সাহিত্যের প্রতি নিবিড় দায়বদ্ধ পত্রিকা 'আনন্দম্'
পাঠ প্রতিক্রিয়া: গোবিন্দ মোদক, কৃষ্ণনগর, নদীয়া।
১৯৮২ সাল থেকে একাদিক্রমে ৪৪ বছর ধরে একটি লিটল ম্যাগাজিনের নিয়মিত প্রকাশ বড় কম কথা নয়। আর শুধুমাত্র সাহিত্যের প্রতি নিবিড় দায়বদ্ধতা থেকে অত্যন্ত নিরুচ্চারভাবেই সেই কাজটি অত্যন্ত আন্তরিকভাবে করে চলেছেন সম্পাদক ও প্রকাশক কবি রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। আনন্দম্-এর এই ১৩৪ তম সংখ্যাটির শুরুতেই রয়েছে কবি সেখ রমজানের একটি অনবদ্য কবিতা — রবীন্দ্রনাথ।
"আমরা এগিয়ে যাই হাজার হাজার বছর
আমরা স্নান করি, পান করি, শ্বাস নিই
প্রতিটি পৃষ্ঠায় প্রতিটি শব্দে প্রতিটি বর্ণের
অমিয় সৌন্দর্যে …
তিনি আমাদের সঙ্গ ছাড়েন না কক্ষনো।"
ঠিক তারপরেই রয়েছে ফিরে পড়বার মতো আশ্চর্য সুন্দর সব কবিতা। দুর্বোধ্যতা নয়, কবি মনের স্বতোৎসারিত ঝর্ণাধারায় স্নাত হয়েছে কবিতাগুলির অবয়ব। শমিত মণ্ডলের দু'টি কবিতার প্রথমটিতে এসে পড়েছে গুলঞ্চের গাছে মরমী রোদ, হলুদ একফালি রোদ। আর দ্বিতীয় কবিতাটির পথ নুড়ি-পাথরের জীবনকে সঙ্গী করে এগিয়ে গেছে নদীর দিকে।
সন্তোষ মুখোপাধ্যায়ের দু'টি কবিতার প্রথমটিতে নিমগ্ন পাঠক নিশ্চিতভাবেই টের পান – বেশি রাস্তা একা একা শেষ হয় না। তাতে ক্লান্ত এক ঢেউয়ের আঘাত লাগে। দ্বিতীয় কবিতায় কবি রাত-বিরতের মাঠে ছড়িয়ে দেন নিছক একটা অনুনয়, তারপর একটা শব্দ বাজিয়েই ফিরে আসেন নিজের মনোভূমিতে। চমৎকার সৃজন।
"কবে যেন বুকের ভেতর
একটা মস্ত বড় দেওয়াল উঠে গেল —
কেউ জানলো না কেন?
কেউ জিজ্ঞাসা করল না কেন দেওয়াল?"
— ঠিক এমনি ভাবেই প্রাজ্ঞ কবি হজরত আলী শুরু করেছেন তার 'দরবেশ' কবিতাটি যা পাঠককে অনিবার্যভাবেই ছুঁয়ে যায়।
পরিতোষ সরকার তাঁর 'পরিবার' কবিতায় দেখেছেন — সরলরেখাগুলো কখন যেন বৃত্ত হয়ে যায়, ঠিক পরিবারের মতো! অথচ কোনও ডাকঘর না থাকলেও, অমল ও দইওয়ালা না থাকলেও রোদবাতাস জুড়ে থেকে যান আমাদের রবি ঠাকুর …
সেরিনা খানের দু'টি কবিতা জুড়ে কখনও আদিগন্ত বিশ্বাসের মাপকাঠি, আবার কখনও যাপিত জীবনের নিবিড় অনুসন্ধান যা একান্ত গোপনে প্রাত্যাহিক তুচ্ছতাকে দূরে রেখে সুগভীর স্বপ্নময়তার গভীরতায় হারিয়ে যেতে চায়। তপন কুমার পালের তিনটি অণুকবিতা স্বমহিমায় ভাস্বর। দেবাশিস ঘোষের 'ভুল স্বর্গ' কবিতায় আত্মমগ্ন একটা পিচরাস্তা চলে যায় ভুল এক স্বর্গের দিকে যেখানে কুচোনো স্বপ্নের ছাট, ক্ষয়ে যাওয়া নৌকার মাঝি আবার নতুন করে জন্ম জন্ম খেলা অভ্যেস করে।
অভিজিৎ রায়ের দু'টি কবিতার প্রথম কবিতায় কবির অনুভব –
"অথচ বোঝেনা কেউ দায় নিতে চেয়ে
আগুনের কত সুখ ভাসে নদী জলে"
যা অনিবার্যভাবেই পাঠকমনকে স্পর্শ করে।
'শিরোনামহীন' দ্বিতীয় কবিতায় কবির অনুভব আরও বেশি সম্পৃক্ত হয় –
"মূল্যহীন বেঁচে থাকা আয়ু মাপে যত
তত এই হৃদয়ের রক্তপাত জুড়ে
ক্রমশঃ গভীর হয় বিষাদের ক্ষত
বেদনার অন্ধকার জেগে উঠে সুরে …"
"হরিণের ভাঙা শিং পড়ে আছে পাইনের বনে" – ঠিক এমনই সহজ সরল ভাবে শুরু হয় কবি রাজদীপ ভট্টাচার্য-র ভ্রমণকাহিনী কবিতাটি, তারপর ব্যাকপ্যাক নিয়ে এগিয়ে যায় জাহাজঘাটার দিকে। তাঁর দ্বিতীয় কবিতা (বিশ্বাস)-এর প্রথম লাইনেই পাঠকদের জন্য বড় চমক —
"সাততলায় ঈশ্বর বলে কেউ নেই
— এ কথা আমি জানি।"
"বিরহের সাথে আমাদের বিবাহ হয়ে গেছে গতমাসে
এখন তুমুল সংসার…"
— এমনই এক ভিন্নধর্মী উচ্চারণে আশিস দেবনাথ সাজিয়েছেন তাঁর প্রথম কবিতা প্রিয় কাঠগোলাপ। তাঁর দ্বিতীয় কবিতা আরও একবার স্বাভিমানের মৃদুতম শব্দে বিভোর।
কবি রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার প্রতিটি লাইন যেন কথা বলে। বর্তমান সংখ্যায় প্রকাশিত তাঁর প্রথম কবিতা 'ন্যাপথলিনের গন্ধ' কী নির্ভার, অথচ কী ভীষণভাবে স্মৃতিভারাতুর! কবি যখন আলতো উচ্চারণে তন্ময় হন —
"আলমারি খুললেই তোমার ফেলে যাওয়া
পোশাকের খাঁজে ভাঁজে শীতঘুমে থাকা
বর্তুলাকার শাদা ন্যাপথলিন বলগুলি
জেগে যায় .."
তখন সনিষ্ঠ পাঠকও তাঁর সঙ্গে একাত্মবোধ করেন। আবার কবিতার শেষে যখন পাঠক দেখতে পান — চলন্ত জানলা দিয়ে হু হু করে হাওয়া ঢুকে এসে এলোমেলো করে দেয় সবকিছু আর নিভে যায় হলুদ লণ্ঠন — তখন নিঃসীম একটা ব্যথা পাঠকের গলার কাছে কেন্দ্রীভূত হয়, পাঠককে গ্রাস করে, অথচ পাঠকের কিছু বলবার থাকে না! কবির দ্বিতীয় কবিতা 'আঁধারে আলোয়' পাঠক যতোবার পড়েন, ততোবারই যেন কবিতাটি নতুন নতুন অর্থ নিয়ে পাঠকের সামনে এসে উপস্থিত হয়। কবিতার প্রতিটি পঙক্তিতে পাঠক বুঝি অনুভব করতে পারেন কবির অপরিসীম অনুভববেদ্যতার স্বরূপ।
কবি প্রাণেশ সরকারের কবিতা মানেই পাঠকের কাছে এক অপার প্রাপ্তি। এবারেও তার বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম হয়নি। তাঁর দু'টি কবিতা আমি দেখেছি এবং তুমি কি জেগে আছো নিশ্চিতভাবেই পাঠকের সে প্রত্যাশা পূরণ করবে এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তাঁর কবিতাজুড়ে যে ধ্বনিমঞ্জরী, ডুলুং নদীর কলতান, চিনাই নদীর পাড়ের ঠেসমূল ও শ্বাসমূল, ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের ধুন তা যেন নিবিড়ভাবে ধ্বনিত হতে থাকে পাঠকের মনোভূমিতে। সেইসঙ্গে দয়িতার কাঁকনধ্বনি নূপুরের লাবণ্যে মিশে নিঃশব্দে জ্যোৎস্নারাশির গূঢ় অভীপ্সাকে জাগরুক করে গহীন করে তোলে সোনালী বিষাদকে।
কবি সাধন পাত্রের কবিতায় বরাবরই একটি সহজিয়া সুর থাকে। আর এবারে সেই সুরে যুক্ত হয়েছে বাউল, কীর্তন, মুর্শিদি, ভাটিয়ালি আর উতল হাওয়ার বাঁশির সুর। সব মিলিয়ে মহামিলনের এক গান ধ্বনিত হয়েছে তাঁর 'পিচ রাস্তার দু'ধারে সবুজ' কবিতায়।
কাজল মিত্রের 'স্বপ্ন কুড়ায়' কবিতাটি নিশ্চিতভাবেই স্পর্শ করবে পাঠক হৃদয় যার অনুরণন থেকে যাবে অনেকদিন — কবির ১৪ পঙক্তির এ নির্মাণ সত্যিই সার্থক। শিক্ষাঙ্গন কবিতায় কবি দিলীপ দত্ত সমাজের কাছে তুলে ধরেছেন একটি সুতীব্র প্রশ্ন — আমরা তবে দাঁড়াবো কোথায়? কৌশিক দে রচিত একজন্ম-বহুজন্ম কবিতাটির পংক্তি সংখ্যা মাত্র বারো, কিন্তু ভাবনায় সুদূরপ্রসারী। শশাংক দাস বৈরাগ্যের দু'টি কবিতায় যেমন আছে নাগরিক ভিড়, মুখোশের চতুর চাহনি, অস্থির শ্রেণীবোধ, চেনা মুখোশের অচেনা হাসি; তেমনই আছে নদীর পলিমাটি যেখানে নির্দ্বিধায় আঁকা যায় পৃথিবীর প্রথম ভালবাসা।
এছাড়া ফজলুর রহমান মণ্ডলের নিভৃতে কাঁদে মন, লুৎফর রহমানের গাজার ক্ষুধার্ত মেয়ে, বর্ণময় বাড়ৈ-এর সেই কবি, সালিমা বেবীর অপসারময় প্রভৃতি কবিতাগুলি পাঠককে দেবে নূতনত্বের আস্বাদন। মিনতি বর্মনের অপূর্ণতা কবিতাটি পূর্ণতারই নামান্তর। কৃষ্ণা ঘোষের আমারে তুমি অশেষ করেছ কবিতাটি নিবিড় অনুভূতির কবিতা।
প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ থেকে কবি কলি বড়াল উপহার দিয়েছেন তিনটি কবিতা। বাংলাদেশের আর এক কবি আজাদুর রহমানের শিরোনামহীন কবিতাটিও পাঠকের কাছে এক নতুন প্রাপ্তি।
পত্রিকায় কবিতা ছাড়াও রয়েছে বলিষ্ঠ একটি গদ্য বিভাগ যেখানে কবিতা বিষয়ক গদ্য এবং রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক গদ্য হাত ধরাধরি করে অবস্থান করছে। পত্রিকার সব থেকে উল্লেখযোগ্য গদ্য রচনাটি হলো "জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের পত্রিকা ও সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর"। গবেষণাধর্মী মূল্যবান এই প্রবন্ধটি লিখেছেন পত্রিকার সহ-সম্পাদক নৈঋতী বিশ্বাস যেখানে ঠাকুর পরিবারের তত্ত্ববোধিনী, ভারতী, বালক এবং সাধনা — এই চারটি পত্রিকার কথা পৃথক পৃথক ভাবে আলোচিত হয়েছে। সুপাঠ্য তথ্যবহুল নাতিদীর্ঘ এই প্রবন্ধটি যে শুধু আগ্রহী পাঠকদেরকে ঋদ্ধ করবে তাই নয়, স্কুল ও কলেজ পড়ুয়াদেরও বিশেষ কাজে আসবে।
প্রবন্ধকার নজরুল ইসলাম বিশ্বাস রচিত "রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর অন্তরচেতনা এবং দর্শন" শীর্ষক প্রবন্ধটিও মূল্যবান। রিয়া বিশ্বাসের "রবীন্দ্রসাহিত্যে পণপ্রথা" আর একটি মূল্যবান রচনা। তন্দ্রা ঘোষের নিবন্ধ "রবীন্দ্রনাথ ও নারী" সুপাঠ্য, তবে তা নিবন্ধকারের আরও মনোযোগ দাবি করে।
সব মিলিয়ে আনন্দম্ কবিতার জন্য, কবিতার কথা ভেবে এবং কবিতার উদ্দেশে নিবেদিত একটি পত্রিকা যার অসামান্য প্রচ্ছদ চিত্র (প্রচ্ছদ চিত্র: ফারুক রিফাকুয়াত। সালার জং মিউজিয়াম, হায়দ্রাবাদ থেকে সংগৃহীত) পত্রিকাটিকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। সর্বোপরি ঝকঝকে নির্ভুল ছাপা, উৎকৃষ্ট কাগজ এবং সুসম্পাদনার গুণে আনন্দম্ হয়ে উঠেছে স্ববৈশিষ্ট্যে ভাস্বর।
___________________________
পত্রিকা: আনন্দম্ (মে-২০২৫ সংখ্যা)
(৪৪ তম বর্ষ, ১৩৪ তম সংখ্যা)
সম্পাদক: রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
প্রকাশ স্থান: চাপড়া, নদিয়া।
মূল্য: ৫০ টাকা
No comments:
Post a Comment