ভালবাসা কারে কয়
দ্যুতি রায়
দ্বিরাগমনে বাপের বাড়ি এলো সৌমিলী । গাড়ি থেকে নেমেই, নিজের ঘরে ঢুকে, দরজা আটকে বসে রইলো সে। বর সমীরণ তার পিছু পিছু এসে ঘরে ঢুকলো। সৌমিলীর বাবা মা বেশ ঘাবড়ে গেছেন, তবে মুখে দেখন হাসির প্রলেপ মাখিয়ে নতুন জামাইকে আপ্যায়ন করলেন। বাপ মায়ের একমাত্র মেয়ে "মিলি", আদরে যতনে মানুষ হলেও অশিক্ষা কুশিক্ষা কখনো পায়নি বরং গুরুজনদের সম্মান করা, সহবত সংযম সব জানে সে। খুব ভালো ঘরে বরে ওকে সম্প্রদান করা হয়েছে। শত কষ্ট পেলেও ওই অভিমানী মেয়ে মুখ ফুটে কিছু বলবে না। কি এমন হলো? চিন্তিত হলেন মিলির মা বাবা। একটু বাদে, বন্ধ ঘরে সৌমিলীর মা, মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগলেন। বেচারা বর, গোবেচারা মুখে ঘরের বাইরে রইলো। মায়ের প্রশ্নের উত্তরে সৌমিলীর ঝুড়ি ঝুড়ি অভিযোগ করতে লাগলো।
বরের সাথে নাকি ভালো করে আলাপ হয়নি। সে গম্ভীর মানুষ, দরকার ছাড়া মুখে কথা নেই তার। মা বুঝলেন, কথার ফুলঝুরি মিলি, গল্প করতে শুরু করলে ঝর্নার মতন কলকল করতেই থাকে। তার কথা বলার লোক কম ওখানে। তিনি বলেন মিলিকে," নতুন জায়গা, নুতন মানুষ ধীরে ধীরে দুজন দুজনকে বুঝতে হবে। একদিনেই কি নৈকট্য আসে?
তারপর মিলি অনেক কথা হড়বড় করে বলে। মা শুনে যান কিন্তু কিছুই বলেন না। তার সারাংশ হলো, শাশুড়ি সকাল উঠেই ঠাকুরঘরে ডিউটি করেন। ওদের তে'তলার দেবদেবীর ঘরটা বেশ বড়সড়, সেখানে অনেক মেম্বার। শাশুড়ির, দিদি শাশুড়ির আমলে থেকে থাকা, সব তাবড় তাবড় ঠাকুর দেবতা। পরবর্তী কালে, যতগুলো তীর্থস্থানে যাওয়া হয়েছিল, ততগুলো ছবি বা মূর্তি যোগ হয়ে গেলো । সবার বরাদ্দ ফুল, ফল, বেলপাতা, নকুল দানা আর বিশেষ দিনে লুচি পায়েস দিয়ে ভোগ আছে। তার উপর এক একজন ঠাকুরের এক এক রকম স্তোত্র পাঠ, মন্ত্র ইত্যাদিতে বেলা বয়ে যায় শাশুড়ির । তাঁর পুজো শেষ হতে হতে কোনোদিন দশটা বা তারও পরে। ততক্ষণ সৌমিলীর কোনো কাজ নেই। ওর আবার চায়ের নেশা নেই। সকালে ওর খুব খিদে পেয়ে যায়। নতুন জায়গায় কিছু বলা যায়?
অভিযোগ নম্বর দুই হলো, আমিষ ও নিরামিষ খাওয়া দাওয়ার দিন ভাগ। দেবদেবীর দিনের হিসেবে ভজনা অনুসারে ভোজনের ঠিক হয়। নিরামিষ দিন শুরু হয়, বাবা ভোলানাথ শিবের দিন সোমবার থেকে। তারপরের দিনগুলো হলো, মঙ্গলবার বজরঙ্গবলীর, বৃহস্পতিবার মা লক্ষীর, শুক্রবার সন্তোষী মাতার ও শনিবার শ্রী কালী মাতার জন্যে শাকাহারী আহার । বুধ আর রবিবার আমিষ হয়। রবিবার আবার মাংস-বার। তাহলে মাছ-বার হলো বুধবার। এদিকে বাপের বাড়িতে মিলির আমিষ-বার সপ্তাহে সাত দিন ।
অভিযোগ নম্বর তিন, সারাক্ষণ খরখরে নতুন শাড়ি পরে, মাথায় ঘোমটা দিয়ে থাকতে থাকতে চুল উঠে যাচ্ছে মিলির। এদের সংস্কার গুলো ইতিহাসের পাতায় থেকে উঠে এসেছে। এঁদের আত্মীয়রা এলেই ঢিপ ঢিপ করে পাইকারি হারে প্রনাম করতে হয়। তাছাড়া সৌমিলীর বন্ধু বান্ধবের সাথে আর যোগাযোগ নেই ! হবেই বা কি করে ? বাড়ি থেকে বেরোতে গেলে ভার্বাল অ্যাপ্লিকেশন শাশুড়ির কাছে। সেটা আবার হেড অফিসে অর্থাৎ শ্বশুর মশাইয়ের অ্যাপ্রুভাল লাগে। তারপর ড্রাইভার ফ্রি আছে কিনা দেখে বেরুতে হয়।
আরও এক দিস্তা নালিশ পেন্ডিং আছে সৌমিলীর। এ ব্যাপারে ওর মা বাবার কি বা করতে পারে? মা মিষ্টি হেসে বলেন," সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে, একটু ধৈর্য্য ধরো মিলি, মা ।"
পরদিন শ্বশুর বাড়ি ফিরে যাবার সময়ে, সৌমিলীর মাকে চুপিচুপি সমীরণ বললে, "আমি সব শুনতে পেয়েছি। চিন্তা করবেন না ।"
শ্বশুর বাড়িতে সাত সকালেই কাজের লোক এসে চা করে। চা নিয়ে ঘরে ঘরে রুম সার্ভিস দেয় সে। তারপর সে সমীরণের জন্যে সেদ্ধ ভাতে করে দেয়। ওদের অফিসে ভালো লাঞ্চ দেয়। সৌমিলীর শাশুড়ি পুজো সেরে, জলখাবার খেয়ে, ধীরে সুস্থে বাকি রান্না করেন। তাঁর জলখাবার এগারোটায় হয় আর মধ্যাহ্নভোজের সময়ের সঠিক বলা যায় না। রান্নার সাথে সাথে চলে মোবাইলে আলাপন। তাঁর পঞ্চান্ন জন, স্বজন বন্ধু বান্ধব আছে। এঁদের সাথে সময়াভাবে দেখা সাক্ষাৎ হয়না। এঁদের খোঁজখবর নেওয়া নৈতিক দায়িত্ব তিনি সুচারু ভাবে পালন করেন। সেই কথপোকথন চলতে থাকে রান্নার পরও। শ্বশুরমশাই মাটির মানুষ, মাঝে মাঝে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে যান। তারপর খবরের কাগজ বা বইয়ে মুখ গুঁজে থাকেন।
সেদিন অফিসের যাবার সময়, খেতে বসে সমীরণ হাঁক পারলো সৌমিলীকে। সে হন্তদন্ত হয়ে আসতেই সমীরণ বলে, "আমার পাতে বড্ড বেশি ভাত দেওয়া হয়েছে। অর্ধেকটা ডিম, আলু আর একটুখানি মাখন দিয়ে বাকি ভাতটা খেয়ে নেবে, প্লীজ। যদি ভালো লাগে তোমার, কাল থেকে আমার সাথে ডিম আলু ভাতে খাবে তুমি ! সেটা তোমার না চললে, পাউরুটি মাখন ডিম দিয়েও আমরা ব্রেকফাস্ট করতে পারি! তবে ঘি দিয়ে ভাতে ভাত সৌমিলীর খুব প্রিয়, ওর কলেজের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়!
তারপরের ব্যাপারটা আরো আশ্চর্যজনক। প্রায়ই জমেটো বা সুইগি থেকে ওর নামে চিকেন, মাটন বা ফিশ আসতে লাগলো। বাড়িতে বলা হলো সৌমিলী আবার পড়াশুনা করার চেষ্টায় আছে। ভাতের থালাটা মাঝে মাঝে ঘরে নিয়ে যাবে ও। ওর সময় মতন খেয়ে নেবে। সবাই সব বুঝেও না বোঝার মত চোখ বন্ধ করে রইলো। সৌমিলী নিজেও অবাক। সে তার বরকে থ্যাংকস জানাতে যায়। গম্ভীর বরটা হেড মাষ্টারের মতন মুখ করে তাকায়। এমন ভান করে আছে, যেন বাড়িতে কি হচ্ছে সে জানেই না, অথচ সৌমিলীর মনের মত সব কিছু হয়ে যায়।
তারপরের ব্যাপারটাতে আরো অবাক হয়ে যায় সৌমিলী ! হঠাৎ অফিস যাবার সময়ে সমীরণ, বউটাকে জরুরি তলব করে। একেই শাড়িতে অনভ্যস্ত সৌমিলী, তারপরে হুড়মুড়িয়ে আসতে গিয়ে শাড়িটা পায়ে জড়িয়ে যায়। পড়তে পড়তে সে নিজেকে সামলে নেয়। সেদিন সমীরণ হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দেয়। সে বলতে শুরু করে, "বিয়ের উৎসব চুকে বুকে গেছে। এখন এই বঙ্গ বধূ মার্কা সাজের কি দরকার?" তারপর সে, মাকে ডাকাডাকি শুরু করে। মাকে বলে, " আজ ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিচ্ছি, তুমি ওকে সঙ্গে করে নিয়ে কয়েকটা পালাজো বা স্কার্ট গোছের কিছু কিনে দিও। আর একটু হলেই উল্টে পড়ছিল, আর কি! সারাজীবন খোঁড়া বউ নিয়ে চলতে পারব না আমি।"
" বাবা ! আমার বরটা কিছু নাটক করতে পারে।" ভাবলো সৌমিলী।
এই প্রথমবার সৌমিলীকে নিয়ে শাশুড়ি শপিংয়ে গেলেন। এরপর থেকে মাঝে সাঝেই, অফিসে সমীরণকে নামিয়ে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে হাজির হতো। হয়তো কোনোদিন, ড্রাইভারজি শাশুড়িকে বলতো, " আপনি কি দিদির বাড়ি যাবেন?" তারপরই অন্যদিন সৌমিলীকে বলতো, "দাদা বললো আপনার নাকি আজ কোথাও বেরুবার আছে?" শাশুড়ি খুব কম বেরোতেন । সৌমিলী সুযোগের সদ্ব্যবহার করতো। কোনোদিন বাপের বাড়ি, কোনোদিন বা বন্ধুদের সাথে আড্ডা। বুঝতে অসুবিধা হতো না নীরবে কার ইচ্ছেতে ওর ইচ্ছে পূরণ হয়!
সব থেকে সুন্দর মুহূর্তগুলো হতে লাগলো ফেরার পথে। সমীরণকে অফিস থেকে তুলে নেওয়া হতো। তারপর ওরা দুজন, গঙ্গার ঘাটের তাজা বাতাসের ঘ্রান আস্বাদন করে, কিম্বা কোথাও বসে কফি খেয়ে আর না হলে ঘরের কাছের পার্কে, হাতে হাতে ধরে হেঁটে বেরিয়ে পরস্পর পরস্পরকে চিনে নিতে আরম্ভ করলো। তখন এই কম কথা বলা মানুষটার মুখে বোল ফোটে।
সৌমিলীর বাপের বাড়িতে আসাটা কম হয় এখন।
কয়েকদিন পর, বাপের বাড়িতে এলো দুজনে। পাশের বাড়ির কাকিমা সবার সামনেই সৌমিলীকে বলে, " কি ব্যাপার ! খুব যে খুশি খুশি লাগছে, মিলিকে। বর বুঝি তোকে বড্ড ভালবাসে!" সলাজ মুখে, স্মিত হেসে সৌমিলী উত্তর দেয়," আমি কি জানি, ভালবাসা কারে কয়?"
ওর গম্ভীর বরটাও আজ ফিক করে হেসে দেয়। দুজনের চোখাচোখি হয়। সবার অলক্ষে ভাব তরঙ্গের খেলা চলে, নীরবে।

Comments
Post a Comment