অণুগল্প
বন্ধু
রবীন বসু
অয়ন আমার কলেজবন্ধু ছিল। যাকে বলে হরিহর আত্মা। সেমেস্টারে আমার রেজাল্ট ওর থেকে ভাল থাকত। হতাশ হয়ে বলত, তোকে আর টপকাতে পারলাম না।
কিন্তু সেই বন্ধুত্বে একদিন ফাটল এল তৃণাকে নিয়ে। তৃণা আমাদের কমন বান্ধবী। সেই বন্ধুত্ব আমরা দু'জনেই প্রণয়ে রূপান্তরিত করতে সচেষ্ট হই । আর গোল বাধল সেখান থেকেই। যেন দুই প্রতিপক্ষ যোদ্ধা। তৃণা মজা পেত। হাসতে হাসতে বলত, বাবা! বান্ধবীরা যেখানে একটা প্রেমিক জোটাতে পারছে না, আমার সেখানে দু' দুটো। তবে আমার বাপু একটা শর্ত আছে। আমি একটা স্বয়ম্বর সভার ব্যবস্থা করব। সেখানে তোমাদের ডুয়েল লড়তে হবে। যে জিতবে মালা তার গলায়।
অবশ্য শেষ পর্যন্ত অয়নের সঙ্গে আমার ডুয়েল লড়া হয়নি। ত্রিশঙ্কু ঝুলে থেকে তৃণার মন না- পেয়ে স্কলারশিপ নিয়ে আমি চলে যাই আমেরিকার মিশিগান শহরে। তারপর রিসার্চ, চাকরি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। রাগে আর মনের দুঃখে তৃণাকে ফোনে, হোয়াটসঅ্যাপে, ফেসবুকে ব্লক করে দিই। তাই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। প্রায় দশ বছর পর দেশে ফিরে অয়নকে ফোন করি। তৃণার কথা জিজ্ঞেস করি। বিদেশে থাকতে অয়ন ফোনে বলেছিল, তোর জন্যে একটা সারপ্রাইজ আছে। দেশে ফের, বলব। ও ফোনে বলল, বিকেলে আমার বাড়ি আয়, তখন বলব সারপ্রাইজটা কী!
যদিও তৃণার উপর মনে মনে খুব রাগ ছিল। কিন্তু এখন দেশে ফিরে কেমন দুর্বল হয়ে পড়লুম। একবার তৃণাকে দেখার খুব ইচ্ছে হল। অয়নের সারপ্রাইজ কি তৃণাকে নিয়ে! মনে একটা অন্য চিন্তা এল। তাহলে কি তৃণা অয়নকে বিয়ে করেছে! সেটা দেখানোর জন্যই ও ডাকল! একবার মনে হল, যাব না। তৃণা অয়নের সংসার করছে এ দৃশ্য সহ্য করতে পারব না। তার থেকে না-যাওয়াই ভাল। নিজের পরাজয় কে সহ্য করতে পারে বলুন! তবু এক দুর্জ্ঞেয় কৌতূহলে বিকেলের অনেক আগেই অয়নের বাড়ি গিয়ে হাজির হই। আজ ছুটি। রবিবার। অয়ন বাড়িতেই ছিল। দরজা খুলে বলে, আয়, তোর দেখছি খুব আগ্রহ ।
—সেটা কি স্বাভাবিক নয়! দেরি না-করে কী সারপ্রাইজ বল্।
—তার জন্যে আর একটু অপেক্ষা করতে হবে। বোস্। কোল্ড কফি দিই।
কোল্ড কফি খেতে খেতে অয়নের ঘরের চারপাশ দেখছিলুম। বিদেশে থাকতে জেনেছিলুম, ওর মা মারা গেছেন। বাবা তো যখন আমরা কলেজে পড়ি তখনই। ঘরে অন্য কারো উপস্থিতি দেখছি না। জিজ্ঞেস করি, কিরে, বিয়ে করিসনি!
অয়ন হাসতে হাসতে উত্তর দিল, না। তোর সঙ্গে আগে ডুয়েল লড়ি, তারপর তো বিয়ে।
ও যে হেঁয়ালি করছে, তা বুঝতে পারি।
আমি বোকার মতো বসে থাকি। মনে অদম্য কৌতূহল ও সংশয়। ক্লাসে আমাকে টপকাতে পারত না অয়ন, তার শোধ কি এইভাবে নেবে!
অয়ন ওপাশে সরে গিয়ে কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলছে। একটু পরে এসে বলল, তুই একটু বোস্। দু'জন এসেছে, ওদের নিয়ে আসি।
কিছুক্ষণ পর দেখি, অয়নের পিছু পিছু তৃণা ও একজন লম্বা সুদর্শন পুরুষ ঢুকল।
অয়ন পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ইনি মিস্টার সত্যব্রত দাশগুপ্ত, ইনি মিসেস তৃণা দত্ত দাশগুপ্ত। আর ইনি আমার ও তৃণার বন্ধু অর্কপ্রভ।
কিছুটা হতভম্ব ভাব কাটিয়ে মিস্টার দাশগুপ্তের সঙ্গে করমর্দন করে তৃণার দিকে হাত বাড়াতেই ও হো-হো করে হেসে উঠল। চোখে মজা পাওয়ার ঝিলিক।
অয়নও হেসে বলল, তাহলে বন্ধু, আমাদের আর ডুয়েল লড়তে হল না। রাজকুমারী পছন্দের রাজকুমারের গলায় মালা দিয়েছেন। এটা দেখাতেই তোকে আজ ডাকা। তৃণাকেও ফোন করে ডাকি। সঙ্গে বরকে আনতে বলি। এই আমার সারপ্রাইজ।
আমিও হাফছেড়ে বাঁচলুম। যাক্ নিশ্চিত হলুম। তৃণা অন্তত অয়নকে বিয়ে করেনি। আমি হারিনি ওর কাছে।
তৃণা ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে আমার পাশে। গায়ে ঠেলা দিয়ে বলে, কিরে, কেমন আছিস! তুই সেই হাঁদাই রয়ে গেলি। আমরা বন্ধু। খুব ভাল বন্ধু। তুই আমি অয়ন।
••••
রবীন বসু
189/9, Kasba Road, Kolkata - 700042
Comments
Post a Comment