। নতমুখে উভয় নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত ছিল। মনে হলো আমাকে দেখতে পায়নি। আমি তৎক্ষণাৎ মুখ ঘুরিয়ে ওপরে উঠে আসতে চাইলাম। মানতু আমাকে ডাকল, ও- শিবেনদা, চলে যাচ্ছো? ওরা আমাকে ঠিক লক্ষ্য করেছে।
- তোমাদের খুঁজতে এখানে আসা। তবে এসো আমি যাই।
- কী যাই, আমাদের ছবি তুলবে না।
- বললে তুলব। আমি নিচে নেমে ওদের কাছাকাছি গেলাম। মানতুর কতরকমের ভঙ্গিমায় ছবি তুলতে হলো। মহুয়া বোনের ছবি না তোলার অর্থ একযাত্রায় পৃথক ফল, তা কি করে সম্ভব। ছবি তোলার সময় কোনপ্রকার অঙ্গভঙ্গীর অবতারণা করেননি। ছবি তুলতে হয় তাই তোলা। খুব সাদাসিদে মনের। আর মানতু ভীষণ আমুদে, হাসিখুশিতে থাকতে অভ্যস্ত।
জোহনা জলপ্রপাতের দিক থেকে এসে বাড়ির পথে গেলাম না। বিপরীতে এগিয়ে গেলাম। সবাই খাদের পথ ধরে নিচে নামার সাহস দেখায়নি। পথের পাশে লেলিংএর ওপর বসে আনন্দ উপভোগ করছে। আমার একই গোঁ নিচে নামার। ডাক্তারবাবুকে সঙ্গে নিয়ে বাঁধে মতো সরু পাথুরে পথে এগিয়ে গেলাম। এখানে রোপওয়ে সিষ্টেমে আছে। অনেক উঠছে। এখন বুটু থাকলে ঈশানীকে আটকানো যেতো না। পথরের ওপর দিয়ে জলাধারের কাছে তো যেতে পারি। মেয়ের ওখানে যাওয়ার ইচ্ছা। এখানে দাদার নিষেধ থেকে অনেকটা দূরে আছি। ডাক্তারবাবুর কথায় ঈশানী থামবে না। বেলা ডুবতে বসেছে দুঃসাহসিকতা দেখানো ঠিক নয়। মেয়েকে বললাম যাওয়া ঠিক হবেনা। চলো ফিরে যাই। ৪:২৪শে গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি ছুটল হোটেল নটরাজে। চলার পথে মহেন্দ্র ধনির বাড়িটি দেখে নিলাম।
২৭শে ডিসেম্বর। ৯:৪২শে সূচি অনুযায়ী ভ্রমণ শুরু হলো। প্রথম রাঁচির মানসিক রুগীদের হাসপাতালে। আমাদের দুটো গাড়ি গেট দিয়ে ঢুকলো তবে নামার অনুমতি ছিল না। বিশাল এরিয়া। ওখান থেকে বেরিয়ে গেলাম। ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শিবু সোরেন তাঁর বাড়ি পেরিয়ে রক গর্ডেনে ঢুকলাম। একনজরে ঘুরে নিলাম। এবার পাত্রাতু লেক (Patratu Lake Resort. Patratu) ঘুরলাম। পরিপাটি করে সাজানো।
বেড়িয়ে এলাম ঝাড়খণ্ডে
শিবপ্রসাদ পুরকায়স্থ
২৫শে ডিসেম্বর। সকাল ৬-৫এ হাতিয়া এক্সপ্রেসে, রাঁচির ষ্টেশনে পৌছলাম। ষ্টেশনে নেমে চারদিকটা একনজরে দেখে নিলাম। হালকা অন্ধকার ভাব। কুয়াশায় যেন ধোঁয়া আটকা পড়েছে। শরীরে ঠান্ডা টের পাচ্ছি। গায়ে গরম পোশাক চাপানো। এখানে আসার আগে যেমনটা ঠান্ডার গল্প শুনেছিলাম, তেমনটা এবারে হয়নি।পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ষ্টেশন চত্তর। চলমান সিঁড়ি দিয়ে ওপারে পেরিয়ে গেলাম। পরিপাটি করে সাজানো গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা। আমাদের নির্ধারিত গাড়ির চালক, ইমরান আনসারি। কালোসাদা বড় মাপের রুমালটি নাড়িয়ে নিশ্চিত করলেন। আমরা দুটো গাড়িতে উঠে পড়লাম। কে কোন গাড়িতে উঠবে আগেই ঠিক করা ছিলো। গাড়ি ষ্টেশন ছেড়ে সরু পথের মধ্যে দিয়ে গিয়ে হাইরোডে ছুটে চলল।
তখন চারিদিকে শুনশান পরিবেশ। রাঁচি শহরে তখনও অধিকাংশ চোখের পাতা খুলবার সময় হয়ে ওঠেনি। বেশ কিছুটা পথ যাওয়ার পর হনুমানের কারুকার্য করা অসম্পূর্ণ মন্দিরের পাশ ঘেঁষে অপ্রসস্ত গলিপথে ঢুকে পড়ল। সামনে চলমান বিজ্ঞাপিত লেখায় হোটেল নটরাজ [Hotel Nataraj] আবাসিক দেখতে পেলাম। পথের পাশে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। প্রথমে এই জায়গাটি কোথায় ড্রাইভার বুঝতে পাচ্ছিল না। যাক শেষ পর্যন্ত পাওয়া তো গেল।
পীযূষবাবু ফোনের পর ফোন করে হোটেলের দরজা খোলালো। দেখলাম দায়িত্বে যাকা কম বয়সি দুইছেলে চোখ কজলাতে কজলাতে দোর খুলে দিল। আমরা যে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে চলেছি ঠিক তার দুহাত দূরে মেঝেতে বিছানা করে ঘুমচ্ছিল এরা। যে যেখানেই ঘুমুগ্যে না, আমরা পয়সা দিয়ে ভালো পরিসেবা পেলেই হলো। পাশ কাটিয়ে ওপরে উঠে গেলাম।
এখানে আমার অর্ধাঙ্গিনী নেই। ঘর বাছাইয়ের প্রশ্ন ওঠে না। সবাই জানে আমি সাহিত্যমনস্ক মানুষ। যে ঘরটাই পাবো তাতেই খুশী। আমাদের কক্ষ পড়েছে চলতি রাস্তার ধারে। আমাদের বলতে, গোপালদা। আমি দাদা বলেই ডাকি। সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ। আপাতদৃষ্টিতে গুরুগম্ভির। মিশলে বুঝবেন বাইরের খোলশ দেখে মনগড়া ধারণা করা ভুল, তা প্রমাণ হবে।
আমাদের কক্ষের ঝুল বারান্দা আছে। কাচের পাল্লা খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখান থেকে রাঁচি শহরের অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখা যায়। পুরোনো পাকা জরাজীর্ণ বাড়ির পাশাপাশি হাল আমলের ঝকঝকে বহুতল আবাসিক। বিভিন্ন নামে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। যেহারে জায়গার দাম বাড়ছে। প্রোমটারের থাবা থেকে পুরোনো বাড়িগুলো বাঁচানো কতদিন যাবে। আরও কতকিছু মনে আসছিল। এমন সময় দাদা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। শিবু, সকালের ঠাণ্ডায় বেশিক্ষণ থাকা ঠিক না। দাদার কথা অন্যথা না করে ভিতরে ঢুকে গেলাম।
গরম জলে স্নান সারা হয়ে গেছে সবার। বাইরে থেকে চা এনে পানের পর্ব সমাপ্ত। নেতার হাটে দশম ফলস ( Ten Water Fall ) দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। দর্শনীয় স্থানে পৌঁছিয়ে গেলাম। দেখলাম অনেকটা উঁচু থেকে জলের খরধারা প্রবাহিত হচ্ছে। অমি, ডাক্তারবাবু ও ঈশানী অনেকটা নিচুতে নেমে গেলাম। ঝর্ণার জল ছুঁয়ে ছবি তুললাম।
দ্বিতীয়বার পাঁচমুখী বা পঞ্চ ঘাঘ জলপ্রপাত (Panchghagh Water Fall) লক্ষ্য করার মতো। এর বৈশিষ্ট্য আবার আলাদা। এই ঝর্ণাটি যে পাথর খণ্ডগুলো মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে অনেককিছু মনে করিয়ে দেয়। প্রতিটি পাথরখণ্ড আড়ায়াড়ি ভাবে আছে। বিভিন্ন আঙ্গিকে তার অবস্থান। এই পাথরগুলো দেখে আমার যা মনে হয়েছিল সেটাই বলি। সকর্মে যুক্ত ব্যক্তিরা তার প্রিয়বস্তু লক্ষ্য করলে দেখতে পাবে। চকখড়ির আকার। গ্রন্থের আদল। আস্ত কঠের গুঁড়ি। আরও কতো বিচিত্র রূপে পড়ে থাকা পাথরগুলোকে চিন্তিত করে যায় বা কল্পনায় ভেবে নিতে পারি। যেমন বৈকালিক অস্তগামী ভাসমান মেঘগুলো এক দৃষ্টে দেখলে প্রতিমুহূর্তে কতকিছু চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়। তেমন এই পঞ্চঘাঘের পাথরখণ্ডগুলো।
সারাদিনের পাহাড়ি ঝর্ণা দেখার আনন্দ নিয়ে রাঁচি শহরের মধ্যে দিয়ে রাঁচিতে অবস্থিত আবাসের দিকে চলেছি। চারিদিকে আলো ঝলমল করছে। এখন বিবেকানন্দ রকে বিপরীত দিক দিয়ে ফিরছি। বিবেকানন্দের পূর্ণাঙ্গ মর্মর মুর্তি জলের মধ্যস্থলে দণ্ডায়মান। হনুমানজির মন্দিরে সকালে যেখানে ফাঁকা পড়ে ছিল এখন নেই। সেখানে চারচাকার ঠেলা ডালায় গরম পোষাকের ঢালাও ব্যবসা চরছে। তাই আমাদের গাড়ি উলটো দিকের পথে গলির মধ্যে ঢুকেছিল। ভেবেছিলাম সকালের মতো ভুল পথে ঘুরছে নাকি। আমাদের খাবার হোটেল হনুমানির মন্দিরের পিছনে। সরু পথ পেরিয়ে এই হোটেলটি। আমরা খাওয়ার আগে ও পরে পোষাকের বাজারে ঘুরলাম। দামও করলাম। ভীষণ ভালো সোয়েটার অনেক কম দামে এখানে পাওয়া যাচ্ছে। যখন দেখছি একে একে দোকান গুঠিয়ে নিচ্ছে, আমরাও রাত্রি যাপনের জন্য আস্তানার দিকে পা বাড়ালাম। সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে।
২৬শে ডিসেম্বর। দাদা, ভোর পাঁচটায় প্রাতঃভ্রমণে যাওয়ার জন্য ছটফট শুরু করে দিয়েছে। সাহিত্যসম্মেলনে যাওয়া শান্তিনিকেতনে প্রাতঃভ্রমণের ভূত রাঁচিতে ভীষণ ভাবে মাথায় চেপে বসেছে। সেখানেও এই অধম সঙ্গী। আমি বললাম দাদা ওরা এখনো গেট খোলেনি। আমাদের সবাই এখনো ঘুমিয়ে আছে।
-চল, না গেলে খুলে দেবে কি? বাইরে এসে ঘুমিয়ে কাটালে, বাড়িতে থাকতে কি হয়েছে। -আমি তা বলছি না।
-কিছু বলতে হবেনে, চলো নিচে যাই।
হালকা আলোর মধ্যে সাবধানে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে গেলাম। নিজেরাই গেট খোলার নিষ্ফর চেষ্টা চালালাম। যদিও উচিত হয়নি এমন অস্বাভাবিক আচরণ করা। যাইহোক ওপরে উঠে যাবো কিনা ভাবছি। রিসেপশানের ওদিকে থেকে মেঝে ফুঁড়ে কেউ যেন উঠে দাঁড়িয়েছে। ' উধার নেহি' বলে অনেকটা দৌড়ে যাওয়ার মতো করে অন্ধকারের দিকে চলে গেল। আমরা ভাবছি 'উধার নেহি কিউ, ইধার যানা পড়ে গা' বাংলায় কিছু বলে গেলে নিরাপদ বোধ করতাম। ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। কী করব এখন। যে পথে এসেছি, সেই পথে ফিরে যাবো।
এমন সময় ছেলেটি সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আর কোথাও নয়, প্রাতঃকৃত্য সারতে গিয়েছিল।এসে জানালো, সামনের দরজা খোলার এখনো সময় হয়নি। দাদা তাকে হিন্দিতে বুঝিয়ে দিলেন। প্রাতঃভ্রমনের জন্য বাইরে যেতেই হবে। আমি বুঝতেই পারলাম না। দাদা তো নির্মল বাংলায় শব্দগুলো উচ্চারিত করলেন। যেখানে ছিটেফোঁটা হিন্দিভাষার টান নেই। আমাকে তো সুযোগ পেলেই বলেতে ছাড়েনা, 'শিবু লেখালেখি করছ, বাইরে বেরুচ্ছ। একটু আধটু অন্তত হিন্দি বলতেই হবে'। দাদা ছেলেটাকে আচ্ছা করে বোঝাচ্ছিলেন। হোটেলে বিভিন্ন ভাষার মানুষজন নিয়ে কাজ করবার। তাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। বাধ্য হয়ে বাথরুমের পাশ দিয়ে পথ দেখিয় দিল। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। ভাষার বেড়াজালে থেকে মুক্তির স্বাদ পেলাম। এখন পথে বেরিয়ে হনুমানজির মন্দিরের দিকে যেতে থাকলাম। রাতের খাওয়া হোটেলের সামন দিয়ে হনুমানজির বিপরীত দিকে মন্দিরের গা ঘেঁষে চায়ের দোকান। সেখানেও দাদা নির্মল বাংলায় শারীরিক ভাষা সহযোগে দোকানীকে বুঝিয়ে দিলেন। 'দু'কাপ চা দিন আমরা এখানে খাবো। দশ কাপ আপনাদের কোনো জায়গায় দিন নিয়ে যাবো। আমরা পনেরো জন নটরাজ হোটেলে আছি। আরও অনেক চা লাগবে। বোঝানোর পালা প্রায় শেষ, এখন অপেক্ষায় থাকা।
এই সুযোগে দুএকটি কথা জানিয়ে রাখি। হনুমানজির মন্দির বলছি বটে। আদপে কয়েক তলা বিল্লিং। যখন বাদ্যযন্ত্র বাজে বহুতল কাঁপে। এই কাঁপন ভক্তদের কাঁপায় বলে তো প্রণামিতে কৃপণতা করার অবকাশ থাকেনা। মন্দিরের সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখেছি। একভদ্রলোক শেতবস্ত্র পরিবৃত হয়ে, হাতে চামর নিয়ে মনে হয় ছোটছুটি করছে ভিতরে। কী বলব কাশ্মীরী আপেলের মতো গায়ের রঙ। আর ভক্তদের রুক্ষ্ণ শরীর না হলে তো ভক্তি মাঠে মারা যাবে। ধর্মব্যবসায় কতকিছুর প্রয়োজন হয়। ভাবলে অবাক হতে হয়।
এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সকালে এখানে পাইকারি সবজির বাজার। এখন থেকে ছোট ছোট দোকানীদেরে প্রয়োজন মতো কিনে নিয়ে যায়। সারাদিন ফাঁকা পড়ে থাকে। সন্ধ্যায় মন্দিরের ওপারে গরম পোশাককের অস্থায়ী দোকান আগের দিন জেনে গেছি। আমরা চা বিস্কুট খেয়ে, ফ্লাক্সে চা নিলাম । এখন ওপরে ওঠার মুক্ত দরজা পেয়ে গেলাম। ততক্ষণে নটরাজে নটরাজের নৃত্য শুরু হয়ে গিয়েছে। ঈশানী অস্থির করে তুলেছে, দাদাই দাদাই করে। দাদাকে দেখে শান্ত হলো।
কাজলদি দুজনের দেখে জানতে চাইল, বাবুরা সব কোথায় গেছেলে। যখন জানল সকালে বেড়াতে গিয়ে ছিলাম। চা বিস্কুট খেয়ে অল্প চা নিয়ে এসেছি। এই চা'য়ে সবার হবেনা। আরও চা আনতে হবে। আমি যেতে রাজি, দাদা আমাকে একা ছাড়বে কী করে হিন্দি বলয়ে।
চায়ের সঙ্গে যার যা সঙ্গে ছিল খেয়ে নিচে নেমে এলাম। আমাদের গাড়ির চালক ইমরানদা। আমার নাম যে শিবু জেনে গেছে। রাঁচির প্রাক্তন মূখ্যমন্ত্রী শিবু সোরেন। আমাকেও শিবু সোরেন নামে মজা করে ডাকতে শুরু করেছে। আমিও মুচকি হেসে উপভোগ করছি। যাইহোক দুটো গাড়ি ভ্রমণের জন্য বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। আমরা হুড্রু ওয়াটার ফলস (Hundru Water Fall) দেখার জন্য মূল জায়গায় পৌঁছে গেলাম। এখন ঝর্ণা দেখতে যাওয়ার জন্য যাওয়া-আসায় মোট ১৪৮৪ টা পোটে ভাঙতে হবে। শুনে প্রথমে দিদি ও পীযুষাবু না করে দিল। অনেকেই মনের জোরে নামতে শুরু করলেও শেষ পযর্ন্ত নামতে পারেনি। অতৃপ্ত মনে উঠে আসতে হয়েছে।
আমি নেমে গিয়েছিল শেষ ধাপে। যেখানে সবাইকে দাঁড়িয়ে দু'দণ্ড ভাবতে হবে এবার কী করবে। 'ওই দেখা যায় বাবার মন্দির-' বলে প্রণাম করে ফিরবে। না ঝর্ণা প্রপাতের তলদেশে গিয়ে দাঁড়াবে। বিপদ যদি হয়, সেই বিপদের সম্ভবনা এবার প্রবলভাবে রয়েছে।ঈশানী পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ডাক্তারবাবু প্রায় কাছেই আছে। মেয়ে বাবার কাছে আবদার করললো ঘুর্ণিয়মান চাকতির ওপর দাঁড়িয়ে রানিং ক্যামেরায় ছবি তুলল। ঈশানী টাইটানিকের নায়িকা যেভাবে দুদিকে হাত মেলে ছুটন্ত জাহাজে দাঁড়িয়ে ছিল তেমন পোজ দিয়েছে। ছবি তোলা হয়ে গেলে মনে হবে। আমাদের বড়মেয়ের চারদিকে পুরো পাহাড় গাছপালা সমেত ঘুরছে। এই বয়সে এরা তুলবে না তো ষাট পেরিয়ে যাওয়াদের মতো ভয়ে কুঁকড়ে থাকবে। ছোটদের নিষেধের বেড়িতে আটকে রাখলে তারা তা মানবে কেন।
চাকতিতে ঘুরে ছবি তোলা বিপদের ছিলনা। ওই ঘুর্ণিয়মান চাকতি বসানো ছিলো ভগ্ন পাহাড়ের কানা ঘেঁষে। মেয়ের ছবি তোলা শেষ। আমি এই সময়টায় ভাবছিলাম কী উপায়ে অসংখ্য ভ্রমণার্থী গভীর খাদে ওপর থেকে ঝরে পড়া ঠান্ডা ঝর্ণার জল নিয়ে কতভাবে যে জলকেলি করছে। কঠিন হলেও সহজে নামার পথে তখনও আবিষ্কার করে উঠতে পারিনি। ঈশানী যেদিকে ঘুরছিল, এদিকে টুকরো টুকরো পাথরখণ্ডের ওপর দিয়ে অনেকেই নামতে দেখে আমিও দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। মেয়ে বলল,ও শিবুমামা চলো ওদিকে যাই। হ্যাঁ বলে পা বাড়িয়ে দিলাম।
আর পেছনে তাকানোরও সময় নেই। দুজনের মনের ইচ্ছে ওই ঝর্ণার তলায় যাওয়ার। একের পর এক পাথরখণ্ডের ওপর দিয়ে দুজনে চলেছি। এক পাথরে দুজনে নেই। এগিয়ে চলেছি আমি, মেয়ে পেছনের পাথরে। মেয়ের পায়ে সু। আমার পায়ে নতুন চামড়ার জুতো। জুতার তলার খাঁজ ক্ষয়ে জায়নি। মেয়েকে বলে দিয়েছি। হঠাৎ শরীর টলে গেলে হাত ছড়িয়ে বসে পড়বে। যেন পাকা প্রশিক্ষকের ভূমিকায় নিজেকে ভাবছি। সামনে পেছনে তাকাতে তাকাতে পা ফসকে অল্পের জন্য বিপদমুক্ত হলাম। একটু থেমে আরও একটি পাথরখণ্ডে পা বাড়াতে যাবে আপাতত থেমে গেলাম। ওপর থেকে আমার নাম ধরে বলছে, ফিরে যাওয়ার জন্য। কার গলা আবার - দাদার। আর দু'তিনটে পাথরের চাঁই পার হলে আমাদের উদ্দেশ্য সফল হয়। দাদা তো পোটের সংখ্যার শুনে নামতে নারাজ ছিল। ওইযে বাৎসল্য কতটা দুর্বল করে করে দিতে পারে এই মানুষটাকে না দেখলে বুঝতে পারবেন না। দুটো মেয়ে কৌশানী ও ঈশানী বাবা মায়ের সঙ্গে গেলেও দাদাইয়ের মনে সর্বদা সংশয়। ঠিক চলে এসেছে। আমি ঈশানীকে বললাম। মেয়ে তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে থাকো। আমি একা ঘুরে আসছি। পারলে ওখান থেকে ছবি তুললে তুলতে পারো।
যেভাবে নেমেছিলাম সেই ভাবে ওপরে দুজনে উঠে গেলাম। কৌশানী ঝাঁকে মিশে গেল। কিছু কেনাকাটায়, খাওয়াখায়িতে সঙ্গীদের অনেকে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমি কোথাও হ্যাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনা। ধাপে ধাপে একাই এগিয়ে চলেছি। যা ভালো লাগছে ছবি তুলছি। পথের চওড়া রেলিংএ আশপাশের পাহাড়ি বন থেকে সংগ্রহ করা গামার কাঠ। সেই কাঁচা কাঠে তলোয়ার তৈরি করে সাজিয়ে রেখেছে বেচার জন্য। সংগ্রহ করে আনা ফল, ফুল ছাড়াও স্থানীয় কতকিছু জিনিস পত্র বেচার জন্য খরিদ্দারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এইসব দোকান যারা দিয়েছে তাদের দেখে আমার মনে হলো অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষজন। আর্থিক অনটনের মধ্যে জীবন যাপন করে।
এক বাচ্চা মেয়ে হাত বাড়িয়ে কিছু চাইছে না। ছোট্ট কাঠের টুকরো যাকে সে তলোয়ার বলছে। কিছু শিল্পীর ছবির তলায় না লিখে দিলে কীসের ছবি বোঝা যায়না। ওই বাচ্চা মেয়টি অস্পষ্ট ভাষায় তলোয়ার না বললে সত্যি কিছুই বুঝতাম না। তলোয়ার নামক কাঠের টুকরো দশ টাকায় আমার কাছে বেচতে চায়। ইচ্ছে না থাকলেও দশ টাকা দিয়ে ওটা কিনে বাড়িতে এনেছিলাম। আমার ওই মেয়টির বয়সি নাতি খেলনা মনে করে কী খুশী না হয়েছে। কদিন ওটাই হাতছাড়া করেনি। শয়ণে, স্বপনে, খেলার অঙ্গনে হাতের কাছে রাখত।
আমি তলোয়ার ছাড়া আর কিচ্ছুটি কিনিনি। হিড্রু জলপ্রপাত দেখে বা না দেখে সবাই একত্র জড়ো হলাম। ওখানকার পথের হোটেলে খেয়ে গাড়িতে বসলাম। এখন চলেছি জোহানা ওয়াটার ফলস (Jonhana Water Falls) দেখার জন্য। আমরা গন্তব্যে পৌঁছে ওখানকার দোকানীদের থেকে ফলমূল কিনে খাওয়ার ব্যস্ততায় কিছুটা সময় কাটালাম। এবার ধাপে ধাপে ওপরে উঠে দেখলাম সুন্দর পার্ক বানানো। পার্কের ভিতর থেকে এগিয়ে গেলাম ঝর্ণা দেখার জন্য। বাঁদিক ঘুরে পাহাড়ের গা কেটে তৈরি পথ দিয়ে এগিয়ে চলেছি কতো নিষেধ নির্দেশিকা মেনে। প্রথম বুঝতেই পারিনি ঝর্ণা কোথায়। কতদূর গেলে দেখতে পাবো। আমাদের পনেরো জনের কে কার সঙ্গে কোথায় ছড়িয়ে পড়েছে বোঝা যাচ্ছে না। এমন অন্য কোথাও হয়নি। শারীরিক অক্ষমতা মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি দেখছি সামনে দিদির সঙ্গে অনেকে বসে আছা। সামনে একটা দল এগিয়ে গেছে। আমি সামনে পেছনে না ভেবে একাই চলতে শুরু করেছি। বুঝে ফেলেছি এখানে দ্বিতীয় পথ নেই। যারা বসে আছে,আর যারা ঝর্ণা দেখতে গেছে তাদের জন্য অপেক্ষা করবেই। পৃথিবী গোলের তথ্য এখানে খাটবে।
আমি গাছপালার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম খুব উঁচু থেকে ঝর্ণার জল ঝরে পড়ছে। আমার মনে হলো হুড্রুর থেকেও অনেক উঁচু। সামনে ঝুলন্ত সাঁকো। দেখতে পাচ্ছি পিঁপড়ের সারের মতো দর্শনার্থীরা যাতায়াত করছে।এই ঝুলন্ত পাহাড়ি পথে দুই পাহাড়ের মানুষজন যাতায়াত করতে পারে। এক সময় মাওবাদীরা ওই পথটাই নিজেদের কাজে লাগিয়েছে। আমি আর এগিয়ে না গিয়ে মাঝ পথে পায়ে হাঁটা পথ দিয়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে গেলাম। ওই ঝর্ণার জল বয়ে চলেছে আমার সমন দিয়ে। একদম কাছে না গেলেও স্পষ্ট ঝর্ণা দেখতে পাচ্ছি। পাথরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি। জলে হাত দিয়ে দেখছি বেশ ঠাণ্ডা। পা ডুবিয়ে নিলাম। কতটা সময় পেরিয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। কে কোথায় আছে জানিনা। এখন আমি একা, সত্যি আমার একা লাগছেনা। গাছপালা পাথর, মাথার ওপর খোলা আকাশ, পায়ের তলায় প্রবাহিত শীতল জলধারা আমার আপন হয়ে উঠেছে।
হঠাৎ ঘোর কেটে গেল। কে কোথায় অপেক্ষা করছে বুঝতে পারার কথা নয়। তাড়াতাড়ি সংকীর্ণ পাথরের চাঁইয়ের ফাঁক গলে ওপরে উঠে এলাম। ফেরার পথের দিকে এগিয়ে যেতে দেখলাম দিদির উদ্বিগ্ন। কী ব্যাপার জানতে চাইলাম। মানতু,মহুয়া তারা কোথায়? ওই পথ দিয়ে নামতে তো দেখলুম ওদের। আমার মতো নিচে নামার পাগলামীতে পেয়ে বসেছে। অনেক্ষণ বলছে, দুটো মেয়ের তো যাওয়া উচিত হয়নি। আবার ফোন ধরছে না। কী হলো বুঝতে পারছিনা। অতো গড়েনে কেউ নামতে সাহস পাচ্ছে না। আমি বললাম নেমে দেখছি কোথায় গেছে। চারদিকে নজর রেখে সাবধানে নামছি। ওইতো প্রবাহিত ঝর্ণার শীতল জলধার পাথরের নুড়িতে ধাক্কা খেতে খেতে বয়ে চলেছে। আর কোথায় নেমে খুঁজবো। তবে বেশ কয়েটা বড়ো পথরখণ্ড সামনের কিছুটা জায়গা আড়াল করে আছে। আমি তার ওপর দিয়ে খাদের জল দেখছিলাম। নিচের দিকে লক্ষ্য পড়লো গায়ের সোয়েটার ঝাঁটি গাছের ওপর পড়ে আছে। বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে উঠলো। কাউকে তো দেখতে পাচ্ছি না। দিদির কাছে ফোন করেছি। কানে রিংএর শব্দ শুনতে শুনতে চলেছি। তেমন হলে ফোন কেড়ে নেওয়ার আগে দুঃসংবাদ জানাতে পারব। পাথরের বাধা দৃষ্টি থেকে সরে যেতে দেখি মানতু ডুবন্ত পাথরে বসে আছে, ঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে। দুহাতে জল ছিটুচ্ছে। কি বলব, কী সুন্দর দেখতে লাগছে। যেন কোন রাজকন্যা সখীর সঙ্গে নিয়ে জলখেলা করছে। গুঠিয়ে নেওয়া বসনে মুক্ত চরণ স্বচ্ছ জলে মুক্তর মতো মনে হচ্ছে। তবে সঙ্গীটি জল খেলছে না। সম্ভবত ঘষে পায়ের ময়লা তুলছে। দেখে মনে হলো সময়ের অপচয় করেন না। এতো দূরে এসেও হিসাব বরাবর রেখেছেন। নতমুখে উভয় নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত ছিল। মনে হলো আমাকে দেখতে পায়নি। আমি তৎক্ষণাৎ মুখ ঘুরিয়ে ওপরে উঠে আসতে চাইলাম। মানতু আমাকে ডাকল, ও- শিবেনদা, চলে যাচ্ছো? ওরা আমাকে ঠিক লক্ষ্য করেছে।
- তোমাদের খুঁজতে এখানে আসা। তবে এসো আমি যাই।
- কী যাই, আমাদের ছবি তুলবে না।
- বললে তুলব। আমি নিচে নেমে ওদের কাছাকাছি গেলাম। মানতুর কতরকমের ভঙ্গিমায় ছবি তুলতে হলো। মহুয়া বোনের ছবি না তোলার অর্থ একযাত্রায় পৃথক ফল, তা কি করে সম্ভব। ছবি তোলার সময় কোনপ্রকার অঙ্গভঙ্গীর অবতারণা করেননি। ছবি তুলতে হয় তাই তোলা। খুব সাদাসিদে মনের। আর মানতু ভীষণ আমুদে, হাসিখুশিতে থাকতে অভ্যস্ত।
জোহনা জলপ্রপাতের দিক থেকে এসে বাড়ির পথে গেলাম না। বিপরীতে এগিয়ে গেলাম। সবাই খাদের পথ ধরে নিচে নামার সাহস দেখায়নি। পথের পাশে লেলিংএর ওপর বসে আনন্দ উপভোগ করছে। আমার একই গোঁ নিচে নামার। ডাক্তারবাবুকে সঙ্গে নিয়ে বাঁধে মতো সরু পাথুরে পথে এগিয়ে গেলাম। এখানে রোপওয়ে সিষ্টেমে আছে। অনেক উঠছে। এখন বুটু থাকলে ঈশানীকে আটকানো যেতো না। পথরের ওপর দিয়ে জলাধারের কাছে তো যেতে পারি। মেয়ের ওখানে যাওয়ার ইচ্ছা। এখানে দাদার নিষেধ থেকে অনেকটা দূরে আছি। ডাক্তারবাবুর কথায় ঈশানী থামবে না। বেলা ডুবতে বসেছে দুঃসাহসিকতা দেখানো ঠিক নয়। মেয়েকে বললাম যাওয়া ঠিক হবেনা। চলো ফিরে যাই। ৪:২৪শে গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি ছুটল হোটেল নটরাজে। চলার পথে মহেন্দ্র ধনির বাড়িটি দেখে নিলাম।
২৭শে ডিসেম্বর। ৯:৪২শে সূচি অনুযায়ী ভ্রমণ শুরু হলো। প্রথম রাঁচির মানসিক রুগীদের হাসপাতালে। আমাদের দুটো গাড়ি গেট দিয়ে ঢুকলো তবে নামার অনুমতি ছিল না। বিশাল এরিয়া। ওখান থেকে বেরিয়ে গেলাম। ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শিবু সোরেন তাঁর বাড়ি পেরিয়ে রক গর্ডেনে ঢুকলাম। একনজরে ঘুরে নিলাম। এবার পাত্রাতু লেক (Patratu Lake Resort. Patratu) ঘুরলাম। পরিপাটি করে সাজানো।
আদিবাসীর যুগলমুর্তি দেখার মতো। যেন শিল্পীর তৈরি নয়। টিকিট কেটে হাইস্পিড বোটে লেকের মধ্যবর্তী পর্যন্ত পাক দিয়ে এলাম। বিশাল এরিয়া নিয়ে এই জলাধারটি। দেখলে ভয় পাওয়া মতো বটেই। ফেরার পথে কিং রেষ্টুরেন্টে ওই পাত্রাতু লেকের থেকে ধরা মাছ আর ভাত খেয়ে নটরাজে ফিরলাম। রাতে অর্ডার দিয়ে খাসির মাংস ভাত খেয়ে সেই রাতটা হোটেলে কিটালাম।
২৮শে আগষ্ট। সকল ৬:৩০শে চলেছি বেতলা ন্যাশানাল পার্ক (Betla National Park) অভিমুখে। এখন গভীর জঙ্গলের মধ্যে। ট্রেন লাইনের আগে গড়ি সারবেঁধে গড়ি দাঁড়িয়ে গেল। শুনলাম মালট্রেন পার হবে। দীর্ঘ সময় নিয়ে একটি মালট্রের জুড়ি পেরিয়ে যাওয়ার পরেও দেখছি গেট খুলছে না। রাঁচির দিক থেকে আসা আরও একটি পার হলে তবেই খুলবে। ঘন জঙ্গলে হাড়হিম করা পরিবেশ। এইসব দুর্গম জঙ্গলে দুস্কৃতির আড্ডা। তারা এমন সুযোগে নিজেদের কাজে লাগায়। যাক গেট উঠে গেল, গাড়ি চলতে শুরু করেছে। নানা ভাবে পথে অনেকটা সময় হয়ে গেল। এদিন আর বেলতা ফরেস্ট দেখা হলোনা। তেলতা ফরেস্টর বিশাল গেটের সামনে হাইওয়ে। ওই রাস্তা পেরিয়ে হোটেলে পার্ক ভিউতে ( Hotel Park View) বতর্মানে থাকার জায়গা। দুখানা বাথরুম সহ হলঘরে ( Dormitory) রানিং এগারো খানা বেডের ব্যবস্থা।আছে। আমরা পনেরোজন একে একে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলাম। এখানে বেশ ঠান্ডা অনুভব করছি। কাচ দুটো জানালায় ভাঙা। আপাতত কাগজ দিয়ে আটকানো হলো। অফিসে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পীযূষবাবু থাকবেন আর মজা হবেনা তা কি করে হয়। কার কোথায় ত্রুটি সেই নিয়ে ঘোটপাকিয়ে মজা করার উপাদন বের করেই তবে ছাড়বে। এইভাবে একঘরে থাকার এটাই সবচেয়ে আনন্দ উপভোগের মজাদার ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। দীপ রেষ্টুরেন্টে থেকে রাতের খাবার দিয়ে গেল। খেয়েদেয়ে যেযার নিদিষ্ট জায়গায় ঘুমিয়ে পড়লাম।
২৯শে আগষ্ট। বেতলা ফরেস্ট সাফারি, ৭:৩০ থেকে ৪:৩০ এই সময়ের মধ্যে দেখাশোনা করিয়ে গেটের বাইরে ছেড়ে দিল। জিমকরবেট জঙ্গলের থেকে বেশ খোলামেলা। অনেক দূর পযর্ন্ত দেখা যায়। হরিণ আমাদের কাছাকাছি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কয়েকটি বুনো শেয়ার রাত-দিন গুলিয়ে ফেলেছিল। আমাদের প্রথম গাড়ি যেতে দেখে ছুটে পালালো। বানরের লাফালাফি বনের থেকে সদর রাস্তায় গেটের সামনে বেশি। বানরের দৌরাত্যিতে হাতে কিছু রাখার উপায় নি। তবে দিয়ে খাওয়ার অভ্যাস যাদের নেই, তাদের লুকিয় চুরিয়ে খেতে কষ্ট হয় এইযা।
এবার দীপ রেষ্টুরেন্ট থেকে টিফিন খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম, সবাই নয়। ডেলটাগঞ্জের দুবিয়া খাঁড় মার্কেট এবং পরসা নদী তার ওপর দীর্ঘ ব্রিজ দেখার মতো। বালি মাড়িয়ে নদীর জলের ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। পা ডুবিয়ে কিছু দূর পযর্ন্ত হাঁটলাম। স্বচ্ছ জল হাতে মুখে দিলাম। যে যার মতো ছবি তুলে ডেরায় ফিরে এলাম।
দুপুরের খাওয়া সেরে পালামৌ ফোর্স দেখার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। মূল রাস্তা
ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের রাস্তায় চলেছি। সরু ঢালাই পথ। রাস্তার ধারেই সাধারণ মানুষের বাড়ি। ধারের ক্ষেত । সবজির বাগান। ক্ষেত খামারে মেয়ে মদ্দ কাজে ব্যস্ত। গাড়ির মধ্যে দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি। বেশ ভালো লাগছিল দেহাতি গ্রাম্যচিত্র দেখতে। গ্রাম ছাড়িয়ে যাওয়ায় আর ঘরবাড়ি চোখে পড়ছে না। ঘন বনের মধ্যে ঢুকছি ক্রমশ। দুদিকের ঘন ঝাঁটি গাছ যেন ভিতরে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে। কেন জানিনা তেমনটাই মনে হচ্ছিল।
ফিরতি গাড়ি সামনে আসতেই কেউ কাউকে পথ ছাড়তে পারছিল না। সরুপথ দিয়ে গুতাগুতি করে পার হয়ে গেল। আমাদের দুটো গাড়ি এক পদ্মপুকুরের কাছে দাঁড় করালো। এই পুকুরটিতে এক সময়ে রানি স্নান করত। পাহাড়ের ওপর এই ঐতিহাসিক পুকুর দেখার জন্য সুন্দর ওয়চটাওয়ার বানানো হয়েছে। আমরা অনেক চক্কর কেটে আসলাম। এবার পালামৌ ফোর্ট দেখার পালা।
ভ্রমনার্থীরা প্রথম যেখানে এসে সবাই দাঁড়ায়। আমরা সব্বাই সেখানেই এসে দাড়ালাম। ছাদ খোলা বেশ চওড়া চওড়া প্রাচীর কয়েক মানুষ উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর ভেতর যাওয়া যাবে না গাছের জঙ্গল বসে গেছে। আমাদের ঘোরাফেরার মধ্যে চোখে পড়ল পাথুরে সিঁড়ি দেখে বুঝলাম উপরে ওঠা যায়। আমি,ডাক্তারবাবু,কৌশানী সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠলাম। তলাতেই বোঝা যায় না। প্রাচীরগুলোর মাথা বেশ চওড়া পথ। পথের ধারে এমনভাবে ঘেরা ওপর থেকে নিচে দেখা যাবেনা। নিচে থেকে কেউ আছে বোঝার উপায় নেই। সন্ধানী দৃষ্টিতে নিজেদের মতো ধারণা অনুভব করে নেমে এলাম। তবে মন চাইছিল না নামতে। আর কিছুক্ষণ থাকার ইচ্ছে ছিলো।
এই ধংসাবশেষের বিপরীতে চলতি পথে দাঁড়ালে পাহাড়ের অতোটা উপরে বিশাল পাথুরে বাড়ি প্রায় অক্ষত। ওঠার তেমন ভালো পথ নেই। পূর্বে এখনকার মতো পাথরের টুকরো ছড়ানো ছিল, না তাও কী করে বলব। তলায় কয়েকটি সুড়ঙ্গ দেখেছি। ভিতরে খানিকটা ঢুকে বেরিয়ে আসি। সম্ভবত ওখানথেকেই ওপরে ওঠার পথ আছে বলে আমার ধারণা। যাইহোক লড়াই করে ওপরে উঠে আমরা তিনজন কী দেখলাম সেটাই বলি। সামনে অনেকটা প্রসস্ত জায়গা। সমান্তরাল দীর্ঘ প্রাচীর। দশফুট উচ্চতায়, ছয়ফুটের মতো চওড়া কপাট। দরজা নষ্ট হয়নি। গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম ছমছমে, থমথমে ভাব নিয়ে। ভেতরের ঘরগুলো দেখে গৃহস্থালির বলে মনে হলনা। আমরা প্রথমে যেখানে উঠেছিলাম হলে ওটাই রাজাবাড়ি। এখন থেকে নজরদারী করার মূল ডেরা। আমরা এখানেও পাথুরে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠেছি। বাইরে প্রাচীর ভাবছিলাম, এতো যেন চীনের প্রাচীর। যেখান থেকে অনায়াসে পাহারা দেওেয়া যায়। আমরা দেখলাম পতাকা দেওয়ার বেদী আছে। যেখানে পতাকার দণ্ড পোতার মতো ছিদ্র করা আছে। আমরা যে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠেছিলাম, দ্বিতীয় সিঁড়িতে নামলাম। এই পালামৌ ফোর্স পুরোপুরি পাহাড়ের শেষ প্রান্তে। আমরা যেদিক থেকে এসেছি সমতল।
আরো অনেক দেখার ছিলো সম্ভব হলোনা। সূর্য ডুবতে বসেছে।এবার ফিরত হবে গভীর জঙ্গল এলাকা ছেড়ে।
২৮শে আগষ্ট। সকল ৬:৩০শে চলেছি বেতলা ন্যাশানাল পার্ক (Betla National Park) অভিমুখে। এখন গভীর জঙ্গলের মধ্যে। ট্রেন লাইনের আগে গড়ি সারবেঁধে গড়ি দাঁড়িয়ে গেল। শুনলাম মালট্রেন পার হবে। দীর্ঘ সময় নিয়ে একটি মালট্রের জুড়ি পেরিয়ে যাওয়ার পরেও দেখছি গেট খুলছে না। রাঁচির দিক থেকে আসা আরও একটি পার হলে তবেই খুলবে। ঘন জঙ্গলে হাড়হিম করা পরিবেশ। এইসব দুর্গম জঙ্গলে দুস্কৃতির আড্ডা। তারা এমন সুযোগে নিজেদের কাজে লাগায়। যাক গেট উঠে গেল, গাড়ি চলতে শুরু করেছে। নানা ভাবে পথে অনেকটা সময় হয়ে গেল। এদিন আর বেলতা ফরেস্ট দেখা হলোনা। তেলতা ফরেস্টর বিশাল গেটের সামনে হাইওয়ে। ওই রাস্তা পেরিয়ে হোটেলে পার্ক ভিউতে ( Hotel Park View) বতর্মানে থাকার জায়গা। দুখানা বাথরুম সহ হলঘরে ( Dormitory) রানিং এগারো খানা বেডের ব্যবস্থা।আছে। আমরা পনেরোজন একে একে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলাম। এখানে বেশ ঠান্ডা অনুভব করছি। কাচ দুটো জানালায় ভাঙা। আপাতত কাগজ দিয়ে আটকানো হলো। অফিসে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পীযূষবাবু থাকবেন আর মজা হবেনা তা কি করে হয়। কার কোথায় ত্রুটি সেই নিয়ে ঘোটপাকিয়ে মজা করার উপাদন বের করেই তবে ছাড়বে। এইভাবে একঘরে থাকার এটাই সবচেয়ে আনন্দ উপভোগের মজাদার ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। দীপ রেষ্টুরেন্টে থেকে রাতের খাবার দিয়ে গেল। খেয়েদেয়ে যেযার নিদিষ্ট জায়গায় ঘুমিয়ে পড়লাম।
২৯শে আগষ্ট। বেতলা ফরেস্ট সাফারি, ৭:৩০ থেকে ৪:৩০ এই সময়ের মধ্যে দেখাশোনা করিয়ে গেটের বাইরে ছেড়ে দিল। জিমকরবেট জঙ্গলের থেকে বেশ খোলামেলা। অনেক দূর পযর্ন্ত দেখা যায়। হরিণ আমাদের কাছাকাছি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কয়েকটি বুনো শেয়ার রাত-দিন গুলিয়ে ফেলেছিল। আমাদের প্রথম গাড়ি যেতে দেখে ছুটে পালালো। বানরের লাফালাফি বনের থেকে সদর রাস্তায় গেটের সামনে বেশি। বানরের দৌরাত্যিতে হাতে কিছু রাখার উপায় নি। তবে দিয়ে খাওয়ার অভ্যাস যাদের নেই, তাদের লুকিয় চুরিয়ে খেতে কষ্ট হয় এইযা।
এবার দীপ রেষ্টুরেন্ট থেকে টিফিন খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম, সবাই নয়। ডেলটাগঞ্জের দুবিয়া খাঁড় মার্কেট এবং পরসা নদী তার ওপর দীর্ঘ ব্রিজ দেখার মতো। বালি মাড়িয়ে নদীর জলের ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। পা ডুবিয়ে কিছু দূর পযর্ন্ত হাঁটলাম। স্বচ্ছ জল হাতে মুখে দিলাম। যে যার মতো ছবি তুলে ডেরায় ফিরে এলাম।
দুপুরের খাওয়া সেরে পালামৌ ফোর্স দেখার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। মূল রাস্তা
ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের রাস্তায় চলেছি। সরু ঢালাই পথ। রাস্তার ধারেই সাধারণ মানুষের বাড়ি। ধারের ক্ষেত । সবজির বাগান। ক্ষেত খামারে মেয়ে মদ্দ কাজে ব্যস্ত। গাড়ির মধ্যে দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি। বেশ ভালো লাগছিল দেহাতি গ্রাম্যচিত্র দেখতে। গ্রাম ছাড়িয়ে যাওয়ায় আর ঘরবাড়ি চোখে পড়ছে না। ঘন বনের মধ্যে ঢুকছি ক্রমশ। দুদিকের ঘন ঝাঁটি গাছ যেন ভিতরে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে। কেন জানিনা তেমনটাই মনে হচ্ছিল।
ফিরতি গাড়ি সামনে আসতেই কেউ কাউকে পথ ছাড়তে পারছিল না। সরুপথ দিয়ে গুতাগুতি করে পার হয়ে গেল। আমাদের দুটো গাড়ি এক পদ্মপুকুরের কাছে দাঁড় করালো। এই পুকুরটিতে এক সময়ে রানি স্নান করত। পাহাড়ের ওপর এই ঐতিহাসিক পুকুর দেখার জন্য সুন্দর ওয়চটাওয়ার বানানো হয়েছে। আমরা অনেক চক্কর কেটে আসলাম। এবার পালামৌ ফোর্ট দেখার পালা।
ভ্রমনার্থীরা প্রথম যেখানে এসে সবাই দাঁড়ায়। আমরা সব্বাই সেখানেই এসে দাড়ালাম। ছাদ খোলা বেশ চওড়া চওড়া প্রাচীর কয়েক মানুষ উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর ভেতর যাওয়া যাবে না গাছের জঙ্গল বসে গেছে। আমাদের ঘোরাফেরার মধ্যে চোখে পড়ল পাথুরে সিঁড়ি দেখে বুঝলাম উপরে ওঠা যায়। আমি,ডাক্তারবাবু,কৌশানী সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠলাম। তলাতেই বোঝা যায় না। প্রাচীরগুলোর মাথা বেশ চওড়া পথ। পথের ধারে এমনভাবে ঘেরা ওপর থেকে নিচে দেখা যাবেনা। নিচে থেকে কেউ আছে বোঝার উপায় নেই। সন্ধানী দৃষ্টিতে নিজেদের মতো ধারণা অনুভব করে নেমে এলাম। তবে মন চাইছিল না নামতে। আর কিছুক্ষণ থাকার ইচ্ছে ছিলো।
এই ধংসাবশেষের বিপরীতে চলতি পথে দাঁড়ালে পাহাড়ের অতোটা উপরে বিশাল পাথুরে বাড়ি প্রায় অক্ষত। ওঠার তেমন ভালো পথ নেই। পূর্বে এখনকার মতো পাথরের টুকরো ছড়ানো ছিল, না তাও কী করে বলব। তলায় কয়েকটি সুড়ঙ্গ দেখেছি। ভিতরে খানিকটা ঢুকে বেরিয়ে আসি। সম্ভবত ওখানথেকেই ওপরে ওঠার পথ আছে বলে আমার ধারণা। যাইহোক লড়াই করে ওপরে উঠে আমরা তিনজন কী দেখলাম সেটাই বলি। সামনে অনেকটা প্রসস্ত জায়গা। সমান্তরাল দীর্ঘ প্রাচীর। দশফুট উচ্চতায়, ছয়ফুটের মতো চওড়া কপাট। দরজা নষ্ট হয়নি। গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম ছমছমে, থমথমে ভাব নিয়ে। ভেতরের ঘরগুলো দেখে গৃহস্থালির বলে মনে হলনা। আমরা প্রথমে যেখানে উঠেছিলাম হলে ওটাই রাজাবাড়ি। এখন থেকে নজরদারী করার মূল ডেরা। আমরা এখানেও পাথুরে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠেছি। বাইরে প্রাচীর ভাবছিলাম, এতো যেন চীনের প্রাচীর। যেখান থেকে অনায়াসে পাহারা দেওেয়া যায়। আমরা দেখলাম পতাকা দেওয়ার বেদী আছে। যেখানে পতাকার দণ্ড পোতার মতো ছিদ্র করা আছে। আমরা যে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠেছিলাম, দ্বিতীয় সিঁড়িতে নামলাম। এই পালামৌ ফোর্স পুরোপুরি পাহাড়ের শেষ প্রান্তে। আমরা যেদিক থেকে এসেছি সমতল।
আরো অনেক দেখার ছিলো সম্ভব হলোনা। সূর্য ডুবতে বসেছে।এবার ফিরত হবে গভীর জঙ্গল এলাকা ছেড়ে।
##################
শিবপ্রসাদ পুরকায়স্থ
ডাক- লক্ষ্মীকান্তপুর জেলা- দক্ষিণ ২৪পরগনা। পশ্চিমবঙ্গ, ভারত পিন-৭৪৩৩৪৫
Comments
Post a Comment