জয় হিন্দ
দীনেশ সরকার
রায় পরিবারে কারও মন ভালো নেই। একটা দুশ্চিন্তার কালো মেঘ ক্রমশঃ তাদের পরিবারের উপর ছায়া বিস্তার করছে। পরিবারের সবেধন নীলমণি বংশধর বাবুসোনা প্রায় তিন বছর হতে চলল কিন্তু তার মুখে সেভাবে কথা ফুটল না। "ই-ই, উ-উ" ছাড়া তেমন কোন কথা তার মুখ থেকে বের হয় না। অথচ ওই বয়সের শিশুরা মোটামুটি কথা বলতে শেখে। এইটাই পরিবারের দুশ্চিন্তার কারণ। বাবুসোনার বাবা-মা, দাদু, ঠাম্মি, কাকাইয়েরও মন খুব খারাপ। বাবুসোনা কথা বলতে পারবে তো! ডাক্তারবাবুর কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তারবাবু অবশ্য অভয়বাণী শুনিয়েছেন, 'এখনই অধৈর্য হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। সব বাচ্চার একসময়ে বোল ফোটে না। কারও কারও ক্ষেত্রে দেরীতে বোল ফোটে। তাই এখনই হতাশ হওয়ার কোন কারণ নেই।' ডাক্তারবাবু যতই অভয়বাণী শোনাক, মন তো মানে না। রায় পরিবারের মনে তাই দুশ্চিন্তার মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে।
দিনটা ছিল ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবস। ক্লাব প্রাঙ্গনে দিনটি উদযাপনের আয়োজন করা হয়েছে। ভাষণ হবে, পতাকা উত্তোলন হবে, মিষ্টিমুখ হবে। ক্লাব প্রাঙ্গনে বাচ্চারা পতাকা হাতে ছোটাছুটি করছে। মহল্লার নারীপুরুষেরা সমবেত হয়েছে দিনটি উদযাপন করার জন্য। বাবুসোনাকে কোলে নিয়ে বাবুসোনার বাবাও সেখানে উপস্থিত হয়েছে। একটা বাচ্চা এসে বাবুসোনার হাতে একটা পতাকা ধরিয়ে দিয়ে গেল। পতাকা পেয়ে বাবুসোনার খুশি দেখে কে। বাবার কোল থেকে নেমে পতাকা হাতে সেও অন্য বাচ্চাদের সাথে ছুটতে লাগল। তারপর অনুষ্ঠান শুরু হতে আবার বাবার কোলে উঠে পড়ল। সভাপতি মহাশয় ভাষণ শেষে পতাকা উত্তোলন করলেন। তারপর মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরের দিকে ছুড়ে দিয়ে 'জয় হিন্দ' বললেন। তখন সবাই একসঙ্গে হাত উপরে তুলে বা পতাকা উপরে তুলে 'জয় হিন্দ' বলল। সবার দেখাদেখি বাবুসোনাও তাই করল, পতাকা উপরে তুলে মুখে 'জয় হিন্দ' বলার চেষ্টা করল। দ্বিতীয়বার যখন সবাই হাত উপরে তুলে সমবেত কন্ঠে 'জয় হিন্দ' বলল, বাবুসোনার বাবার মনে হ'ল আধো আধো গলায় বাবুসোনাও 'জয় হিদ' বলল। বাবুসোনার বাবা কান খাড়া করল। তৃতীয়বার যখন সবাই সমবেত কন্ঠে 'জয় হিন্দ' বলল তখন বাবুসোনার বাবা পরিষ্কার শুনতে পেল বাবুসোনা পতাকাটা উপরে তুলে 'জয় হিদ' বলেছে। বাবুসোনার বাবার মনটা খুশিতে ভরে গেল । তাড়াতাড়ি মিষ্টির প্যাকেটটা নিয়ে বাড়ির পথ ধরল।
বাবার কোলে চেপে বাড়ি যেতে যেতে বাবুসোনা বারবার পতাকাটা উপরে তুলে "জয় হিদ' বলতে লাগল। উঠানে পৌঁছুতেই বাবার কোল থেকে নেমে ছূটে দাদুর কাছে গিয়ে পতাকাটা উপরে তুলে 'জয় হিদ' বলে আবার ঠাম্মির দিকে ছূট লাগাল। দাদু চমকে উঠল। নাতির মুখে বোল ফুটেছে জেনে খুব খুশি হ'ল। ঠাম্মির কাছে গিয়ে 'জয় হিদ' বলে আবার দাদুর কাছে এসে 'জয় হিদ' বলল। দাদু বাবুসোনাকে কোলে তুলে আদর করে বলল, 'যা, রান্নাঘরে গিয়ে মাকে বল, মা, জয় হিন্দ।'
বাবুসোনা পতাকা নিয়ে ছুটল রান্না ঘরে। মায়ের কাছে গিয়ে বলল, 'মা, জয় হিদ।' 'মা' উচ্চারণটা পরিষ্কার হ'ল না, কিন্তু ও যে 'মা' বলছে এটা বুঝতে কোন অসুবিধা হ'ল না। মায়ের ব্যাকুল হৃদয় তৃপ্ত হ'ল। মা বাবুসোনাকে বুকে চেপে আদর করে হামি দিয়ে বলল, 'আমার সোনাবাবা, আর একবার বল।' বাবুসোনা আবার বলল, 'মা, জয় হিদ।' এবার 'মা' ডাক পরিষ্কার হ'ল। মা বাবুসোনাকে আবার আদর করে বলল, 'যা, বাবাকে গিয়ে বল, 'বাবা, জয় হিন্দ।' বাবুসোনা পতাকা হাতে আবার বাবার কাছে ছুটল, বলল, 'বা—বা—জয় হিদ।' বাবা বাবুসোনাকে আদর করে ছেড়ে দিতেই বাবুসোনার মুখে তখন শুধু, 'জয় হিদ।'
রায় পরিবারে সুশ্চিন্তার কালোমেঘ কেটে গিয়ে খুশির সূর্য উঠল।
************************************
দীনেশ সরকার
১৪০ ডি, হিজলি কো-অপারেটিভ সোসাইটি,
প্রেমবাজার, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর --- ৭২১৩০৬

Comments
Post a Comment