পড়া আগে না লেখা আগে
তপন তরফদার
"ডিম আগে না মুরগি আগে"— জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই ওই ধাঁধাটা সবাই জিজ্ঞাসা। এই ধাঁধার সঠিক উত্তর খোঁজে সবাই যখন ব্যাকুল সেই সময়ে নতুন এক সমস্যা মনে উদয় হয়েছে, লেখা আগে না পড়া আগে। এই লেখালেখি পড়া-শোনার একটু ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে জানতে পারি যা সবাইকে হতবাক করবে। আমরা এই বিষয়ের মৌলিক ইতিহাসের দিকে তাকালে জানতে পারি
খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দে, মেসোপটেমিয়ার শহরগুলো কৃষি সমৃদ্ধির ফলে মনোরঞ্জন কর সামাজিক কাঠামোর নিয়ে গড়ে উঠতে শুরু করে।সেই সময়ে এক পরিচয় বিহিন ব্যক্তি মাটি দিয়ে চৌকা টালি তৈরি করে সেখানে কিছু আঁক বুকি করে ছাগল আর ষাঁড় শক্ত কাঠির সাহায্যে এঁকে রাখে। এই ছোট্ট ঘটনাই ইতিহাস বদলে দেয়। এটি লেখা না হলেও লেখার সঙ্গে এর অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে জন্ম নেয় লেখা-পড়ার।
এই আঁকাই এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ শুরু করল। প্রথমদিকে আঁকাবাঁকা আঁকাই একটু অন্য রুপ দিয়ে ব্যবহার হতো লেনদেনের হিসাব রাখতে। খ্রীষ্টপূর্ব ২৬০০ সালে কিউনিফর্ম লিপির শুরুর উদ্ভাবনের মাধ্যমে লেখার ধরন আরও উন্নত হয়। এটি তখন আইন, রাজাদের বীরত্বগাথা এবং লেনদেনের তথ্য নথিভুক্ত করার কাজে ব্যবহৃত হতো।
মেসোপটেমিয়ায় তখন একজন লেখক বা পাঠক হওয়া ছিল বিরাট গর্বের বিষয়। যদি কোনো রাজা পড়তে জানতেন, তাহলে তিনি তা তার শিলালিপিতে ঈঙ্গিত দিয়ে গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করতেন, আমি একজন পড়তে জানা রাজা। কবে থেকে পায়রাকে সংবাদ আদান প্রদানের কাজে ব্যবহারের শুরু হয়েছিল, কবে থেকে ওদের রেহাই দেওয়া হয়েছিল, বিষয়টি নিয়ে এখনো গবেষকরা গবেষণায় ব্যস্ত। কিন্তু মেসোপটেমিয়ান সংস্কৃতিতে পাখিদের পবিত্র বলে মনে করা হতো তা প্রমাণিত হয়েছে। পাখিরা ভেজা মাটিতে তাদের পায়ের ছাপে যে সব চিত্র বা চিহ্ন করতো, তা দেখতে কিউনিফর্ম লিপির মতো লাগত। এ ধরনের চিহ্নগুলো তখনকার দিনে ওই মানুষরা মনে করতো পাখির মাধ্যমে অজানা শক্তিশালী ঈশ্বর কোনো বার্তা পাঠিয়েছেন।
হন্যে হয়ে অনেক অনেক খোঁজাখুজিঁর পর আমরা জানতে পারি প্রথম নামযুক্ত লেখক ছিলেন আক্কাদীয় রাজকুমারী ও পুরোহিত এনহেদুয়ান্না। তিনি খ্রীষ্টপূর্ব ২৩শ শতাব্দীতে মন্দিরের দেবতাদের খুশি করতে তাদের উদ্দেশ্যে ছন্দ রচনা করেন এবং নিজের নাম মাটির টালিতেই খোদাই করেন। এটিই ছিল প্রথম, যিনি লেখকদের পক্ষ থেকে 'প্রিয় পাঠক' বলে লেখকরা পাঠকদের সম্বোধন করে পাঠকদের পড়ার জন্য উৎসাহী করেছিল।
লেখাগুলি পড়ার জন্য ও এক বর্ণময় ইতিহাস পাওয়া যায়। প্রাচীন লেখাগুলো উচ্চস্বরে পড়ার জন্য তৈরি হতো। শব্দগুলো ধারাবাহিকভাবে লেখা থাকত, যা দক্ষ পাঠক উচ্চারণের মাধ্যমে শ্রোতাদের মন জয় করতো। খ্রীষ্টপূর্ব ২০০ সালের দিকে প্রথমবারের মতো বিরাম চিহ্নের আর্বিভাব ঘটে, তবে এটি মধ্যযুগ পর্যন্ত প্রচলিত থাকলেও কোন নিয়মকানুন ছিল না। এলোমেলো ছিল।
মানুষ কিন্তু প্রথম থেকেই প্রচার যে এক শক্তিশালী হাতিয়ার তা বুঝতে পেরেছিল। লিখিত তথ্য সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাত জনসমক্ষে উচ্চস্বরে পাঠের মাধ্যমে। রাজকীয় দরবার ও মঠে সবার সামনে দ্রুত প্রচারের জন্য পাঠ করা হতো। ১১ ও ১২ শতকে গল্পকার এবং জাদুকরদের পরিবেশনা জনপ্রিয় ছিল।যারা গল্প লিখে সুন্দর গলায় গল্পকথন পড়তে, বলতে পারতো তাদেরই বিশেষ কদর ছিল। বিষয়টি জেনে আমারা অবাক হই, সাধারণ ঘরেও রোমান যুগ থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত খাবার টেবিলে বসে খাওয়ার আগে বই পড়ে নিজেদের মধ্যে আনন্দদায়ক পরিবেশের সৃষ্টি করা হতো (যা এখন বোকা-বাক্সের অধীনে)। রোমান সভ্যতায় লেখকদের লেখা জনসমক্ষে পাঠ করার রীতি গড়ে ওঠে। চার্লস ডিকেন্সের সুপরিকল্পিত পাঠ থেকে শুরু করে অনেক লেখকের গম্ভীর কণ্ঠে পাঠ, আবার অনেকে সুর করে পাঠ করে জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা করতেন। ও দিকে ইতিহাসের কি পরিহাস, তখনও রাজা, ধর্ম গুরু, শক্তিশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বা তাদের পছন্দসই না হলেই স্রস্টাদের নিষিদ্ধ করা হতো। নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণের স্বাদ অতুলনীয়। জাঁ জ্যাক, রুশোর মতো যে-সকল লেখক ছিলেন নিষিদ্ধ তালিকায়, তাদের লেখা শুনতে, জানতে বন্ধু বান্ধবদের ঘরে লুকিয়ে পাঠের আয়োজন করা হতো। পাঠকেরা, শ্রোতারা যথাযথ সময়ে নির্দিষ্ট বাড়িতে পৌঁছে যেত।
"সখি নীরবে নিভৃতে আমার নামটি লিখে রেখো –।" অর্ন্তনিহিত বিষয়টি কিন্তু আদিকালেই সৃষ্টি হয়েছিল। সেই সময়ে মনে মনে পড়ার এক আন্তরিক আনন্দের সন্ধান পায় পাঠকরা। লেখাটা পড়ে নিজের মনেই হেসে ওঠা বা গালে হাত দিয়ে বিস্ময়কর মনের ভাবনায় ডুবে যাওয়ার এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছিল। নীরব পাঠ ছিল তখন এক অদ্ভুত অভ্যাস। খ্রীষ্টপূর্ব ৩৩০ সালে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট তার মায়ের একটি চিঠি নীরবে পড়েন, যা দেখে তার সৈন্যরা মুগ্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে সেন্ট অগাস্টিন তার "কনফেসানস"এ সেন্ট অ্যামব্রোসের নীরবে পাঠ করার দক্ষতায় বিস্ময় প্রকাশ করেন। নবম শতকে মঠের লাইব্রেরিগুলোতে "নীরব কাজের" নিয়ম চালু হয়। তখনকার লাইব্রেরির পরিবেশ আধুনিক লাইব্রেরির মতো শান্ত ছিল না।সবাই জোরে জোরেই বার্তার আদান-প্রদান করতো। কোলাহল ছিল নিয়মিত বিষয় যাকে আমরা এখন খোলা হাটের সঙ্গে তুলনা করি। সম্প্রতি ব্যাঙ্গালোরে এক পার্ক চালু হয়েছে পাঠকরা আত্মমগ্ন হয়ে বই পড়বে। কথা কম। কাজ বেশি নীতিমালা কে গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে। নীরব পাঠের ফলে বই পাঠকের কাছে আরও ব্যক্তিগত হয়ে ওঠে।
এবার পড়বেন কীভাবে। অনুসন্ধান করলে চমকে যাওয়ার মত চমৎকার চাহিদা সমূহের সন্ধান পাওয়া যায়। ১৪ শতকে চসার বিছানায় বই পড়ার পরামর্শ দেন, ওমর খৈয়াম ও মেরি শেলি বাইরের প্রকৃতিতে পড়ার পক্ষে, আর হেনরি মিলার ও মার্সেল নিজের নির্জন বাথরুমে পড়া পছন্দ করতেন। এ প্রসঙ্গক্রমে আমার নিজের ঢোল একটু নিজেই পিটিয়ে নিই। তখন আমরা আই আই টি খড়্গপুর হাসপাতালের পাশের এক চায়ের দোকানে আড্ডা মারতাম। আমার গল্পের বই "কেমন আছেন" প্রকাশিত হয়েছে। অধ্যাপক প্রদীপ মাইতি বইটা নিয়েছেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কেমন আছেন? বইটা কেমন লাগছে। উনি বললেন আমার পড়ার সুযোগ হয়নি। তবে গিন্নিকে দেখেছি, বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ছে। আমি বললাম, কেমন লাগছে, কিছু বলেছে। উনি মুচকি হেসে যা উত্তর দিয়েছেন তা আমি কোনোদিন ভুলব না, "ওর ভালো লাগছে বলেই তো বিছানায় উপুড় হয়ে পড়তে পড়তে উপভোগ করছে।" সত্যি তো জম্পেশ করে গল্পের বই পড়তে পড়ার টেবিলের থেকেও বিছানাকে বেশি পছন্দ অনেকেই করে।
সমাজ পরিবর্তনের ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখতে পাই, লেখকদের লেখার শক্তিটাই শুরু থেকেই শাসকদের কাছে বিপজ্জনক বলে বিবেচিত হয়েছে। দাসপ্রথার শিকার মানুষদের কোন মতেই লেখা -পড়ার ধারে ঘেঁষতে দেওয়া হতোনা। পড়তে নিষেধ করা হয়েছিল।ওদের জ্ঞান বৃদ্ধি হলে দাসরা বিদ্রোহ করবেই। ওদিকে ওরা দাস হলেও মানুষতো। ওরা গোপনে নিজেরা পাঠ চালিয়ে যায় এবং পড়ার মধ্য দিয়ে জ্ঞান অর্জন করতে থাকে। এই শিক্ষা তাদের নিজেদের স্বাধীনতার সংগ্রামে শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে ওঠে।
আবার দুঃখের বিষয়, সভ্যতার শুরু থেকেই শক্তিশালীরা দুর্বলদের প্রতি অত্যাচার করে আসছে। জ্ঞান আরোহণের মাধ্যমে নারীদের মনোবল বাড়বে, শক্তিশালী হবে, তাই নারীদেরও পড়তে বাধা দেওয়া হত। মননশীল নারীরা কিন্তু তাদের নিজেদের গৃহস্থালির কাজের ফাঁকে লেখাপড়া শিখে নিজেদের বলীয়ান করার অভিজ্ঞতা আদান প্রদান করতো। রাসসুন্দরী দেবী, যিনি বাংলা ভাষার প্রথম আত্মজীবনী লিখেছিলেন, তার লেখাপড়ার গল্প পড়ে সমগ্র নারী জাতিকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। রাসুন্দরী দেবী একজন প্রথম বাঙালি লেখিকা। ইনিই প্রথম পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনীর মহিলা লেখিকা হিসেবে বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে দিশা দেখিয়েছেন। উনার সন্মন্ধ্যে দুচার কথা জেনে রাখা ভালো। রাসসুন্দরী দেবীর জন্ম ১৮০৯ সালে পাবনায়, মৃত্যু ১৮৯০ সালে কলকাতায়। প্রথম ভারতীয় নারী যিনি আত্মজীবনী লিখেছিলেন এবং প্রথম বাঙালি হিসেবে তার লেখার ১৮৭৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। মাত্র চার বছর বয়সে তার পিতা পদ্মলোচন রায় মারা যান। তাঁর পৈতৃক বাড়িতে একজন মিশনারী মহিলা এক পাঠশালায় ছেলেদের পড়াতেন। সেখানেই রাসসুন্দরী কিছু সময়ের জন্য উপস্থিত থেকে বাংলা ভাষা শেখেন। ১২ বছর বয়সে ফরিদপুরের রামদিয়া গ্রামের রাজবাড়ীর নীলমনি রায়ের সঙ্গে বিবাহ হয়। সীমিত আনুষ্ঠানিক পড়াশোনার সঙ্গে তিনি ভক্তির সঙ্গে বৈষ্ণবদের বাল্মিকী পুরাণ, চৈতন্য ভাগবত পড়তেন।
খুব দুঃখের বিষয় তিনি ১২ জন সন্তানের জন্ম দিলেও সাতজন জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই মারা যায়। এতগুলো সন্তানের মৃত্যু হওয়ার পরেও তিনি দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার কারণে অসংখ্য মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছেন। স্বামীকে হারিয়েছেন নাতি-নাতনীদের প্রিয়জনদের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করার কতখানি দুঃসহ শোকের তা ফুটে উঠেছে তার লেখনীতে। তার ছেলে কিশোরী সরকার কলকাতার হাইকোর্টের একজন আইনজীবী হয়ে ওঠেন। ১৮৯০ সালে রাসসুন্দরী মারা যান। ১৮৬৮ সালে রাইসুন্দরীর আত্মজীবনী "আমার জীবন" (মাই লাইফ) প্রকাশিত হয়। বইটি দুটি অংশে বিভক্ত। প্রথমটির মধ্যে ষোলোটি ছোট রচনাবলী রয়েছে যার মধ্যে রয়েছে তার আত্মজীবনী। দ্বিতীয় অংশ ১৯০৬ সালে প্রকাশিত হয় যার মধ্যে পনেরোটি ছোট রচনাবলী রয়েছে।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর বইটির "ঘটনাবলীর বিস্ময়কর ধারাবাহিকতা" এবং অভিব্যক্তির "সহজ মাধুর্যে"র প্রশংসা করেছেন। দীনেশ চন্দ্র সেন বলেন তার গদ্য একটি "অতীত যুগের সহজ গদ্য রচনার সংক্ষিপ্তসার।" তার লেখা আমার জীবন বইটি হিন্দিতেও অনুবাদ হয়েছে।
ফিরে যাই ওই লেখাপড়ায়। কিছু কিছু সময়ে প্রতিক্রিয়াশীল শাসকরা প্রগতিশীল সাহিত্য, বইকে পুড়িয়ে প্রতিরোধ শক্তি গড়েছেন। চীনের শি হুয়াং তি তার সময়ের আগে লেখা সব বই পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। রোমান ক্যাথলিক চার্চ ১৫৫৯ সালে নিষিদ্ধ বইয়ের একটি তালিকা প্রকাশ করে। জার্মানির নাজি বাহিনীর বই পোড়ানোর ইতিহাস সবাই জানে, যার মাধ্যমে নিজস্ব আদর্শ শোষণ রাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। তবে আন্তর্জাতিক পাঠক সমাজ এই বাধা সত্ত্বেও টিকে আছে। ইতিহাস জুড়ে পাঠকরা তাদের পড়ার জগতকে আরও উন্নত করছে। চোখের পলকে পৃথিবীর এক প্রান্তদেশ থেকে পৃথিবীর অন্য প্রান্তদেশে ছড়িয়ে পরছে। পাঠক তার প্রয়োজন অনুযায়ী সময়ে শুনছে। লেখাগুলি কালের স্রোতে হারিয়ে যাবে না, নষ্ট হবে না, সেই ব্যবস্থাপত্র করে রাখছে।
পৃথিবী ধ্বংস না হলে লেখা-পড়ার জগতের ধ্বংস হবে না।
=======
তপন তরফদার। প্রেমবাজার (আই আই টি) খড়্গপুর 721306

Comments
Post a Comment