ভবিতব্য
চন্দ্রমা মুখার্জী
১
১৫ বছর পরে আবার এভাবে মুখোমুখি হতে হবে এটা কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি প্রমিতা। প্রমিতা নন্দী – একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। সবে ৪দিন হল ও নতুন শাখায় ব্রাঞ্চ-ম্যানেজার হিসেবে যোগদান করেছে। দুদিন পরেই ওপর-মহল থেকে একটি চিঠি এসেছে অনাদায়ী ঋণ(যে ঋণ ঋণগ্রহীতা শোধ করতে পারছে না) পুনরুদ্ধারের জন্য ঋণগ্রহীতার বাড়ীতে গিয়ে অবস্থা বোঝার ও সেই অনুযায়ী রিপোর্ট পাঠাতে হবে।
যাইহোক, সেই চিঠিতে অভীক বসুর নাম আছে। ব্রাঞ্চ থেকে তার সমস্ত নথি বের করে প্রমিতা জানতে পারল, অভীক বসু ৩০লাখ টাকার একটি গৃহঋণ নিয়েছিল ১০বছর আগে। গত ছমাস ধরে সেই ঋণের সুদ একেবারেই জমা পড়ছে না। কিন্তু অভীক বসুর ছবি দেখে প্রমিতা অবাক হয়ে গেল। এ তো সে-ই।
২
আসল কথায় আসা যাক। একসাথে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তো প্রমিতা নন্দী ও অভীক বসু। প্রমিতা খুব শান্তশিষ্ট,সাধারণ দেখতে,কিন্তু পড়াশোনায় খুবই ভালো। সব বন্ধুরা ওর থেকেই ক্লাসনোট চায়, এমনকি প্র্যাক্টিকালের খাতাও ওর থেকেই সাহায্য নিয়ে তৈরি করে।
অভীকও মোটামুটি ভালোই পড়াশোনায়। বড়লোক বাড়ির ছেলে, কলেজে আসে কখনো দামী বাইকে চড়ে, কখনো আসে গাড়িতে করে।
এইরকম দুই বিপরীতধর্মী মানুষের মধ্যে কি করে যেন বন্ধুত্ব হয়ে গেল। তারপর সেই বন্ধুত্ব থেকে প্রেম,ভালোবাসা। বন্ধুরা সবাই ওদেরকে ক্ষ্যাপাতো। দুজনে সেটা উপভোগও করতো।
এইভাবেই কলেজ জীবন পার হয়ে গেল। ওরা দুজনেই একসাথে চাকরি পেল একটি বড় আইটি কোম্পানিতে। দিন ভালোই কাটছিল।
প্রমিতার লক্ষ্য দুবছর চাকরি করে উচ্চশিক্ষা লাভ করবে। অভীক বলে, 'তুই যা করতে চাস,করে ফিরে আয়। তারপর আমরা একসাথে থাকবো।' কিন্তু প্রমিতা চায় বিয়ে করে তারপর ও পড়তে যাবে।
একদিন প্রমিতা, অভীককে ওদের অফিস ক্যান্টিনে ডাকল – 'শোন্ না,অভীক,আমরা তো পরে হলেও বিয়ে করবো,চল্ না, আগেই করেনি, তারপর পড়তে যাবো। বাড়ীতে বাবা-মাকে বলেছি। ওঁরা তোর বাবা-মার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে চান। তুই কি বলিস?'
এই কথাটা শুনে অভীক হ্যা হ্যা করে হাসতে লাগল। এতো জোর হাসতে লাগল যে, আশেপাশের সবাই ওদের দিকে তাকাতে লাগল। প্রমিতার অস্বস্তিবোধ করতে লাগল।
অভীক হাসি থামিয়ে বলল, 'তুই সব কথা এতো সিরিয়াসলি নিস কেন প্রমিতা? তোকে কেন আমি বিয়ে করতে যাবো? তোর আর আমার স্ট্যাটাসটা একবার চেক করেছিস? করিসনি তো? আমি করাচ্ছি। তোর বাবার তো সামান্য চাকরি, আর তুই নিজেও তো সাধারণ দেখতে। আমার বাবার এতো বড় ব্যবসা, আমি তো এখানে যে চাকরি করি ওটা এমনি, সবাই করে, তাই আমিও করছি। কিছুদিন পরে আমিও ব্যবসা-ই করবো। তোর মতো মেয়েকে কেন আমি বিয়ে করবো রে?'
প্রমিতা হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইল অভীকের দিকে। তারপর বলল, 'তাহলে এতোদিন যা বলেছিস, যা করেছিস সেগুলো সব মিথ্যে ছিল?'
'ওগুলো তো টাইমপাস আর তোর ফায়দা তোলা। তোর থেকে সবাই নোটস নিতো, আমি যাতে আগে পাই আর তুই যাতে আমাকে স্পেশাল ট্রিট করিস। তাতে আমি তোর থেকে বেশি সুবিধে পাবো। অন্যদের থেকে নম্বর বেশি পেয়ে আমি এগিয়ে থাকবো। আর এই তোর মাস্টার্সের পর বিয়ে করার কথা তো বলতামই তোকে কাটাতে। কি বোকা মেয়ে রে তুই।' – অভীক বলে আবার হাসতে লাগল।
প্রমিতার কান মাথা গরম হয়ে গেছে। ও আর মুখ তুলে তাকাতে পারছে না। চোখ জলে ভরে গিয়ে ঝাপসা হয়ে গেছে। চশমাটা খুলে নিয়ে কোনমতে ওখান থেকে ও উঠে এল।
সেই শেষ দেখা অভীকের সাথে। তারপর এত বছর পরে এই প্রথম।
৩
সেদিন বাড়ি আসার পরে প্রমিতা খুব ভেঙে পড়েছিল। ওর অবস্থা দেখে ওর মা বলেছিলেন, 'আমরা ওর বাবা-মার সাথে কথা বলবো? ওঁরা ওকে বুঝিয়ে বললে ও বুঝবে।' বাবা বলেছিলেন, 'তুই যা চাইবি, তাই করবো। তুই বললে আমি কথা বলবো, আর তুই না চাইলে নয়।'
প্রমিতা সেদিন কোন কথা বলেনি। কিন্তু দুদিন পরে বলেছিল, 'অভীকের সঙ্গে তোমরা কোন যোগাযোগ করবে না। একদিন এমন দিন আসবে, যেদিন আমি ওর থেকে অনেক এগিয়ে যাবো, হয়তো সেদিন আমাদের দেখা হবে না, কেউ কারুর ব্যাপারে জানতে পারবো না। তবুও এমন দিন আসবে।'
৪
এমন দিন সত্যিই এল, তবে এভাবে আসবে প্রমিতা ভাবেনি। আজ অভীকের বাড়ি গিয়ে দেখল, অভীক শয্যাশায়ী। ৪বছর আগে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় ওর শরীরের নীচের অংশ পুরোপুরি অসাড় হয়ে গেছে। দুর্ঘটনায় ওর স্ত্রী মৃত, একমাত্র পুত্রকে তার বড়লোক মামাবাড়ি নিয়ে চলে গেছে। পঙ্গু পিতার সঙ্গে তারা কোনরকম যোগাযোগ রাখতে দিতে চায় না পুত্রকে।
বাড়ীতে শুধু অভীক আর ওর মা। চাকরি ছাড়ার পর বাবার সাথে ভালোই ব্যবসা করছিল অভীক। কিন্তু ৪বছর আগের দুর্ঘটনা সব তছনছ করে দেয়। তাও এতোদিন ধরে অভীকের বাবা ঋণ শোধ করছিলেন, একা অশক্ত শরীরে ব্যবসাটাও কোনমতে চালাচ্ছিলেন। কিন্তু ছমাস আগে তিনিও মারা গেছেন। তারপর থেকেই আর ঋণ শোধ হচ্ছে না।
অভীকের মা একা মানুষ। চিঠি পেয়েও তাই কিছু করতে পারেননি। উনি বললেন, 'তুমি আমার ছেলের বন্ধু ছিলে, আমি তোমার ছবি দেখেছি। আজকাল ছেলে পুরনো কথা বলে। তোমাকে দেখে কিছু বলতে পারেনি। কিন্তু আমাকে প্রায়ই বলে, যে তোমার সাথে অমন ব্যবহার করেছিল বলেই হয়তো ভগবান ওকে এমন শাস্তি দিলেন। মা, তুমি দেখো না, আমার ছেলেকে যেভাবেই হোক ঋণমুক্ত করা যায় কিনা। আমাদের এই বাড়িটা ছাড়া দেওয়ার মতো আর কিছু নেই। যা ছিল, সব ওর চিকিৎসাতেই বেরিয়ে গেছে। ডাক্তার বলেই দিয়েছেন, বাইরে যদি নিয়ে যাই, তবেই কিছু উন্নতি হতে পারে। সে ক্ষমতা আমার নেই। তুমি শুধু ঋণমুক্ত করার ব্যবস্থা করে দাও।'
৫
সমস্ত রিপোর্ট নিয়ে প্রমিতা বেরিয়ে এল। এই বাড়িটাই বন্ধক হিসেবে ঋণ নেওয়া হয়েছে। তাই বাড়িটাই হয়তো নিলাম করে টাকা তুলবে ব্যাঙ্ক। প্রমিতা সামান্য ব্রাঞ্চ ম্যানেজার, ওর হাতে কিছু নেই।
আজ ওর সুখী সংসার। কিন্তু অভীকের এরকম লঘু পাপে গুরুদণ্ডও তো চায়নি। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। ভগবান ঠিক সবাইকে তার প্রাপ্য ফিরিয়ে দেন।
=====================
চন্দ্রমা মুখার্জী

Comments
Post a Comment