দেবাংশু সরকার
রোজ সকালে বিকালে বাদুড় ঝোলা, ঝুলে অফিসে যাতায়াত করতে করতে রবীন বাবুর জীবনের অনেকটা সময় কেটে গেছে। চাকরি জীবনের প্রায় দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছেন তিনি। আর যে কয়েক মাস চাকরির বাকি আছে, এভাবে বাসে ঝুলতে ঝুলতে কাটিয়ে দিতে হবে। যখন শরীরে শক্তি ছিল, মনে এনার্জি ছিল, তখন ভিড় বাসে ঝুলতে ঝুলতে যাতায়াতটাকে কোনও সমস্যা বলে মনে করতেন না রবীন বাবু। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সব কিছুরই পরিবর্তন হয়। অনেক সহজ কাজও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এখন বয়স বেড়েছে রবিন বাবুর শরীরের সক্ষমতাও পাল্লা দিয়ে দিনে দিনে কমছে। কমছে মনের জোর। এখন ভিড় বাসে যাতায়াত করাটা তার কাছে রীতিমতো বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যতদিন যাচ্ছে, ততই যেন বাসে ভিড় বাড়ছে। সেইসঙ্গে রাস্তায় বাসের সংখ্যাও যেন দিনে দিনে কমে আসছে। আগে পাঁচ দশ মিনিট অন্তর বাস আসতো এখন রবিন বাবুকে প্রত্যেকদিন প্রায় আধঘন্টা বাসের জন্য বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়। ক্রমশ যেন অফিসে যাতায়াত কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ছে রবীন বাবুর পক্ষে। শরীর আগের থেকে বেশ কিছুটা ভারী হয়েছে। বাসের ফুট বোর্ডে কোনও রকমে পা রেখে যাতায়াত করাটা তার পক্ষে সত্যিই বেশ ঝুঁকিবহুল হয়ে পড়েছে। তার উপর আরও একটা সমস্যা রয়েছে আগে বাসগুলোর দুটো গেট থাকতো। এখন সিটের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য বাসের পেছনের গেটটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে রবীন বাবুর মত বয়স্ক নিত্যযাত্রীদের বাসে ওঠার সমস্যাটা আরও বেড়ে গেছে। আগে যখন দুটো গেট ছিল। তখন রবীন বাবু পেছনের গেট দিয়ে বাসে উঠতেন। কোনও কোনও দিন ভেতরে ঢোকার সুযোগ পেতেন। তবে বেশিরভাগ দিন ঝুলতে ঝুলতে যেতে হত। আর এখন বাসের ভেতর ঢোকার কোনও সুযোগই পান না। প্রত্যেকদিনই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করতে করতে একেবারে জেরবার হয়ে পড়েছেন। কিন্তু কিছু করার নেই যতদিন চাকরি করবেন এভাবেই চালিয়ে যেতে হবে। রবীন বাবু মনে মনে দিন গুনছেন অবসরের। কিন্তু এখনও কয়েক মাস বাকি আছে সেই দিনটা আসতে। কবে যে শেষ হবে এই ক'টা মাস, এই ক'টা দিন! ভেবে পান না রবীন বাবু।
ঘটেই গেল অঘটনটা। যে ভয়টা তিনি মাসের পর মাস পাচ্ছিলেন, সেটাই ঘটে গেল। রবীন বাবু তার ডান পাটা কোনও রকমে ফুটবোর্ডে রাখতে পেরেছিলেন। বাঁপাটা শূন্যে ঝুলছিল। বাসের রড ধরতে না ধরতেই বাসটা ছেড়ে দিল। যেই বাসটা একটু গতি বাড়ালো, ফুট বোর্ডে থাকা তার পা পিছলে গেল। তিনি সম্পূর্ণভাবে ঝুলে পড়লেন। তার মেদবহুল ভারী শরীরের ভারে ছেড়ে গেল বাসের রড ধরে থাকা তার হাত দুটো। তিনি ছিটকে পড়লেন রাস্তায়।
পথ চলতি মানুষজন, বাস থেকে রাস্তায় ছিটকে পড়া রবীন বাবুকে ধরাধরি করে একটা দোকানের বেঞ্চে বসালেন। পায়ে, কোমরে, পিঠে তিনি চোট পেয়েছেন। যন্ত্রনায় কাতর হয়ে উঠেছেন। তার চোখে মুখে ফুটে উঠছে যন্ত্রণার ছাপ। বেঞ্চে বসা রবীন বাবুকে ঘিরে রয়েছেন বেশ কয়েকজন। তাদের মধ্যে অনেকেই রবীন বাবুর চেনা।
তাদের মধ্যে একজন বললেন, "রবীনদা, আজ জোর বাঁচা বেঁচে গিয়েছেন। একটু এদিক-ওদিক হলেই আপনি চাকার তলায় চলে যেতেন। সত্যিই আপনার ভাগ্য আজ খুব ভালো।" রবীন বাবু চুপ করে থাকেন।
অন্য আরেকজন একটা জলের বোতল রবীন বাবুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে দিয়ে বললেন, "চলুন দাদা আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই। যেভাবে বাস থেকে ছিটকে পড়লেন, আমিতো ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিয়েছিলাম। ভাবলাম চাকার তলায় চলে গেছেন। আজকের দিনটা আপনার পক্ষে মোটেই ভালো নয়। আজ আর আপনার অফিসে যাওয়ার দরকার নেই। বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম নিন। পারলে মায়ের মন্দিরে গিয়ে আপনার নামে পুজো দিয়ে আসবেন। সত্যিই আজকের দিনটা আপনার পক্ষে খুবই খারাপ। খুব সাবধানে থাকবেন অন্তত আজকের দিনটা।"
এবারেও রবীন বাবু, কোনও উত্তর না দিয়ে ভাবতে থাকেন, একজন বলল আজ তার ভাগ্য খুব ভালো। আবার অন্য একজন বলল আজ তার ভাগ্য খুব খারাপ। কোনটা ঠিক ভাবতে থাকেন রবীন বাবু।
।। সমাপ্ত।।
দেবাংশু সরকার।
এম জি রোড বজ বজ,
কলকাতা ১৩৭।

Comments
Post a Comment