চিকুর ইচ্ছে
সুদীপ্ত পারিয়াল
রিমঝিম বৃষ্টি শুরু হয়েছে সেই সকাল থেকে। বৃষ্টি এলেই গৃহবাসীদের মধ্যে একটা নিরাপত্তাবোধ কাজ করে। মাথার উপরের ছাদটুকু যেন পৃথিবীর সব থেকে বড় মুশকিল আসান।
রমি ভাবল ছুটির দিন, বাড়িতে গরম গরম পকোড়া ভেজে মুড়ি দিয়ে খাওয়া যাবে। চিকু এমনিতে মা-বাবাকে সারা সপ্তাহ পায় না। এই একটা দিন মা-বাবাকে পেয়ে তাই সারা সপ্তাহের সমস্ত আদর উসুল করে নিতে চায়।
কিন্তু আজকের উদ্দেশ্যটা অন্যরকম ছিল। সম্রাট ভেবেছিল আজকে রমিকে আর চিকুকে নিয়ে থিয়েটার দেখতে যাবে। এমনিতেই বাংলা থিয়েটারের দর্শক দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। ছেলেবেলা থেকেই থিয়েটারের প্রতি একটা অমোঘ টান সম্রাটের। কিশোর বয়সে একটা নাটকের দলে যুক্ত হয়েছিল। কিন্তু গ্রুপ থিয়েটারের পরিশ্রম কিছুতেই সহ্য করতে পারল না। তারপর কলেজ জীবনে প্রেম, চাকরি, ব্যস্ততা সংসার সবকিছুর যাঁতাকলে থিয়েটারের ভালোবাসা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
চিকুর অবশ্য এসবে কোন উৎসাহই নেই। অন্যান্য দিন ঘরে বসে গেম খেলে অথবা বই পড়ে। আজ বারান্দায় বসে এক মনে বৃষ্টি দেখছে। আর উশখুশ করে একবার রান্নাঘরে আসছে, মাকে কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু বলতে পারছে না। ড্রয়িং রুমে বাবা একটা বই পড়ছে; বাবাকেও কিছু বলতে গেল, পারল না।
তারপর আবার বারান্দায় গিয়ে বসেছে, আপন মনে প্রকৃতিকে দেখছে।
সম্রাট ও রমির নজর এড়ায়নি ব্যাপারটা। তাদের ছেলে এমনিতে খুব শান্ত। কথার বাধ্য। এই বয়সের ছেলেরা মা-বাবার মুখে মুখে যেমন তর্ক করে, চিকু মোটেই সেরকম ছেলে নয়। বাবা-মায়ের দেখাদেখি তারও বই পড়ার আগ্রহ আছে। ইদানিং তো লেখালেখির প্রতিও ঝোঁক এসেছে। গত এপ্রিল মাসে পুরী থেকে ফেরার পথে ট্রেনে আচমকা দেখা হয়ে গেছে, এক দাদার সাথে।
ভদ্রলোকের বয়স খুব যে কম তা নয়, কিন্তু তাকে দাদা বলতেই ইচ্ছে করে চিকুর। ওনারা একটি পত্রিকা চালান, তার জন্য লেখা চাইলেন। লেখা পাঠানোর পর সেটি ছাপা হলো এবং ডাকযোগে সেই পত্রিকাও এলো, সঙ্গে কিশোর সম্মাননা। চিকু এই সম্মানের যোগ্য কিনা, এখনও ঠিক জানে না।
রমি পকোড়া সহযোগে মুড়ি মেখে নিয়ে এসে বলল, বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আর কিছু ভাবতে হবে না। ঘরে এসে বোস। বল তো কি হয়েছে?
চিকু বলে, কলকাতায় এবার খুব বৃষ্টি হচ্ছে তাই না?
হ্যাঁ তা তো হচ্ছে।
চিকু মুখটা উদাস করে বলে, কিন্তু এই পুজোর সময় বৃষ্টি হলে যারা ঠাকুর বানাচ্ছে তাদের তো খুব ক্ষতি। কি করে মাটি শুকোবে?
রমি অবাক হয়ে ভাবে, এরকম উদ্ভট চিন্তাভাবনা তার ছেলের মাথায় এলো কি করে? ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে ও বলে, এখন তো অনেক উন্নতমানের মেশিন আছে বাবা, মাটি শুকানোর জন্য। তুই চিন্তা করিস না।
চিকু বলে, তা না হয় হল, কিন্তু পুজোর সময় যদি বৃষ্টি হয়, তাহলে যারা ঝালমুড়ি বিক্রি করে? ঘুগনি, আইসক্রিম বিক্রি করে, তাদের কি হবে? ওদের বাড়িতেও তো কেউ না কেউ আছে! আমার থেকেও ছোট বাচ্চা আছে হয়তো।
সম্রাট এবার এদিকে কান দিল।এত পাকা পাকা কথা তাকে কে শেখালো? বইটা পেজ মার্ক করে রেখে এসে ছেলের পাশে ব'সে সম্রাট বলে, তা তুই এখন কি চাস চিকু বাবু?
চিকু বলে, এবার পুজোয় আমরা কিছু কিনব না, কোন শপিং হবে না। কোন খাওয়া-দাওয়া হবে না। আমরা ওদের জামাকাপড় দেব। প্রমিস করো বাবা, ঠিক দেব তো?
==============
সুদীপ্ত পারিয়াল,
ধাড়সা ব্রাহ্মণ পাড়া,
জি আই পি কলোনি,
হাওড়া - 711112

Comments
Post a Comment