উৎসব : মানুষের চিরন্তন আত্মপ্রকাশ
কৃশানু ব্যানার্জী
মানুষের জীবনে উৎসব কেবল এক দিনের ক্ষণস্থায়ী আনন্দোচ্ছ্বাস নয়; এটি অস্তিত্বের গভীরতম অনুরণন, যেখানে জীবনের নিজস্ব সুর ও ছন্দ আত্মপ্রকাশ করে মহাজাগতিক ঐক্যের প্রেক্ষিতে। সভ্যতার আদিম প্রভাতে মানুষ যখন প্রথমবার নিজের ক্ষুদ্র জীবনকে অনন্তের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করেছিল, তখনই উৎসবের জন্ম। এটি কেবল একটি সামাজিক আচার নয়, বরং মানবচেতনার গভীরতম স্তরে নিহিত এক প্রতীকি উন্মোচন—যেখানে জীবন মৃত্যুকে অতিক্রম করে, ক্ষণ অনন্তের সঙ্গে মিলিত হয়, এবং ব্যক্তি সমাজের সঙ্গে একাকার হয় এক মহা-সৃষ্টির তালে।
উৎসব আসলে মানুষের আত্মস্বরের বহিঃপ্রকাশ—তার অন্তর্গত অস্তিত্বের সংগীত, যা কালের প্রবাহে কখনও ধর্মীয়, কখনও সামাজিক, কখনও সাংস্কৃতিক রূপ ধারণ করেছে। মানুষ যখন অনুভব করে যে জীবন কেবল পরিশ্রম, সংগ্রাম ও বেঁচে থাকার যান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়, তখনই সে সৃষ্টি করে উৎসব—যেখানে সে নিজের সত্তাকে মুক্ত করে দেয়, দুঃখের মধ্যেও আনন্দের, মৃত্যুর মধ্যেও জীবনের সুর খুঁজে পায়। এই মুক্তি কেবল বাহ্যিক নয়; এটি আত্মার অন্তর্গত উল্লাস, যা মানুষকে তার সীমিত সত্তা থেকে উর্ধ্বে তুলে আনে।
উৎসব মানে কেবল গান-বাজনা, সাজসজ্জা বা ভোজন-বিলাস নয়; উৎসব মানে মানুষের চেতনায় লুকিয়ে থাকা ঐক্যের চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা—যেখানে ব্যক্তি ও সমষ্টি, নশ্বরতা ও অনন্ত, মানব ও প্রকৃতি মিলেমিশে যায় এক অবিনশ্বর সংলাপে। এটি মানুষকে শেখায়, যে জীবন কখনও নিছক ভোগ নয়, আবার নিছক ত্যাগও নয়—জীবন আসলে সমবায়ের, সহাবস্থানের, এবং সৃষ্টির আনন্দে পরিপূর্ণ এক দার্শনিক যাত্রা।
উৎসব মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক চিরন্তন আত্মপ্রকাশ—যেখানে মানুষ নিজেকে খুঁজে পায়, আবার হারায়ও বৃহতের বুকে। উৎসব মানুষকে বারবার স্মরণ করায়, যে তার অস্তিত্বের পরম অর্থ নিহিত আছে মিলনের মধ্যেই, বিভেদের নয়; আলোকের আকাঙ্ক্ষায়, অন্ধকারের নয়; আর সেই চিরন্তন মিলনের মুহূর্তেই জীবন তার প্রকৃত ব্যাখ্যা লাভ করে—উৎসব হয়ে।
দর্শনের দৃষ্টিতে উৎসব কেবল একটি সামাজিক পর্ব বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়; এটি মানবচেতনার উল্লম্ফন—দৈনন্দিনতার যান্ত্রিক সীমা অতিক্রম করে এক পরাবাস্তব আনন্দসন্ধানের পথে যাত্রা। মানুষ যখন প্রতিদিনের জীবনচক্রে—শ্রম, দুঃখ, ক্লান্তি ও সংগ্রামের অবিরাম পুনরাবৃত্তিতে—নিজের অস্তিত্বের অন্তর্গত সুর হারিয়ে ফেলে, তখন উৎসব আসে সেই জীর্ণ ছন্দকে ভেঙে দিয়ে প্রাণে নব উচ্ছ্বাসের সঞ্চার ঘটাতে। উৎসব যেন মানুষের সত্তার অন্তর্লীন স্পন্দনের এক দার্শনিক বিদ্রোহ—যেখানে অস্তিত্ব আবার নিজের অর্থ উদ্ধার করে আনন্দের মধ্য দিয়ে।
ফ্রিডরিখ নীৎসে এই উল্লম্ফনকেই মানবজীবনের অপরিহার্য শর্ত হিসেবে দেখেছিলেন। তাঁর ভাষায়, "Life without festival is a mistake." নীৎসের ধারণায়, উৎসবই মানুষকে অ্যাপোলোনীয় শৃঙ্খলা ও যুক্তির শুষ্ক কাঠামো থেকে মুক্ত করে ডায়োনিসীয় উন্মাদনায় প্রবেশ করায়—যেখানে মানুষ কেবল চিন্তাশীল সত্তা নয়, অনুভবশীল ও সৃষ্টিশীল প্রাণী হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করে। উৎসব তাই যুক্তির একঘেয়েমি থেকে মুক্তির প্রতীক; এটি মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে বুদ্ধির বাইরে আরেকটি বৃহত্তর ক্ষেত্র আছে—যেখানে জীবন নৃত্য করে, রক্তে আলো জ্বলে, আর অস্তিত্ব হয়ে ওঠে সংগীত।
ভারতীয় দর্শন এই পশ্চিমা ভাবনাকে অন্যরূপে, কিন্তু অধিক গভীরতায় প্রকাশ করেছে। উপনিষদের উক্তি—"আনন্দাদ্ভূতানি ভূতানি জায়ন্তে"—অর্থাৎ, এই সমগ্র সৃষ্টির মূল উৎসই আনন্দ। ব্রহ্মান্ডের আদিম স্ফুরণ এক ধরনের ঐশ্বরিক আনন্দের প্রকাশ, এবং মানুষ, সেই সৃষ্টির উত্তরসূরি হিসেবে, নিজের অস্তিত্বেও সেই আনন্দের অনুপ্রবাহ অনুভব করে। তাই উৎসব কেবল বাহ্যিক আচার বা সামাজিক প্রথা নয়; এটি সেই সৃষ্টির অনিবার্য প্রতিফলন, যার মধ্যে দিয়ে মানুষ নিজেকে ও বিশ্বকে একীভূত করে।
মানুষ যেমন সৃষ্টি করে, তেমনি উদযাপন করে। সৃষ্টি ও উদযাপন—দুটি একই চেতনার দুই প্রান্ত। সৃষ্টিতে মানুষ নিজেকে প্রকাশ করে, আর উদযাপনে সেই প্রকাশের আনন্দকে অনুভব করে। উৎসব এই দ্বন্দ্বের মিলনবিন্দু—যেখানে মানুষ কেবল বলে না "আমি আছি," বরং ঘোষণা করে, "আমি আছি, তাই আনন্দিত।" এই ঘোষণাই মানুষের চিরন্তন আত্মস্বীকৃতি—যা তাকে দৈনন্দিনতার ক্লান্ত নিরসতা থেকে তুলে আনে আত্মজাগরণের উচ্চতর স্তরে।
অতএব, উৎসবের দার্শনিক পরিক্রমা আসলে মানবচেতনার বিবর্তনের ইতিহাস। এটি সেই বিন্দু, যেখানে বেদনার অন্তরাল থেকে জন্ম নেয় সৃষ্টির আনন্দ, আর সীমার ভেতর থেকেই উদ্ভাসিত হয় অনন্তের সুর। উৎসব সেই অনন্তেরই মানবীয় প্রতিধ্বনি—অস্তিত্বের গভীরতম সংগীত, যা মানুষ যুগে যুগে নতুন রূপে, নতুন ভাষায়, নতুন বিশ্বাসে পুনরায় আবিষ্কার করে চলেছে।
মানুষের ইতিহাস আসলে উৎসবের ইতিহাস। প্রাগৈতিহাসিক যুগে যখন মানুষ প্রথম কৃষিকাজ শিখল, তখনই সে প্রথম উৎসবের স্বপ্ন দেখল—ফসল তোলার পর মাটির প্রতি, সূর্যের প্রতি, জলের প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রকাশ ঘটল। এই কৃতজ্ঞতা থেকেই জন্ম নিল নববর্ষ, পঞ্চমী, পৌষ-পার্বণ।
সভ্যতা যত উন্নত হয়েছে, উৎসবের প্রকৃতি ততই রূপান্তরিত হয়েছে। তবে মূল লক্ষ্য অপরিবর্তিত—মানুষের মধ্যে যে প্রাকৃতিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক সুর রয়েছে, তাকে একত্রীকরণ করা। একদিকে যেমন সমাজের অভ্যন্তরীণ বন্ধন দৃঢ় হয়, অন্যদিকে ব্যক্তির মনেও জাগে অনন্তের অনুভূতি।
উৎসব তাই সামাজিক ঐক্যের রসায়ন। গ্রামবাংলার দোল, নবান্ন, বর্ষাবরণ—সবই কৃষির সঙ্গে জড়িত; আবার দুর্গাপূজা, কালীপূজা, ঈদ, বড়দিন—সবই মানবসম্পর্কের উৎসব। সমাজতাত্ত্বিক এমিল দুর্খাইম বলেছিলেন যে,- ভেতরকার শক্তিগুলিকে একত্রিত করে, নতুন করে প্রাণসঞ্চার করে উৎসব।
উৎসব প্রায়ই ধর্মের ছত্রচ্ছায়ায় বিকশিত হয়েছে, কিন্তু তার পরিসর ধর্মের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। ধর্মের মূল উদ্দেশ্য যেমন মানবাত্মাকে দেবত্বের সঙ্গে যুক্ত করা, তেমনি উৎসবের লক্ষ্যও সেই ঐক্যকে অনুভব করা।
দুর্গাপূজা, উদাহরণস্বরূপ, কেবল দেবী আরাধনা নয়—এটি এক মানবিক নাট্যমঞ্চ, যেখানে সৃষ্টির, সংহারের ও পুনরুত্থানের প্রতীকী ভাষ্য মেলে। মহালয়ার ভোর থেকে শুরু হয়ে বিজয়ার বিকেল পর্যন্ত এই উৎসব মানুষকে বারবার স্মরণ করায়—ধ্বংসই শেষ নয়, ধ্বংস থেকেই জন্ম নেয় পুনর্গঠন।
তেমনি দীপাবলি অন্ধকারে আলোর প্রতীক, ঈদ মিলন ও মমত্বের, বড়দিন করুণার। এইসব উৎসব মানবচেতনার সেই গভীর স্থানে পৌঁছায়, যেখানে ব্যক্তি আর সমাজ, ধর্ম আর মানবতা একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে।
সুতরাং বলা যায়, উৎসব ধর্মের বাহন হলেও, তার প্রকৃত তাৎপর্য ধর্মোত্তর—অর্থাৎ, মানবতার সার্বজনীন উৎসবে মিলিত হওয়া।
মানুষ জানে সে মরণশীল, জানে প্রতিটি দিন তাকে ক্ষয়ের দিকে টেনে নিচ্ছে। কিন্তু তবুও সে নাচে, গায়, সাজে—এই বিপরীতধর্মী আচরণের দার্শনিক অর্থ গভীর। উৎসব আসলে মৃত্যুভীতির বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধ।
ঋতুপরিবর্তনের সঙ্গে যেমন প্রকৃতি নবজন্ম পায়, তেমনি মানুষ উৎসবের মাধ্যমে নিজের নবজন্ম ঘটায়। এক অর্থে উৎসব হল সময়কে অস্বীকার করা, মুহূর্তকে অনন্তের সঙ্গে যুক্ত করা।
দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার বলেছিলেন—মানুষই একমাত্র সত্তা যে "Being-toward-death" বা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলে। উৎসব সেই ভয়কে রূপান্তরিত করে আনন্দে। মৃৎশিল্পীর তৈরি দুর্গামূর্তি যেমন দশমীতে বিলীন হয় জলে, কিন্তু পরের বছর আবার ফিরে আসে—এই পুনরাবৃত্তিই জীবনের দার্শনিক উপমা। মৃত্যু এখানে অন্ত নয়, বরং পুনরারম্ভ।
বর্তমান ভোগবাদী সমাজে উৎসবের চেহারা বদলে গেছে। ধর্মীয় বা সামাজিক আবেগের জায়গায় এসেছে বিপণন, সাজসজ্জা ও প্রতিযোগিতা। উৎসব এখন অর্থনীতির চালিকাশক্তি—শপিং মল, অনলাইন সেল, সেলিব্রিটি প্রচার, ফ্যাশন শো।
তবু এই রূপান্তরকে কেবল অবক্ষয় বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আধুনিক মানুষ, যতই প্রযুক্তির জালে বন্দি হোক, তার অন্তরে উৎসবের তৃষ্ণা রয়ে গেছে। কৃত্রিম আলোর মধ্যেও সে খুঁজে ফেরে প্রকৃত আলোকের স্পর্শ।
তবে এই রূপান্তর এক বিপদের ইঙ্গিতও বহন করে। উৎসব যখন সম্পূর্ণভাবে পণ্যে পরিণত হয়, তখন তার আত্মা হারিয়ে যায়। আনন্দ তখন ক্রয়যোগ্য দ্রব্য হয়ে দাঁড়ায়। উৎসব তখন আর জীবনোৎসব নয়, প্রদর্শনের কার্নিভাল।
অতএব, আজকের মানবসভ্যতার কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ—উৎসবকে পুনরায় তার অন্তর্গত মানবিকতা ফিরিয়ে দেওয়া।
সমাজতাত্ত্বিকভাবে দেখলে, উৎসব সামাজিক সংহতির অনিবার্য অঙ্গ। সমাজ যতই জটিল ও বিভক্ত হোক, উৎসব সেই বিভাজনকে অতিক্রম করে মানুষকে এক করে।
পাড়ার দুর্গাপূজা হোক বা ঈদের নামাজ, সকলেই একে অপরের অংশীদার হয়। মানুষ হঠাৎ ভুলে যায় জাতপাত, ধর্ম, অর্থ—সব সীমা। একে অপরের মুখে হাসি ফোটানো, দুঃখের মাঝেও আনন্দ ভাগ করে নেওয়া—এই মানবিক বন্ধনই সমাজের প্রকৃত মেরুদণ্ড।
উৎসব তাই সামাজিক নিরাময় প্রক্রিয়ার মতো। বছরের পর বছর কাজ, প্রতিযোগিতা, হিংসা, বিচ্ছিন্নতা মানুষের মনকে ক্লান্ত করে তোলে। উৎসব এসে তাকে পুনরায় মেরামত করে।
যেমন সঙ্গীত মানুষের স্নায়ুকে শান্ত করে, তেমনি উৎসব সমাজের স্নায়ুকে সঞ্জীবিত করে।
তবে এই সামাজিক ঐক্য তখনই অর্থবহ, যখন তা কৃত্রিম প্রদর্শনের বদলে সহানুভূতির ভিত্তিতে দাঁড়ায়। অন্যথায় উৎসব পরিণত হয় কেবল আড়ম্বরের প্রদর্শনীতে।
উৎসবের সঙ্গে শিল্পের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। আসলে শিল্পই উৎসবের ভাষা। রঙ, সঙ্গীত, নৃত্য, আলোকসজ্জা—সবই মানুষকে এক অদৃশ্য নন্দনবোধে যুক্ত করে।
দুর্গোৎসবকে যদি শিল্পের মহাসংগীত বলা যায়, তবে প্রতিটি প্যান্ডেল এক একটি নাট্যমঞ্চ, প্রতিটি মূর্তি এক একটি দার্শনিক প্রতীক। এইসব শিল্পপ্রয়াসে সাধারণ মানুষই হয়ে ওঠে স্রষ্টা।
শিল্প ও উৎসবের এই সমন্বয় মানুষকে শেখায়—সৌন্দর্যই মুক্তি, রূপের মধ্য দিয়েই চেতনা জাগ্রত হয়। যখন সমাজের প্রতিটি মানুষ নিজের মধ্যে সেই শিল্পবোধ জাগায়, তখনই উৎসব সত্যিকার অর্থে জীবনের উদযাপনে পরিণত হয়।
মানুষ কেবল ভিড়ের অংশ নয়; সে একক সত্তাও। কিন্তু একাকিত্বের মধ্যেই সে প্রায়ই নিজেকে হারায়। উৎসব সেই হারানো সত্তাকে খুঁজে পাওয়ার মুহূর্ত।
যখন মানুষ গান গায়, নাচে, প্রদীপ জ্বালে, তখন আসলে সে নিজের অস্তিত্বের সাক্ষ্য দেয়। উৎসব এইভাবে আত্ম-অভিজ্ঞতার এক রূপান্তরমূলক মাধ্যম।
হিন্দু দর্শনের 'লীলা' ধারণা এই অর্থে গভীর—ঈশ্বর যেমন লীলার মাধ্যমে সৃষ্টিকে প্রকাশ করেন, মানুষও তেমন লীলার মাধ্যমে নিজের জীবনের মানে খুঁজে পায়। উৎসব সেই লীলারই মানবিক রূপ।
অতএব, উৎসবের চূড়ান্ত অর্থ আত্ম-আবিষ্কার—আমি কে, আমি কেন, আমি কীভাবে অস্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত—এই প্রশ্নগুলির উত্তর উৎসবের আনন্দের মধ্যে লুকিয়ে থাকে।
উৎসব কখনও নিরপেক্ষ নয়। এর ভেতর দিয়ে সমাজের রাজনৈতিক প্রবণতাও প্রতিফলিত হয়। ইতিহাস সাক্ষী, অনেক সময় উৎসবই জনমানসকে সংগঠিত করেছে।
বাংলার দুর্গাপূজা একসময় নবাবি রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় অভিজাতদের আড়ম্বর ছিল, কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীতে সেটি পরিণত হয়েছিল জাতীয় জাগরণের প্রতীকে। সার্বজনীন পূজার মাধ্যমে মানুষ অনুভব করেছিল ঐক্যের শক্তি।
তেমনি বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবও বহু সময়ে রাজনৈতিক প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে—কখনও ঐক্যের নামে, কখনও বিভেদের।
অতএব, উৎসবকে শুধু সাংস্কৃতিক পরিসরে সীমাবদ্ধ ভাবা ভুল। এটি সমাজের মনস্তত্ত্ব ও রাজনীতির অদৃশ্য মানচিত্রও তৈরি করে।
প্রশ্ন এখন একটাই—এই প্রলয়গতির প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতায় উৎসবের ভবিষ্যৎ কোন পথে গমন করছে? মানুষ ক্রমশ যখন ভার্চুয়াল বাস্তবতার অদৃশ্য জালে নিজেকে আবদ্ধ করছে, তখন কি উৎসবের আত্মা, সেই প্রাচীন মানবিক উল্লাস ও মিলনের সত্তা, নিঃশেষ হয়ে যাবে? নাকি সে নতুন কোনো আকারে, নতুন কোনো অস্তিত্ববোধে, আবারও আত্মপ্রকাশ করবে—যেমন চাঁদ কালো মেঘ ভেদ করে আবার জেগে ওঠে?
সম্ভবত ভবিষ্যতের উৎসব আর রাস্তায়, মেলায়, প্রাঙ্গণে সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং মেটাভার্সের কল্পিত নগরীতে, হলোগ্রাফিক দীপ্তির মধ্যে, ডিজিটাল আলোকরেখায় সাজানো হবে আনন্দের মহাযজ্ঞ। মানুষ একে অপরের সঙ্গে হাত না মিলিয়ে 'অ্যাভাটার'-এর মাধ্যমে মিলিত হবে; প্রসাদ বা ভোগ নয়, বরং 'ডেটা' ও 'ইমোশনাল ট্রান্সমিশন'-এর মাধ্যমে আদানপ্রদান হবে শুভেচ্ছা ও প্রীতি। কিন্তু এর মধ্যেও প্রশ্ন থেকে যায়—যখন উৎসবের আলোকসজ্জা বাস্তব বাতির নয়, বরং আলোকরশ্মির সিমুলেশন, তখন কি তার দীপ্তি সত্যিই মানুষের হৃদয় স্পর্শ করতে পারবে?
মানুষের ভেতরের উৎসববোধ, অর্থাৎ আনন্দের সামাজিক রূপ ও করুণার সম্মিলন, কোনো যান্ত্রিক অগ্রগতি দ্বারা নিঃশেষিত হয় না। কারণ উৎসবের মূলভিত্তি মানুষের অন্তঃসত্ত্ব মানবিকতা—যে মানবিকতা যুগে যুগে তার রূপ পাল্টে নিলেও নশ্বর হয়নি। সভ্যতার প্রতিটি নব পর্বেই মানুষ যন্ত্রের মুখে হাসির পরশ এনে দিয়েছে—এই প্রাণস্পন্দনই উৎসবের চিরন্তন উৎস।
তবুও আমাদের এক গভীর দায় রয়ে যায়—উৎসবকে পুনরায় মানবিক করা, তাকে প্রযুক্তির আবরণমুক্ত করে অনুভূতির গভীরে ফিরিয়ে আনা। এখনকার যুগে উৎসব ক্রমশ পণ্যের মেলা, বাণিজ্যের উপাসনাক্ষেত্র, বিজ্ঞাপনের রঙিন মুখোশে রূপান্তরিত হচ্ছে। অর্থ ও প্রভুত্বের মোহে আমরা ভুলে যাচ্ছি যে, উৎসবের সত্যিকারের সার্থকতা নিহিত আছে সহানুভূতির ঐক্যে, সমভাগ্যের আনন্দে।
ভবিষ্যতের উৎসব কেমন হবে, তা নির্ভর করছে আমাদের এই নৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর—আমরা কি উৎসবকে আবার হৃদয়ের উপাসনালয়ে ফিরিয়ে আনব, নাকি তাকে প্রযুক্তির প্রদর্শনীতে বিলিয়ে দেব? যখন শিশুর মুখে নির্দোষ হাসি ফুটবে, বৃদ্ধের চোখে শান্তির দীপ্তি জ্বলবে, দরিদ্রের কণ্ঠে ক্লান্তিহীন প্রার্থনা মিলবে আশার সুরে—সেই দিনই আমরা বলতে পারব, উৎসব এখনো বেঁচে আছে।
কারণ উৎসব মানে কেবল নিজের আনন্দে নিমগ্ন থাকা নয়, বরং অন্যের সুখে অংশ নেওয়া; উৎসব মানে বিভেদের সীমানা অতিক্রম করে মিলনের অভ্যুদয়। তাই উৎসবের ভবিষ্যৎ আমাদের হাতে—যতদিন আমরা ভালোবাসা, দয়া ও অংশগ্রহণের পথ থেকে সরে না যাই, ততদিন কোনো মেটাভার্সই উৎসবের আত্মাকে নিঃশেষ করতে পারবে না।
চিরন্তন সত্য এই—উৎসব কেবল ক্যালেন্ডারের তারিখ নয়, এটি মানবতার শ্বাসপ্রশ্বাস; আর যতদিন মানুষ নিঃশ্বাস নেবে, ততদিন উৎসব তার সঙ্গে বাঁচবে, রূপান্তরিত হবে, কিন্তু মরবে না।
উৎসবের দার্শনিক তাৎপর্য এক কথায় বলা যায়—এটি মানুষের অস্তিত্বের সংগীত। জীবনের অন্তর্গত ছন্দ, সময়ের প্রবাহ, প্রকৃতির অনন্ত রূপান্তর এবং সমাজের সম্মিলিত স্পন্দনের মধ্যে মানুষ যখন নিজের ক্ষুদ্র সত্তাকে বৃহতের সঙ্গে একাকার করতে পারে, তখনই উৎসবের জন্ম হয়। উৎসব আসলে মানুষের সত্তার মহা-প্রতিধ্বনি—যেখানে আনন্দ, বেদনা, মৃত্যু, জন্ম, মিলন ও বিচ্ছেদ—সবকিছু মিলেমিশে তৈরি করে এক চিরন্তন সুর।
উৎসব মানুষকে শেখায়, জীবন কেবল বেঁচে থাকার নাম নয়। জীবন মানে সৃজনের আনন্দ, মিলনের উল্লাস, এবং ভাগাভাগির পরম তৃপ্তি। যে মানুষ কেবল নিজের জন্য বাঁচে, সে উৎসবের অর্থ বোঝে না; কারণ উৎসব ব্যক্তির নয়, এটি সমষ্টির আত্মপ্রকাশ। এখানে মানুষ নিজের সীমানা ভেঙে অন্যের সঙ্গে একাকার হয়—গৃহ থেকে সমাজে, সমাজ থেকে মহাবিশ্বে বিস্তৃত হয় তার চেতনা।
এই পৃথিবী যতই বিভক্ত হোক—জাতি, ধর্ম, ভাষা কিংবা রাজনীতির নামে—যুদ্ধের আগুন, হিংসার অন্ধকার, অনিশ্চয়তার ঘনছায়া যতই গভীর হোক না কেন, উৎসবের আলোকরেখা বারবার মানুষকে ফিরিয়ে আনে তার মানবিক মর্মে। কারণ উৎসবের মূল সুরটাই মানবতা; এটি মানুষকে মনে করিয়ে দেয় যে, অস্তিত্বের গভীরে আমরা সবাই এক।
উৎসব তাই কেবল ক্যালেন্ডারের কোনও দিন নয়, এটি এক চিরন্তন অনুভব—অস্তিত্বের অন্তরঙ্গ সংগীত, যা মানুষকে পুনর্জন্ম দেয় প্রত্যেক বছর, প্রত্যেক ঋতুতে, প্রত্যেক প্রার্থনায়। উৎসবের মাধ্যমে মানুষ নিজেকে আবার নতুন করে চিনে নিতে শেখে, নিজের আত্মাকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করে আনন্দের আলোকবিন্দুর মধ্যে।
অতএব, উৎসব চিরকাল থাকবে—কারণ যতদিন মানুষ থাকবে, তার হৃদয়ের গভীরে ধ্বনিত হবে সেই অনন্ত সুর- মানুষ সর্বদা আনন্দের মধ্যেই নিজের আত্মাকে খোঁজে। উৎসব সেই অনুসন্ধানেরই নাম—যেখানে মানুষের মন, সমাজ, প্রকৃতি ও সময় মিলেমিশে একাকার হয়ে ওঠে আনন্দের অবিচ্ছেদ্য সিম্ফনিতে—অস্তিত্বের সংগীতে।
====================
কৃশানু ব্যানার্জী
শশীনাড়া, মেমারী, পূর্ব বর্ধমান, ৭১৩১৪৬
Comments
Post a Comment