First row (left to right): Prafulla Nalini Brahma, Shanti Ghosh, Suniti Chowdhuri and Bina Das.
Second row (left to right): Kamala Dasgupta, Suhasini Ganguly, Pritilata Waddedar and Sarojini Naidu.
Third row (left to right): Abha Maity, Sucheta Kripalini, Lila Nag and Abha Gandhi.
Fourth row (left to right): Indusudha Ghosh, Kalpana Dutta, Aruna Asaf Ali and Matangini Hazra.
Second row (left to right): Kamala Dasgupta, Suhasini Ganguly, Pritilata Waddedar and Sarojini Naidu.
Third row (left to right): Abha Maity, Sucheta Kripalini, Lila Nag and Abha Gandhi.
Fourth row (left to right): Indusudha Ghosh, Kalpana Dutta, Aruna Asaf Ali and Matangini Hazra.
Fifth row (left to right): Basanti Devi, Renuka Ray, Phulorenu Guha and Manikuntala Sen.
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে
চেনা-অচেনা বরণীয় নারী
হিমাদ্রি শেখর দাস
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে পুরুষের সাথে মহিলারাও কখনও অন্তরালে থেকে কখনও প্রকাশ্যে এসে লড়াই করেছেন। মেয়েদের বাইরে বেরিয়ে লাঠিখেলা, পিস্তল চালানো, রাত্রে ছেলেদের সঙ্গে ঘুরে বেরানো, পুলিশের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা, জেলে যাওয়া ছিল অত্যন্ত দুঃসাহসিক কাজ। তবু তৎকালীন সমজে কোনঠাসা হয়ে থাকা মেয়েরাও নিজ নিজ জায়গায় থেকে দেশের সেবা করেছেন তা অসম্ভবকে সম্ভব করার মতই দুরুহ কাজ। তাঁদের মধ্যে দু একজন রাজ পরিবারের হলেও বেশির ভাগই ছিল সাধারণ ঘরের অতি সাধারণ মেয়ে। সাঁওতাল বিদ্রোহ থেকে মুন্ডা বিদ্রোহ, আইন অমান্য আন্দোলন থেকে ঝাঁসির রানী বাহিনী হয়ে তেভাগা আন্দোলন, সবেতেই নারীর দৃষ্টান্ত মূলক অবদান রয়েছে। কেউ নেতৃত্ব দিয়েছেন, কেউ প্রাণ দিয়েছেন, কেউ গোপনে সহযোগিতা করেছেন।
দেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালীন হাজার হাজার বিপ্লবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী পরাধীন ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে মুক্ত করবার জন্য ব্রিটিশ শাসকের নির্মম নির্যাতন যথা থানার লক-আপে অত্যাচার, জেল, প্রহার, দ্বীপান্তর ইত্যাদি সহ্য করে ও নিজেদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করে স্বদেশী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই বীরদের মধ্যে নারীদেরও একটা গৌরবময় ভূমিকা ছিল। উল্লেখ করা যেতে পারে অনেক নাম। কলকাতার অরুণা দাসগুপ্ত, আভা দে, সরযুবালা সেন, কুমুদিনী দাসী, কৃষ্ণা মিত্র, প্রভাবতী দেবী, শৈলবালা ঘােষ প্রমুখ স্মরণীয়। ২৪- পরগণার শিবকালী দেবী, অমলাদেবী, মাতঙ্গনী করণ, হুগলীর বিনয়বালা দেবী, আতরবালা দাসী,চারু দাসী, বীণাপানি দে, কুমুদিনী দাসী, হাওড়া জেলার সুশীলা দেবী, হীরা দেবী, লক্ষ্মী বাই,কমলিনী সরকার প্রমুখ স্মরণীয় হয়ে আছেন। গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হবে বর্ধমান জেলার জ্ঞানপ্রভা দেবী, নির্মলবালা সান্যাল, সুষমা দেবী, মঞ্জুরানী ঘােষ, দুর্গারানী দেবী, বাঁকুড়া জেলার বসন্তকুমারী দেবী, সরােজিনী বাগচী, চারুবালা দাসী, ইন্দুমতী ঘােষ, সুহাসিনী দাসী, নদীয়ার বিভারানী দাসী, সুপ্রীতি মজুমদার, অর্পনা অধিকারী, সাবিত্রী দেবী, লীলাবতী দেবী, বীনা দাস, মেদিনীপুরের মাতঙ্গিনী হাজরা, কিরণবালা মাইতি, লক্ষ্মীরানী দেবী, বাসনবালা মাইতি, মনােরমা দাসী, বসন্তকুমারী বেরা, চট্টগ্রামের প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা সিংহ, ইন্দুমতী সিংহ, খুলনার চারুবালা বসু,ময়মনসিংহের ঊষা গুহ, বরিশালের প্রফুল্লমুখী বসু, রাজশাহীর বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী, পুরুলিয়ার লতিকা ঘোষ মুর্শিদাবাদের মৃনালিনী দেবী, মনিমালা দেবী, কালীদাসী দেবী, জ্যোর্তিময়ী বাগচী, লাবন্যপ্রভা দত্ত, নিরুপমা দেবী, সুবর্ণলতা ভট্ট, বেলারানী দাসী ইত্যাদি বরণীয় চরিত্রকে। ১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর গান্ধীজীর ডাকে দেশের শুধু শিক্ষিত মেয়েরাই নয়, স্কুল কলেজের লেখাপড়ার সুযােগ থেকে বঞ্চিত গ্রাম ও শহরের জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বহু নারী স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন। সূচনাপর্বে শিক্ষিত অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরে সংগ্রাম গণচরিত্রের রূপ নিলে ধীরে ধীরে সাধারণ ঘরের মেয়েরাও স্বতস্ফূর্তভাবে মিটিং মিছিলে যোগদান, মদের দোকানে পিকেটিং, আইন অমান্য, কারাবরণ এমনকি অনশনে ও ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। কখনো কখনো নেতৃত্বও দেন। যে সমস্ত পরিবারের পুরুষেরা স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন, সেই সমস্ত পরিবারের বেশীরভাগ মেয়েরা সর্বদা প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে বিপ্লবীদের আশ্রয় দিয়ে, খাবার দিয়ে, খবর সংগ্রহ করে স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, বিকশিত করেছেন, উজ্জীবিত করেছেন এ কথা বলা যেতে পারে।
কিছু বিদুষী নারীর কথা আলোচনা করছি, যাদের অনেকেই ইতিহাস মনে রাখেনি।
বিপ্লবী অমরেন্দ্র চ্যাটার্জীর ষোল বছরে বিধবা পিসিমা ননীবালা দেবী ( ১৮৮৮-১৯৬৭) নিজে উৎসাহী হয়ে ভাইপোর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। ননীবালা দেবী চন্দননগর বা রিষড়াতে বাড়িওয়ালা সেজে ঘরভাড়া নিয়ে বিপ্লবীদের আশ্রয় দিতেন আর পুলিশের চোখে ধুলো দিতেন।
বীরভূমের বিপ্লবী নিবারন ঘটকের মাসিমা দুকড়ি বালা দেবী ( ১৮৮৭- ১৯৭০) যিনি জেলে গিয়ে ননীবালাদেবীর জন্য রান্না করেছিলেন। বিপ্লবীদের 'মাসিমা' দুকড়ি বালা আশ্রয় দিতেন জ্যোতিষ ঘোষ, বিপিন গাঙ্গুলীর অনেক বিপ্লবীকে। । বিপ্লবী হরিদাস দত্ত চুরি করা সাতটি পিস্তল দুকড়িবালা দেবীর কাছেই রাখা ছিল। ১৯১৭ সালের ৮ই জানুয়ারি ধরা পড়ে শিশু সন্তানকে রেখে তৃ্তীয় শ্রেনীর কয়েদি হয়ে দু বছরের জন্য জেলে গিয়েছিলেন ।
কটকের কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক বেণীমাধব দাসের দুই মেয়ে কল্যাণী দাস (১৯০৭-১৯৮৩) ও বীণা দাস স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ পড়া কালীন 'ছাত্রীসংঘ' গঠণ করেন। এই সংঘের সম্পাদক ছিলেন কল্যাণী দাস। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, বীণা দাস, সুহাসিনী গাঙ্গুলী, ইলা সেন, সুলতা কর, কমলা দাশগুপ্তর মত আন্দোলনকারীরা যোগ দেন। এখানে মেয়েদের স্বাধীনতা সংগ্রামী তৈরি করা হত। তাঁদের সাঁতার শিক্ষা, সাইকেল চড়া শিক্ষা, ফার্স্ট এইডের শিক্ষা দেওয়া হত। কমলা দাশগুপ্ত ( ১৯০৭-২০০০) জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটান জেলে। বাড়ি ছেড়ে হস্টেলে থাকতে শুরু করলেন। এই হস্টেলেই তিনি ট্রাঙ্ক ভর্তি করে বোমা লুকিয়ে রাখতেন, যে বোমা ব্রিটিশদের ওপর আঘাত হানার জন্য ব্যবহার করা হত। প্রয়োজনে হস্টেলের ভাঁড়ার ঘরেও বোমা রেখেছেন । এই বোমা কখনও কমলা দাশগুপ্ত নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছে দিতেন, কখনও হস্টেলে এসে নিয়ে যেত অন্য বিপ্লবীরা। এর পর ডালহৌসি স্কোয়ার ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন কমলা দাশগুপ্ত। । বীণা দাস যে পিস্তল দিয়ে গভর্নরকে গুলি করেছিলেন সেটি তাঁরই গোছানো টাকায় কেনা হয়েছিল। কিন্তু বীণা দাসের গভর্নরকে গুলি চালানোর চক্রান্তের সঙ্গে কমলা দাশগুপ্ত জড়িয়ে আছেন সন্দেহে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। মহিলাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার জন্য "মন্দিরা" বলে একটি পত্রিকা চালাতে শুরু করলেন তাই নয় গ্রামে গ্রামে ঘুরে মেয়েদের সঙ্ঘবদ্ধ করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। ৪৬ এর নোয়াখালির দাঙ্গায় ধর্ষিত মহিলাদের বিবাহের ব্যবস্থা করার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপণ দিয়েছিলেন।
ভারতি পত্রিকার সম্পাদক সরলাদেবী (১৮৭২- ১৯৪৫) লিখেছিলেন, "বিলিতি ঘুষি বনাম দেশী কিলো"। তাতে লিখেছিলেন - "ভারতীর পৃষ্ঠার আমন্ত্রণ করলুম, রেলে, স্টিমারে, পথে, ঘাটে, যেখানে সেখানে গোরা সৈ্নিক ও সিভিলিয়ানদের হাতে স্ত্রী, বোন, মেয়ে বা নিজের অপমানে ভেঙ্গে না পড়ে হয়ে আদালতে নালিশের আশ্রয় না নিয়ে –অপমানিত ক্ষুব্ধ মানী ব্যক্তি নিজের হাতে অপমানের প্রতিকার নিয়েছে- তাদের ইতিবৃত্তের ধারাবাহিক বর্ণনা পাঠাতে। তাঁরা পাঠালেন ও তাঁদের ইতিবৃত্ত 'ভারতী'তে বের হতে থাকল। পাঠক মণ্ডলীর মনে লুকানো আগুন ধুঁকিয়ে ধুঁকিয়ে জ্বলে উঠল প্রবল বেগে"। শরীর চর্চায় উত্সাহ দেবার জন্য কুস্তিগীর ও পালোয়ানদের কাছে ব্যায়াম শিক্ষা ও চর্চার ব্যবস্থা করেন। আবার স্বদেশি জিনিসের ব্যবহার প্রচলের জন্য "লক্ষ্মীর ভাণ্ডার" "স্বদেশি স্টোর্স" খুলেছিলেন। এটি ছিল মেয়েদের জন্য স্বদেশি জিনিসের দোকান। এই দোকানে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে স্বদেশি জিনিস সংগ্রহ করে আনা হত। । "বন্দে মাতরম" গানটির প্রথম দু লাইনের সুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বসিয়েছিলেন। পরের সুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুরোধে সরলাদেবী দিয়েছিলেন।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের আহ্বানে সবার আগে এগিয়ে এসেছিলেন বাসন্তী দেবী (১৮৮০-১৯৭৪) আইন অমান্য আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১৯২১ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে মেয়েরা যখন খুব একটা এগিয়ে আসেনি, বাসন্তীদেবী মেয়েদের নিয়ে সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন। মেয়েদের দিয়ে চরকার প্রচলন করেছিলেন।
পাঞ্জাবের মেয়ে সুচেতা কৃপালনী (১৯০৮- ১৯৭৪) ছাব্বিশ বছর বয়সে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার সময় থেকেই দেশের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৩৪ সালে বিহারে ভূমিকম্পের সময় বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামে থেকে মাসের পর মাস ত্রাণের কাজ করেছিলেন। কংগ্রেসের বৈদেশিক বিভাগেও যুক্ত ছিলেন। ১৯৪০ সালে গান্ধীজির সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন। বিচারে তাঁর দেড় বছরের জেল হয়েছিল। নোয়াখালির দাঙ্গাপীড়িত নারী ও শিশুর পাশে দাঁড়ান আবার পাঞ্জাবের দাঙ্গার পর সেখানকার মানুষের পাশে ছুটে যান।
সরোজিনী নাইডু (১৮৭৯- ১৯৪৯) ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ এর সময় সরাসরি স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। দেশের সেবা করবেন বলে ১৯১৫ সালে জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন । তিনি ছিলেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভাপতি।
বিহারে নীল চাষিদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, কখনও নারী মুক্তি ও শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকারের জন্য প্রচারমূলক সভা করেছেন।
শ্রী অরবিন্দু ঘোষের ভাইঝি লতিকা ঘোষ (১৯০২-১৯৮৩) বিধানচন্দ্র রায়ের পরামর্শে চিত্তরঞ্জন সেবা সদনে যোগ দিয়ে দুস্থ মেয়েদের জুনিয়র নার্সিং ও ধাত্রী ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেন। ডাক্তাররা এসে ক্লাস নিতেন। আর লতিকা দেবী ইংরাজিতে রিপোর্ট লেখা শেখাতেন। কিন্তু গোপনে শেখাতেন দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলার মন্ত্র, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল ১৯২৮ এর সাইমন কমিশন বয়কট করার জন্য ওয়েলংটন স্কোয়ারে কংগ্রেসের সভায় তাঁর নেতৃত্বে মহিলাদের উপস্থিতি ও শপথ গ্রহণ।
আবাদি বানো বেগম(১৮৫০-১৯২৪) মহাত্মা গান্ধির আদর্শে অনুপ্রানীত হয়ে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সব সময় খদ্দরের কাপড় পরে দিল্লি, আমেদাবাদ ও বাংলা জুড়ে সভা করে হিন্দু মুসলমানকে ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলতেন। তাঁর আকর্ষনীয় ভাষণে আকৃ্ষ্ট হয়ে অভিজাত হিন্দু ও মুসলিম পরিবারের মেয়েরাও আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। সভায় সকলকে নিজের সন্তান বলে ঘোষণা করে তিনি ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন সকলের 'আম্মা'।
মেদিনীপুরের বালবিধবা গরিব চাষির মেয়ে মাতঙ্গিনী হাজরা (১৮৮০-১৯৪২) আইন অমান্য আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত হয়েছিলেন হৃদয়ের টানে । ১৯৪২ সালে ২৯ শে সেপ্টেম্বর মেদিনীপুরের তমলুকে প্রায় আটহাজার বিপ্লবী যে শোভাযাত্রায় যোগ দেয়েছিল, তার সামনের সারিতে ছিলেন তিয়াত্তর বছরের বৃ্দ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা। ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধান অনিল কুমার ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে পুলিশ শোভাযাত্রায় গুলি চালিয়েছিল। পুলিশের গুলি মাতঙ্গিনীর কপালে গুলি খেয়েও জাতীয় কংগ্রেসের পতাকা উঁচু করে ধরে ছিলেন ।
নেলী সেনগুপ্ত ওরফে নেলী গ্রে ইংল্যান্ডের কেম্ব্রিজ শহরের বাসিন্দা উইলিয়াম গ্রে ও এডিথ হেন্রিয়েটা গ্রের সন্তান ছিলেন। স্বামীর যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের মতো তিনি পরাধীন ভারতকে স্বাধীন করার জন্য দেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ১৯২১ এ আইন অমান্য আন্দোলনের সময় চট্টগ্রামে খদ্দরের কাপড় বিক্রি করেছেন, নিজে বিদেশি হয়ে বিদেশি জিনিস কিনতে নিষেধ করেছেন। ১৯৩০ এ দিল্লী অমৃতসরে গিয়ে সভা করে তাঁকে দিল্লীর সভা থেকে গ্রেফতার করায় চার মাসের জেলও হয়েছিল।
যশোরের দৌলতউন্নেষা (১৯১৮-১৯৯৭) ১৯৩২ এ আইন অমান্য আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল মাত্র ১৪ বছর বয়সে। 'গাইবান্ধা মহিলা সমিতি'র সম্পাদক হয়েছিলেন কম বয়সেই। তাঁর জ্বালামুখী বক্তৃতার টানে সাত আটটা গ্রামের মেয়েরা, মুসলমান মেয়েরাও পর্দা সরিয়ে ছুটে আসত তাঁর সভায় যোগ দিতে। ফুলছড়ি গ্রামের একটি সভা থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে রাজশাহী, প্রেসিডেন্সি, বহরমপুর জেলে পাল্টে পাল্টে রাখা হয়েছিল।
ঢাকার বিক্রমপুরের ফুলবাহার বিবি (১৯১৬- ?) বড়ভাই তমিজুদ্দীনের কাছে স্বাধীনতা আন্দোলনের দীক্ষা নিয়ে পাইকপাড়ার কিরণ রূদ্রের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। পরে গ্রেফতার হলে ছ মাসের জেল হয়েছিল তাঁর। তাঁকে ঢাকা ও বহরমপুর জেলে ঘোরানো হয়েছিল। জেল থেকে বেরিয়ে এসে কংগ্রেসের গঠণমূলক কাজে যোগ দিয়েছিলেন।
কৃষ্ণনগরের নির্মল নলিনী দেবী ১৯৩০ এ আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদিয়েছিল। ব্রিটিশ সরকারের টাকায় জীবন ধারন করবেন না বলে সরকারি কলেজের আধ্যাপক- স্বামীর বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় ঘর ভাড়া করে থাকত। ১৯৩১ সালে আইন অমান্য আন্দোলন করার সময় পুলিশ গ্রেফতার করলে তাঁর সশ্রম কারাদন্ড হয়। বারবার পরিবর্তন করে তাকে কৃষ্ণনগর, বহরমপুর, আলিপুর, হিজলীসেন্ট্রাল জেলে পাঠানো হয়েছিল ।
চামেলী গুপ্ত কলকাতার নারী সত্যাগ্রহ সমিতির সদস্য ছিলেন। তিনি বড়বাজারে শোভাযাত্রা, পিকেটিং করতেন পুরুষের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে। বড় বাজারের বিলিতি বস্ত্রের ব্যবসায়ীরা রীতিমত ভয় পেত এই উত্তর প্রদেশের কন্যাকে দেখে। তিনি গর্ভবতী অবস্থায় গ্রেফতার হয়েছিলেন। সরকার থেকে বন্ড লিখতে রাজী না হওয়ায় ছাড়াও পায়নি। জেলের মধ্যে পুত্র সন্তান জন্মের পর তাঁর। শরীর আরও খারাপ হলে সরকার বিনা শর্তে যখন মুক্তি দিয়েছিল তখন অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল, কয়েকদিন পরে চামেলী ও তার শিশুপুত্র দুজনেই মারা যায়।
মেদিনীপুরের কুসুম বাগদী দশমাসের দুধের শিশুকে বাড়িতে রেখে জেলে এসেছিলেন আইন অমান্য করে। বাড়িতে ছেলে আর জেলে মা, দুজনেই কাঁদলেও শর্তসহ বন্ড লিখে ছেলেকে কাছে পেতে চাননি কুসুম। বন্ড লেখা আন্দোলনের জন্য ছিল অপমানজনক। তিনি সে লড়াইকে কলুসিত করতে চাননি । জেলের দরজা থেকে দুধের শিশুকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। শিশুপুত্রকে ছেড়ে থাকার, বুকের দুধ না খাওয়াতে পারার যন্ত্রণা সহ্য করেছেন কোনও শর্তের কাছে মাথা নত করেননি।
তথ্যসূত্র-
১) স্বাধীনতা সংগ্রামে নারী - অগ্নিযুগ গ্রন্থমালা ৯
২) মুক্তি সংগ্রামে বাংলার উপেক্ষিতা নারী - অগ্নিযুগ গ্রন্থমালা ১০
৩) স্বাধীনতা সংগ্রামে নদীয়া।
৪) স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারীরা লেখক: লিপিকা ঘোষ
৫)স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী— কমলা দাশগুপ্ত
৬)স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে উপেক্ষিতা এক অনন্যা–মৃণালদেবী ও অচিন্ত্য সিংহ
(পত্রিকা— বহ্নিশিখা, সম্পাদক ও কবিতা সিংহ ২০০৪ জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়)
৭) Political Movement in Murshidabad 1920-1947: Bishan Kumar Gupta.
৮) জাতীয় সংগ্রামে ভারতীয় নারী ও ইপ্সিতা গুপ্ত (স্মরনিকা বহরমপুর পৌরসভা)
চিত্রঋণঃ ময়ূখ বিশ্বাসের টুইটার পোস্ট
---------০---+++++++
হিমাদ্রি শেখর দাস, বাঁশদ্রোনী, কোলকাতা
No comments:
Post a Comment