গল্প
ভেস্ত্রা গেটলান্ড-এর নক্ষত্র দূত
অভিজিৎ হালদার
ভেস্ত্রা গেটলান্ড, সুইডেনের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত এক প্রাচীন এলাকা, তার ঘন সবুজ বন আর পাথুরে টিলাগুলোর নিচে লুকিয়ে রেখেছে হাজার বছরের ইতিহাস। তবে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান মিথোলজি আর ভাইকিং উপকথার বাইরে, এই অঞ্চলের নাম ফিস্কেব্যাক্কিল (Fiskebäckskil) গ্রামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক রহস্যময় কিংবদন্তি। গ্রামটি ভেস্ত্রা গেটলান্ড-এর বোহুস্ল্যান (Bohuslän) প্রদেশের এক নিস্তব্ধ উপকূলীয় বসতি। সাধারণ মানুষের কাছে, ফিস্কেব্যাক্কিল ছিল স্রেফ মাছ ধরা আর শান্ত জীবনের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু স্থানীয় লোককথা আর প্রাচীন পুঁথির পাতা উল্টালে উঠে আসে এক বিস্মৃত নাম: অ্যান্ডার্স লিন্ডবার্গ (Anders Lindberg)। প্রায় ৩০০ বছর আগে এই এলাকায় বাস করতেন এক দার্শনিক, যাকে সবাই 'জ্ঞানবৃদ্ধ' বলে ডাকত। অ্যান্ডার্স কোনো সাধারণ মনিষী ছিলেন না। গ্রামবাসীর বিশ্বাস ছিল, তার মুখ থেকে যা একবার উচ্চারিত হতো, তা-ই সঠিক হতো। আবহাওয়ার পূর্বাভাস থেকে শুরু করে দূরবর্তী যুদ্ধ-বিগ্রহের ফলাফল—তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী ছিল অব্যর্থ।
কিন্তু যা তাঁকে আর পাঁচজনের থেকে আলাদা করত, তা হলো তাঁর অদৃশ্য জগতের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষমতা। কথিত আছে, রাতের গভীরে অ্যান্ডার্স ফিস্কেব্যাক্কিল-এর সবচেয়ে উঁচু, বায়ুতাড়িত গ্রানাইট টিলার উপর বসে থাকতেন, যেখান থেকে উত্তরের আকাশগঙ্গা স্পষ্ট দেখা যায়। তিনি নাকি সেই মুহূর্তে মহাজাগতিক শক্তির সঙ্গে কথা বলতেন। পৃথিবীর বাইরে অবস্থিত সত্তাদের সঙ্গে তার সংযোগ ছিল। গ্রামবাসীরা গোপনে বলত, অ্যান্ডার্স লিন্ডবার্গকে দেখলে মনে হতো তিনি যেন এই পৃথিবীর নন, তার দৃষ্টি যেন বহুদূর নক্ষত্রলোকের কোনো রহস্য দেখছে।
কিন্তু এক শরৎকালের রাতে, যেদিন আকাশে নর্দার্ন লাইটস (Northern Lights) যেন এক বেগুনি-সবুজ আগুনের শিখা জ্বালিয়েছিল, সেদিনই অ্যান্ডার্স লিন্ডবার্গ হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলেন। কেউ কোনো সন্ধান দিতে পারেনি। তার ছোট কাঠের কুটিরটা পড়ে রইল, যেখানে শুধু প্রাচীন এক অ্যাস্ট্রোল্যাব ও অদ্ভুত প্রতীক খোদাই করা কয়েকটি পাথরের টুকরো পাওয়া গিয়েছিল। বহু খোঁজাখুঁজির পরেও তাঁর কোনো চিহ্ন মেলেনি। মনিষী যেন বাতাসের সঙ্গে মিশে গেলেন, বা নক্ষত্রের পথে ফিরে গেলেন।
বহু বছর পর। আধুনিক পৃথিবীর ব্যস্ততা, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি যখন মানুষের জীবনের প্রতিটি দিককে গ্রাস করেছে, তখনও ফিস্কেব্যাক্কিল-এর সেই গ্রানাইট টিলার উপর রহস্যের ছায়া লেগেছিল।
এই রহস্য উন্মোচনের জন্যই সুইডেন-এর নামকরা তরুণ গবেষক ও অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের অধ্যাপক ডঃ এমিলে জনসন (Dr. Emelie Jonsson) স্টকহোম থেকে ভেস্ত্রা গেটলান্ড-এ এলেন। এমিলে লিন্ডবার্গ-এর উপর লেখা একটি প্রাচীন অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি খুঁজে পেয়েছিলেন, যেখানে মনিষীর অদৃশ্য হওয়ার পিছনে মহাজাগতিক সংযোগের ইঙ্গিত ছিল। এমিলে এই বিষয়ে গবেষণা করার জন্য একটি বিশেষ সরকারি অনুদানও পেয়েছিলেন।
ফিস্কেব্যাক্কিল-এ পৌঁছে এমিলে অনুভব করলেন, গ্রামটির শান্ত সৌন্দর্যের আড়ালে যেন একটা প্রাচীন কম্পন লুকিয়ে আছে। তিনি মনিষীর পরিত্যক্ত কুটিরটির কাছে একটি ছোট কেবিন ভাড়া নিলেন। তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সেই গ্রানাইট টিলাটি এবং তার চারপাশের এলাকা পরীক্ষা করা।
প্রথম কয়েক দিন এমিলে শুধু মনিষীর কুটির ও পাণ্ডুলিপি নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। পাণ্ডুলিপিটি ছিল আংশিকভাবে সাংকেতিক ভাষায় লেখা। এক সন্ধ্যায়, কুটিরের স্যাঁতসেঁতে দেয়ালের পাশে রাখা একটি পাথরের টুকরোর উপর আলো ফেলে তিনি দেখলেন, তাতে খোদাই করা প্রতীকটি হুবহু পাণ্ডুলিপির একটি সাংকেতিক চিহ্নের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। পাথরটি কুড়িয়ে নিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন, এটি কোনো সাধারণ পাথর নয়। এটি কোনোভাবে বাইরের মহাকাশের বিকিরণ বা শক্তিকে ধারণ করে আছে।
পরদিন সকালে এমিলে সেই রহস্যময় টিলার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছানোর পর, তিনি দেখতে পেলেন একটি অদ্ভুত ব্যাপার। চূড়ায় অন্য কোথাও কোনো গাছপালা নেই, অথচ মাঝখানে একটি জায়গায় পাথরগুলো এমনভাবে সাজানো আছে, যেন একটি প্রাচীন অবজারভেটরি। টিলার কেন্দ্রবিন্দুতে একটি শিলাখণ্ড ছিল, যার উপর সূক্ষ্মভাবে বৃত্তাকার আর সরল রেখার কিছু নকশা আঁকা। এমিলে তার সঙ্গে আনা বিশেষ স্পেকট্রোমিটার দিয়ে শিলাখণ্ডটির বিকিরণ পরিমাপ করলেন। ফলাফল দেখে তিনি চমকে গেলেন। শিলাখণ্ডটি যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের শক্তি নির্গত করছে, তা পৃথিবীর কোনো পরিচিত উপাদানের সঙ্গে মেলে না। বিকিরণটি এমন একটি ফ্রিকোয়েন্সিতে আসছে, যা মহাবিশ্বের প্রাচীনতম নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে আসা 'কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড' (Cosmic Microwave Background) রেডিয়েশনের সঙ্গে এক অদ্ভুত সামঞ্জস্য বহন করছে।
রাতে এমিলে আবার টিলার উপরে গেলেন। নক্ষত্র ভরা আকাশের নিচে, সেই শিলাখণ্ডের উপর হাত রেখে তিনি গভীর ধ্যানে মগ্ন হলেন। তিনি অনুভব করলেন, একটি শীতল শক্তি ধীরে ধীরে তার মস্তিষ্কের গভীরে প্রবেশ করছে, ঠিক যেমন কোনো যন্ত্র কোনো তথ্য ডাউনলোড করছে।
হঠাৎ তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল কিছু ছবি। অ্যান্ডার্স লিন্ডবার্গ সেই টিলার উপরে দাঁড়িয়ে আছেন, কিন্তু তার শরীরের চারপাশে একটি জলীয় আলোর আভা। তার চোখ দুটি যেন জ্বলজ্বল করছে, এবং তিনি আকাশের দিকে হাত তুলে কিছু বলছেন। তারপর এক তীব্র আলোর ঝলকানি, আর মনিষী অদৃশ্য। কিন্তু এরপরেই এমিলে যা দেখলেন, তা ছিল আরও আশ্চর্যজনক। তিনি দেখতে পেলেন, লিন্ডবার্গ একা নন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, হাজারো বছর ধরে, বিভিন্ন সভ্যতায় এমন অসংখ্য মানুষ ছিল—এশিয়ার পাহাড়ে, আফ্রিকার মরুভূমিতে, আমেরিকার রেইনফরেস্টে—যারা একই রকম অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করত। তারা মনিষী, ভবিষ্যদ্বক্তা, বা নিছক সাধক হিসাবে পরিচিত ছিল।
হঠাৎ করেই পাণ্ডুলিপির সাংকেতিক ভাষার অর্থ তার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। লিন্ডবার্গ আসলে লিখে গিয়েছিলেন, তিনি মহাজাগতিক শক্তির দূত বা 'কসমিক অ্যাম্বাসেডর'। এই সত্তারা কোনো ভিনগ্রহের প্রাণী নয়, বরং মহাবিশ্বের ভারসাম্য রক্ষার জন্য আসা একদল সচেতন শক্তি। তারা পৃথিবীর মানুষকে বিপদ থেকে রক্ষা করত, জ্ঞান দিত এবং সভ্যতার গতিপথ ঠিক রাখত। তাদের কাজ শেষ হলে তারা আবার নিজেদের নক্ষত্রলোকে ফিরে যেত।
অ্যান্ডার্স লিন্ডবার্গ যখন পৃথিবীর মানুষের জন্য তার কাজ শেষ করেছিলেন, তখন তিনি নর্দার্ন লাইটস-এর (Aurora Borealis) আড়ালে একটি পোর্টাল বা দরজা ব্যবহার করে মহাবিশ্বের গভীরে ফিরে যান।
গবেষক ডঃ এমিলে জনসন শিলাখণ্ডের কাছ থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তার মুখমণ্ডল বিস্ময়ে উজ্জ্বল। তিনি বুঝতে পারলেন, তিনি শুধু একজন হারিয়ে যাওয়া মনিষীর খোঁজ পাননি, বরং মানব ইতিহাসের এক বিশাল গোপন রহস্য উন্মোচন করেছেন। এই পৃথিবীতে অ্যান্ডার্স লিন্ডবার্গ-এর মতো আরও অনেক 'দূত' আছেন, যারা হয়তো একজন শিক্ষক, একজন শিল্পী, বা আপনার পাশের বাড়ির কোনো সাধারণ মানুষ হিসেবে জীবনযাপন করছেন, নীরবে মহাবিশ্বের কাজ করে চলেছেন। সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে তারা হয়তো শুধু জ্ঞানী, কিন্তু আসলে তারা হলেন নক্ষত্রলোকের প্রতিনিধি।
এমিলে স্থির করলেন, তিনি তার গবেষণা নিয়ে কোনো বই বা প্রকাশনা করবেন না। এই রহস্য উন্মোচন হলে পৃথিবীতে ভয় ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। বরং তিনি অ্যান্ডার্সের কাজ নীরবে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
ফিস্কেব্যাক্কিল-এর টিলা থেকে শেষবারের মতো নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি মৃদু হাসলেন। এখন থেকে তিনি শুধু একজন গবেষক নন, তিনি এই গোপন সত্যের রক্ষক। ভেস্ত্রা গেটলান্ড-এর নীরব গ্রানাইট টিলা যেন আজও সেই নক্ষত্র দূতদের আগমন ও প্রস্থান-এর সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর ডঃ এমিলে জনসন সেই ইতিহাসের এক নতুন পাতার সূচনা করলেন।
==========
Name - Abhijit Halder
Village - Mobarockpur
P.O - Fatepur
P.S- Hanskhali
Dist- Nadia
Pin- 741507
West Bengal , India

Comments
Post a Comment