পঞ্চ-শষ্য
সুপ্রভাত মেট্যা
১) ভুল ইচ্ছে
এই কি ইচ্ছে ছিল?
এত যে গরল স্রোতে ভেসে যাওয়া লেখা নীল হয়ে আছে
কি হবে সে তার?
দেশ বড় প্লাবন হয়ে আছে।
গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়েছে হু-হু নদী, নীল পৃথিবী।
পতন গন্ধে ভরে উঠছে ভোর।
এখন শহর মেঘের আড়ালে কতটা দুঃখ পেলে
তুমি জল হয়ে ঝরো?
কতটা অন্ধকার তোমার গায়ে এসে বসলে
তুমি চক্ষু খুলে দেখো।
দেখো অন্ধকার সারা হৃদয় জুড়ে তোমার
কালো মেঘ হয়ে আছে।
এই কি শরীর তোমার, এই কি জীবন?
সহজ খুশির হাওয়া ঘন রাত্রি হয়ে আছে।
সবুজ তোমার গভীর অরণ্যে, রহস্য ছেয়ে আছে মন।
এই কি ইচ্ছে ছিল, এই কি সংসার?
শোনো বলছি।
এই তোমাদেরও, বলছি শোনো।
মস্তিষ্কের উর্বরতায়, নীরব কিছু জলঝারি বিকেল এলে
বিশুদ্ধ আলো এবং হাওয়াদেরও ডেকে নিও।
দেখবে, ইচ্ছেগুলি ভুলের পসরা কাটিয়ে ঠিক পৌঁছে যাবে
একদিন ঐশ্বরিক, ফসলভারি তোমার ঐশ্বর্যের দিকে।
২) গৃহিনী সময়
বহুদূর গ্রাম।
কাছে এলে পায়ের ধুলো পথ থেকে উঠে এসে,
তোমাকে দ্যাখে, চিনেও ফেলে মানুষ।
কেননা, সেই একই পথেই তো তার যাওয়া-আসা রোজ।
একই চেনাভূমি পড়ে থাকে, পথের দুইদিকে সবুজ।
সে দেখে দেখে আসে, দেখে দেখে যায় আর আসে।
উঠোনে সহজ বালক লিখে মৃদু ভাষা।
মায়ের পাশে উনুন, চূড়ান্ত অভাব;
তবু ফুল হয়ে ফোটে, জল হয়। সেই ফুল স্বপ্ন দেখায়।
ভাইসকাল কাঁধে ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে দেশ।
দুপুরের পাতে, পড়ে সাদা ভাত,
তাল-আলু মাখা আর ডালের সুগন্ধী সুখসারি।
কী খুশিতে স্নাত দুই চোখ,
মায়ের আলোর ভ্রমণ শেষে ফোটে গোধূলি সীমানায়!
ভাল হয়, ধুলো, মাটি আর আমার নতুন কবিতার।
দুঃখসংগ্রহের সমগ্র পৃষ্ঠায় সুখী আলো এসে পড়ে।
ঘরে ঘরে সান্ধ্য প্রদীপ,
শঙ্খলগ্ন হয়ে আসে গৃহিনী সময়।
৩) বাবা বলতেন
বাবা বলতেন
সময় পেলে একটু নিজেকে দেখিস।
অন্যদের ঠিকঠাক দেখছিস কিনা;
ঠিক তার জন্য।
আর বলতেন
কবিতা পড়িস মাঝেমাঝে।
শান্ত কথার মধ্যে মাথাকে রাখতে গেলে
এটারও খুব জরুরি, জানিস?
বলতেন
আমার ঠাকুরমা নাকি
তাঁর ঠাকুরদাকে একদিন
ক্লাসে ভূগোল পড়াতে দেখে
গোল খেতে দেখেছেন একজন ছাত্রীর কাছ থেকে।
কেন জানিস?
আসলে উনি নিজেকেই
কখনও ভূগোলই পড়াননি, তাই!
তৈরি না-থাকলে কি
কখনও তৈরি করা যায় রে?
তাই সময় পেলেই একটু নিজেকে দেখিস।
৪) নেই-দিদির আঁচল
দিদি আজ নেই! কেন যে নেই?
নেই-দিদির আঁচল,
ছায়া হয়ে লুটিয়ে পড়ছে ধুলায়।
মাটির আদরে, মাখামাখি স্নেহ ও কাজল জল
কাদা হয়ে ফুটে উঠছে পথে।
ক্রমশ পিছলে, হা-হুতাশের খাতা হয়ে ফুটে উঠছি আমি।
আমাকে অন্ধ বলছেন সবাই।
বলছেন, বুড়ো হয়ে গেছেন।
কেউ আমাকে না-দেখার ভান করে দেখে চলেছেন সারাজীবন।
দেখেও পড়ছেন না আমাকে!
আচ্ছা, গন্তব্য শেষ হয়ে যাওয়া কি সে রাস্তার অপরাধ?
দিদি আজ নেই!
এখন আর প্রশ্ন করি না।
তার বাড়িয়ে দেওয়া হাত,
আশ্চর্য চোখ,
সহজ লেখা হয়ে ওঠা আমার কবিতার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
৫) এই এক থেকে যাওয়া
ধরুন এভাবেই হারিয়ে গেলেন একদিন।
তারপর মনে পড়ল হঠাৎ,
মনে পড়ল যে, আপনি একদিন
একজন কেউ ছিলেন বলেই
আজ আপনি নেই।
আচ্ছা বলুন তো সত্যিই কি আপনি নেই?
এই যে নেই-ভাতে চলে যাওয়া
আপনার লেখার অন্ন
যেটুকু পড়ে আছে থালায়, আর
পাঠক খেয়ে-মেখে সেই বেঁচে আছে;
সেটাও একপ্রকার আপনার থেকে যাওয়া নয় কি?
এখনও কি আপনি বলবেন, বলুন?
====000====
No comments:
Post a Comment