নারী অধিকার ও আজকের প্রবাসন
রণেশ রায়
কোনও দেশের অর্থনৈতিক সামাজিক অবস্থা, সে দেশের উন্নতি নির্ভর করে ব্যাপক মানুষের সুস্থ সবল জীবন যাপনের জন্য খাদ্য বস্ত্র শিক্ষা স্বাস্থ্য বাসস্থানের মত অপরিহার্য বিষয়গুলি পাওয়ার ওপর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এইগুলো পাওয়ার সুযোগ কতটা যথেষ্ট ও পরিব্যপ্ত হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে দেশে কতটা প্রকৃত উন্নতি ঘটছে। এই মাপকাঠিতে ভারত ও ভারতের অঙ্গ রাজ্যগুলো উন্নত নয় বরং পশ্চাদপদ সন্দেহ নেই। উন্নতি যতটুকু ঘটছে তা মুষ্টিমেয় ধনীকে আরও ধনী করছে আর গরিবদের তুলনামূলক অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে কারন আয় বৈষম্য বেড়ে চলেছে। তাই ওপরের কোন মাপকাঠিতে ভারত উন্নত, সে তরতর করে এগিয়ে চলেছে বলা চলে না। এশিয়া আফ্রিকার দুর্বলতম দেশগুলোর মধ্যে ভারত একটা সন্দেহ নেই সরকারী প্রচার যাই হোক না। সরকারী তরফে জাতীয় আয়ের মাপকাঠিতে উন্নয়নকে বিচার করার একটা প্রবণতা আছে। খাদ্য শিক্ষা স্বাস্থ্য আর তার সঙ্গে বন্টনের বিষয়গুলো তেমন গুরুত্ব পায় না। ফলে অনুন্নয়নের ভয়াভয়তার বিষয়টা প্রতিফলিত হয় না সরকারী প্রচারে। আয় বৃদ্ধির সঙ্গে দাম বৃদ্ধির বিষয়টা গভীরে বিবেচিত হয় না। ফলে দেশের প্রকৃতি আর্থসামাজিক অবস্থাটা ধরা পড়ে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা একটা বিষয়ের ওপর আলোকপাত করবো যা ভারতে অন্ধকারাচ্ছন্ন আর্থসামাজিক অবস্থার মধ্যে আলোর স্ফুলিঙ্গ বলে ভাবা যেতে পারে। ভারতে সামন্ত সংস্কৃতির মধ্যে মেয়েদের যাঁতাকলে আটকে রাখা হয়। সনাতনী ধ্যান ধারণা ও জীবন যাপনের মধ্যে তাদের আবদ্ধ থাকতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু অর্থনৈতিক দুর্গতির কারণে পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্য থেকে ব্যাপক হারে গরিব ঘরের মেয়েদের বেঁচে থাকার তাগিদে নিজের জন্মস্থান ছেড়ে অন্য প্রদেশে পাড়ি দিতে হচ্ছে। তাদের প্রবাসন বা যাকে ইংরেজিতে মাইগ্রেশন বলে তা ঘটছে। এই প্রবাসনের কিছু খারাপ দিক থাকলেও নারী স্বাধীনতা নারী সত্তার দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে এর ধনাত্বক দিকটা নিয়ে আমরা আলোচনা করবো। এই প্রতিবেদনটি নারীর স্বাধীনতার প্রশ্নকে কেন্দ্র করে রাখার চেষ্টা করবো যা ভারতের আর্থ সামাজিক একটা দিক উন্মোচিত করার প্রয়াস পাবে।উল্লেখযোগ্য যে আমার সীমিত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে এই লেখা। প্রধানত পশ্চিম বঙ্গ থেকে বেঙ্গালোরের মত শহরে যে এই ধরণের প্রবাসন ঘটে চলেছে তা নিয়ে আমার এই প্রতিবেদন। আমাদের মত একটু অবস্থাপন্ন উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে ব্যাপকহারে যে প্রবাসন ঘটছে সেটাই আমাদের চোখে পড়ে, আলোচনার বিষয় হয়। কিন্তু গরিব ঘরের মেয়েদের মধ্যে এটা যে ব্যাপক হারে ঘটে চলেছে নীরবে তার যে একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে নারী সমাজে তা আমাদের চোখে পড়ে না। আমাদের আলোচনার সঙ্গে অর্থনৈতিক অবস্থা বিশেষ সম্পর্ক যুক্ত। কার্যত জীবন জীবিকার তাগিদে খাদ্যের সন্ধানে এই প্রবাসন মানব জাতির আদি কাল থেকে ঘটে চলেছে। আমাদের আলোচিত এই প্রবাসন প্রক্রিয়া নতুন কিছু নয়। আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ন নারী অধিকারের বিষয়টা এর সঙ্গে কিভাবে যুক্ত সেটা বোঝা।
একটা কথা আগেই বলে রেখে আমি আমার মূল আলোচনায় ঢুকব। ব্যক্তিগতভাবে আশি বছরের বৃদ্ধকেও আজ এই প্রবাসন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিযে যেতে হচ্ছে। আমার দুই ছেলেমেয়েই আজ চাকুরীর সূত্রে বা সাংসারিক সূত্রে বেঙ্গালোর প্রবাসী। আমি ও আমার স্ত্রী অসুস্থ অবস্থায় খাদ্যের তাড়নায় নয় নিজেদের দেখাশোনার তাগিদে ছেলে মেয়েকে অনুসরণ করে বেঙ্গালোরে প্রবাসী হোতে চলেছি। সেখানে ছেলেমেয়ের কল্যাণে বড় বড় ফ্ল্যাটবাড়ী আমাদের বাসস্থান। খাওয়াপড়ার অভাব নেই। চিকিৎসার ব্যাপারে ছেলেমেয়েদের সাহায্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। আর নাতি নাতনীদের টান এ ব্যাপারে একটা ভূমিকা পালন করছে। গত প্রায় কুড়ি বছর ধরে নিয়মিত আমার বেঙ্গালোর যাতায়াত যা এখন স্থায়ী আবাসন হোতে চলেছে।
পশ্চিমবঙ্গ একসময়ে ভারতের সংগঠিত শিল্পে অগ্রগণ্য রাজ্য ছিল। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প বস্ত্র শিল্প চা পাট শিল্পের পতনের পর আধুনিক প্রযুক্ত ভিত্তিক শিল্পের তেমন বিকাশ ঘটে নি। গ্রামীণ কৃষি সেই মধ্যযুগিও স্থবিরতায় আবদ্ধ। তাই এখানে শিল্পে নিয়োগ সুযোগ তলানিতে। এই অবনমন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে পঞ্চাশ বছর বা তারও আগে থেকে যা আজ মমতার রাজত্বতে ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। এখানে শিল্পে চাকুরী না থাকায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে মেয়েরা এখান থেকে চাকরির দৌলতে প্রবাসিত হয়ে চলেছে বিরাট মাত্রায়। আজ পড়াশুনা জানা মধ্যবিত্ত এমন পরিবার পশ্চিমবঙ্গে কম পাওয়া যাবে যেখান থেকে কেউ না কেউ ভিন রাজ্যে চাকুরীর দৌলতে পা বাড়ায় নি। তাদের সঙ্গে আমরা বাবা মায়েরা যেমন যুক্ত হয়েছি তেমনি মফস্বল অঞ্চলের শহর গ্রাম থেকে মেয়েরা প্রবাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। বিশেষ করে গ্রামের গরিব ঘরের মেয়েরা বলতে গেলে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত প্রবাসী ছেলেমেয়েদের হাত ধরে মানব সম্পদের স্থানান্তর ঘটিয়ে চলেছে। এই প্রক্রিয়ায় গরিব ঘরের মেয়েরা ব্যাপকহারে বহিরমুখী হয়ে চলেছে যার বিভিন্ন দিক আমাদের আলোচনার বিষয়। গ্রাম থেকে একই প্রদেশে শহরে শিল্পের সুযোগ থাকাকালীন এই প্রবাসন প্রধানন পুরুষ শ্রমজীবিদের মধ্যে ঘটত। মেয়েরা গৃহস্থের কাজে গ্রাম থেকে শহরে আসতো। আজ গ্রামের গরিব ঘরের মেয়েরা ব্যাপক হারে প্রধানত গৃহস্থালীর কাজে প্রবাসিত হয়ে চলেছে।
আমরা বলেছি যে এখানে মানে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত ছেলে মেয়েদের হাত ধরে এখানকার গরিবঘরের মেয়েরা ভিনরাজ্যে স্থানান্তরিত হচ্ছে। সেটা কী ভাবে? আজ এখানকার ছেলেমেয়ারা ভিন রাজ্যে গিয়ে বসতি গড়ছে প্রধানত ফ্ল্যাটে। তাদের ঘরের কাজ করার লোক দরকার। তাদের ওখানে যত ভিড় বাড়ছে ততো গৃহস্থালীর কাজের জন্য লোকের চাহিদা বাড়চ্ছে। আর যেহেতু এরা বাঙালি তাই কাজকর্মের জন্য বাঙালি হলে ভালো হয়। এই ধরণের মহিলা চাকুরজীবীদের চাহিদা বৃদ্ধির গন্ধ এজেন্ট বা দালালদের কাছে পৌঁছতে দেরী হচ্ছে না। গড়ে উঠছে ব্যবসায়ী দালাল সংগঠন যারা এদের যোগানদার । গড়ে উঠছে এই সংগঠনের সঙ্গে এখানকার গ্রামগঞ্জের মেয়ে চাকুরীকামীদের এক নেট ওয়ার্ক। আর প্রবাসে থাকা মধ্যবিত্ত ছেলেমেয়েরা বিয়ে করছে সংসার করছে, যাদের স্বামী স্ত্রী দুজনেই চাকুরীজীবি। তাই গৃহস্থালীর কাজে দেশ থেকে আসা কাজের মেয়েদের চাহিদা বাড়ছে। আর এদের শিশু সন্তানদের দেখভালের জন্য এই মেয়ে চাকুরীজীবীদের দরকার। ফলে এদের এক বিরাট বাজার গড়ে উঠছে। বাজারের নিয়ম বলবত হচ্ছে যে নিয়মে গ্রাম বাংলার মেয়েরা রোজগারের তাগিদে পা বাড়াচ্ছে ভিন রাজ্যে যেখানে আমাদের ঘরের ছেলেমেয়েদের ভিড় বাড়চ্ছে।
আমি আগেই বলেছি বেঙ্গালোরের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই আমার এই প্রতিবেন। এই প্রসঙ্গে আমি আমার অভিজ্ঞতাটা বলে নিই তারপর আসব এই যে প্রবাসন প্রক্রিয়া তা কিভাবে বাংলার গরিবঘরের মেয়েদের নিজস্ব সত্তার মর্যাদা সৃষ্টির শর্ত তৈরী করছে তাদের অধিকার বোধকে জাগ্রত করে তুলতে সাহায্য করছে তাদের জীবিকা অর্জনের সাথে। মেয়েদেরকে গ্রাম বাংলার সামন্ততান্ত্রিক সংস্কার আচার আচরণ থেকে বার করে আনছে।
আগেই জানিয়েছি প্রায় পঞ্চাশ বছর হলো আমি ছেলেমেয়ের কাছে বলতে গেলে বেঙ্গালোরের অধিবাসী। আমার কলকাতার পাট প্রায় চুকে গেছে। বেঙ্গালোরে আমার কাজ কর্ম তেমন নেই। শারীরিক কারণে গৃহ বন্দী। লেখালেখির কাজ নিয়ে থাকি। এই সুবাদে গৃহস্থালীর কাজ করা মেয়েদের সঙ্গে পরিচয়। তাদের অপরিসীম যত্নে আমার বাস। তাদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিই। তাদের বাড়ির খবর নিই তারা কেন কিভাবে এখানে এলো জানি। এখানে এই মেয়েরা প্রচুর সংখ্যায় এসেছে পশ্চিম বঙ্গ উত্তর বঙ্গ আসাম ও উত্তরপূর্ব ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। তাদের সঙ্গেই আমার বেশী পরিচয়। শিখা কেয়া চম্পা যশোধা নীলিমা প্রভৃতি নামে আমার মেয়ে নাতনি বয়সী সব মেয়ে ১৪-১৫ বছরের ওপরের বয়সী। এরা সবাই খুব গরিব ঘরের মেয়ে যাদের অমরা সমাজের প্রান্তিক গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ বলে জানি। এই গরিব মেয়েদের অবস্থানগত পার্থক্য লক্ষণীয়। বিভিন্ন কারণে এদের এই প্রবাসন।সবার ক্ষেত্রে দারিদ্রটা সাধারণ কারণ। এছাড়া বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ কারণ। কেউ কেউ স্বামী পরিত্যাক্তা, কেউ কেউ স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পরিচিত কেউ বা এজেন্টের হাত ধরে ঘর ছাড়ে নতুন জীবনের আশায় আর কেউ কেউ বাবা মায়ের হাতে দু পয়সা তুলে দেওয়ার তাগিদে ঘড়ছারা, প্রবাসিত। আবার অনেকে আছে স্বামীর হাত ধরে এসেছে। স্বামী হয়তো এখানে সিকিউরিটি গাড়ি চালানো বা অন্য কোন কাজ করে। এখানে স্ত্রী তাকে রোজগার থেকে সবকিছুতে সাহায্য করে।গ্রামে গঞ্জের এই মেয়েরা তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন। সুযোগ না পাওয়ায় আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা তেমন নয়। তবে এদের জানার আগ্রহ প্রবল।খুব সহজে অবলীলায় অচেনা এই পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেয় খুব তাড়াতাড়ি । হিন্দি ভাষাটা রপ্ত করে নেয়। ইংরেজীটা অল্পবিস্তর বুঝতে শেখে। কলকাতাতেও এদের দেখেছি এইভাবে। কিন্তু নিজের রাজ্যে ওরা নিজের মাতৃভাষায় পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেয় বলে নিজের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কটা থেকে যায় বলে ওদের নিয়ে আমরা তেমন ভাবি না। ভিন প্রদেশে এই মেয়েদের জীবন কিভাবে নতুন মোড় নেয় কিভাবে তাদের নিজস্ব সত্তা জেগে ওঠে নিজেরাই নিজেদের জীবনের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে সেটা আমাকে ভাবায়। ব্যাপক গরীব মানুষের মধ্যে নারী জাগরণের এক শর্ত তৈরী হয় বলে আমার মনে হয়।
আমি গ্রাম বাংলার যে মেয়েদের ব্যাপক হারে অন্য রাজ্যে বিশেষ করে ব্যঙ্গালুরে প্রবাসন নিয়ে অলোচনায় ব্রতী হয়েছি তারা গ্রামের প্রান্তিক পরিবারের মেয়ে। তারা স্কুল স্তরে কিছুটা পড়াশুনা করে বা সে সুযোগ না পেয়ে বাধ্য হয় ভরণ পোষণের তাগিদে উচ্চবিত্ত পরিবারের রান্না ঘর পরিষ্কার বা শিশু কন্যা-পুত্রদের দেখাশোনার কাজে যোগ দেয়। কলকারখানায় এদের কাজের সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। সেক্ষেত্রে তারা কাজের সন্ধানে শহরে পাড়ি দেয়। শুধু যে দেশের মধ্যে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে এই প্রবাসন ঘটে চলেছে তা নয় এদেশ থেকে বিদেশে এই প্রবাসন ঘটে চলেছে। আর এই গরিব ঘরের মেয়েদের ব্যাপক হারে প্রবাসন ঘটে গৃহস্থালীর কাজকে কেন্দ্র করে। গত কুড়ি পঁচিশ বছর ধরে শহরের শিক্ষিত যুবক যুবতীরা এখানে চাকরি না থাকায় প্রবাসিত হয়ে চলেছে বেঙ্গালুরুর মত রাজ্যে। সেখানে প্রবাসিত পরিবারে এই মেয়েদের জীবিকার সুযোগ বাড়ছে। সেখানকার জীবনযাপন উন্নত ও খরচ সাপেক্ষ বলে এই মেয়েদের গৃহস্থালীর কাজে মজুরি এখান থেকে অনেকটা বেশী। তাই এই মেয়েরা নিজেদের বাসস্থান পরিবার ছেড়ে ভিন প্রদেশে চলে যাচ্ছে। আর এই ধরণের মেয়েদের এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য দালাল তথা এজেন্সী নামে একধরণের সংস্থান গড়ে উঠেছে যারা মেয়েদের মজুরীর একটা অংশ পায় তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয় বলে। তাই দেখি পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্যে সব স্তরে কর্ম সংস্থানের সুযোগ কমছে বলে মেয়েদের এই প্রবাসনের হার বেড়ে চলেছে।
এই মেয়েরা এক ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কেবল নিজের মনের জোর আর ক্ষুধার তাড়নাকে পুঁজি করে শূন্য হাতে ঘর পরিবার প্রিয়জনদের ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে এক অপরিচিত অজানা আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে। পরিযায়ী শ্রমিকদের মত। তাদের জানা থাকে না কোথায় থাকবে কোন পরিবেশে তাদের কাজের সংস্থান হবে। যেখানে যায় সেখানকার আঞ্চলিক ভাষা তাদের জানা নেই। সেখানকার আঞ্চলিক প্রশাসন এদের খুব কম ক্ষেত্রেই সহায়ক হয়।এক অজানা অচেনা জীবন ধারণের মধ্যে তারা নিক্ষিপ্ত হয়। তাদের চাকুরীর নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। আজ কাজ আছে কাল নেই। যে পরিবারে এরা কর্মরত সেই পরিবারের এদের প্রয়োজনটাই এদের সম্বল। সেখানে কাজের চাহিদাকে টেক্কা দিযে যোগান বাড়লে বিপদ। তখন নিয়োগকর্তারা এদের আর তেমন তোয়াক্কা করে না কারণ জানে একজনকে বিদায় করলে আরেকজন দরজায় দাঁড়িয়ে। এই অবস্থায় এই মেয়েরা অনেক সময় হয়ে দাঁড়ায় নিয়োগকর্তার অনুগ্রহের পাত্রী। জীবন যুদ্ধে এরা অবতীর্ণ হয় এক অসম লড়াইয়ে। এরই মধ্যে এই মেয়েরা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে যতটা পারে লড়াই চালায়। জন্মসূত্রে পাওয়া জীবনের শিকড় হারিয়ে নতুন জীবনের শিকড় খুঁজে পেতে চায় এরা এক কঠিন লড়াইয়ের মধ্যে যেখানে লড়ায়ের প্রাঙ্গনটা অনাবৃষ্টির কবলে খরাগ্রস্থ এক মরুভূমি। তাদের সুস্থিরতা কেড়ে নেয়।
নানা ধরণের নিয়োগকর্তার সঙ্গে এদের মানিয়ে চলতে হয়। এরই মধ্যে কোনও কোনও নিয়োগ কর্তার মানবিকতা দেখা যায়। এদের জন্য যখন কোন আইন নেই বা থাকলেও প্রশাসনের উদাসীনতা বা এদের প্রতি অমানবিক দৃষ্টি ভঙ্গির জন্য নিয়োগকর্তার মানবিক ব্যবহার আর এদের কাজের অপরিহার্যতা এদের রক্ষাকবচ। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তারা এদের প্রতি হয় উদাসীন বা বৈরি হয়। উদাসীনতাও এদের প্রতি বিরূপতার একটা ধরণ। এই ধরণের নিয়োগকর্তাদের কাছে এরা যেন শুধু দাসত্ব করতে জন্মেছে। টাকা পাবে তাই এই মেয়েরা কেনা গোলাম। এদের খাওয়া পড়া সময়ে বিশ্রাম ঘুম নিয়ে নিয়োগকর্তাদের মাথা ব্যথা নেই। ওদের সেবাটা আদায় করতে পারলেই হলো। রান্না ঘর পরিষ্কার কাপড় কাঁচা বা শিশু সন্তানকে যত্নে রাখার মতো সংসারের অপরিহার্য কাজগুলো যেন টাকা দিযে কেনা যায়। এগুলো না হোকে নিয়োগকর্তাদের জীবন যে দুর্বিসহ তা এই নিয়োগ কর্তারা ভুলে যায়। কারণে অকারণে হায়ার আর ফায়ারের নীতি অনুসরণ করা হয়। এক অমানবিক পরিবেশে এদের এসব সহ্য করে নিতে হয়। সেটাই হয়ে দাঁড়ায় নিয়ম। আর যখন তখন কাজ নট হয়ে যায়। কাজের নিশ্চয়তা নেই কর্মরতদের সম্মান নেই কাজের সময়ের ঠিক নেই। এই পরিবেশ ছাড়াও নানা ধরণের অনিশ্চয়তা নিরাপত্তাহীনতায় এদের জীবন কাটাতে হয়। যেমন নারী পাচারকারীর পাল্লায় পরার ভয় থাকে। নারী নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়। এদের কোন আইনত বৈধ সংগঠন বা ইউনিয়ন থাকে না যা এদের ন্যূনতম সহায়তা দিতে পারে। আর কার্যকরী কোন আইনতো নেই বললেও চলে। বেশিরভাগ নিয়োগকর্তা আর রাজ্য প্রশাসনের কাছে এরা মানুষ নয়। এতো প্রতিকূলতার মধ্যে এরা এদের সম্মান বাঁচিয়ে অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে কাজ করার শিল্পটা আয়ত্ব করে নেয়। সেটা এদের জীবিকার লড়াইয়ের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
আমরা দেখলাম এই ধরণের প্রবাসিত মেয়েরা নিজেদের জম্মগত শিকড় থেকে সমূলে উচ্ছেদ হয়ে নতুন মাটিতে আবার নতুন করে শিকড়িত হোতে চায়। জীবনে নতুন আলোর সন্ধানে এদের লড়াই। এরা নিজের জম্মগত শিকড় থেকে নির্মূল হয় বিভিন্ন কারণে। রুটি রুজির লড়াইটা প্রধান হলেও স্বামী হারান স্বামী কর্তৃক পরিত্যক্তা হওয়া রোজগার ও একটু ভালো থাকার কারণে স্বামীর সঙ্গে বেরিয়ে পড়ার কারণেও এই প্রবাসন ঘটে চলে। চোদ্দ পনেরো বয়সের মেয়েদের থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সের প্রৌঢ়াদের মধ্যে এর হার বেশি।এ যেমন এক দুঃসময় তেমনি অজানা অচেনা নতুন জীবনের হাতছানি।এই মেয়েরা অদ্ভুত নৈপুণ্যতায় নতুন এর সঙ্গে মানিয়ে নেয়। এক অজ পড়াগায়ের ঢাকনাতে আবদ্ধ থাকা জনগোষ্ঠী গুন্ঠন মুক্ত আত্মপরিচয়ে পরিচিত আত্মসম্মান বোধে পুষ্ট নারী গোষ্ঠী হয়ে ওঠে। ভিন্ন প্রদেশের ভাষা রপ্ত করে তাদের খাওয়া পড়ায় অভস্ত হয়ে একটা স্বতন্ত্র নারী গোষ্ঠী হয়ে ওঠে। ভিন্ন গোষ্ঠীতে বিয়ে করে অনেকে। নিজের মাতৃভূমির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটা স্বাধীন জনগোষ্ঠী হয়ে ওঠে। এদের জীবন যাপনে এক নাগরিকরণ ঘটে। যাদের শিশু সন্তান থাকে তাদের ইংরেজি মাধ্যমে বা প্রদেশীয় ভাষায় শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা চালায়। এর মধ্যে কেউ কেউ আবার স্বপ্রদেশে ফিরে আসে।
আমার ওপরের পর্যালোচনা সম্ভব হয়েছে বেঙ্গালোরে এই মেয়েদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ আলাপ চারিতায়। পশ্চিমবঙ্গ উত্তরবঙ্গ ছাড়া আসাম থেকে বাঙালি মেয়েদের আগমন ঘটে। সুন্দরবন মেদিনীপুর ২৪ পরগনা নদীয়া এক কথায় সব জেলার গ্রাম বাংলার মেয়ে এরা। আমার ছেলেমেয়ের সংসারে এরা গৃহস্থালীর কাজ করে বা নাতি নাতনীদের দেখে। তাছাড়া আছে এখানে গড়ে ওঠা সোসাইটি নামে আবাসনে বিভিন্ন ফ্ল্যাটের পরিবারের কর্মরত মেয়েরা। এই মেয়েরা অনেকে এখানে স্থায়ী বাসা বেঁধেছে বিরাট বিরাট আবাসনের বাইরে অদূরে নিম্নবিত্তদের ভাড়া বাড়িতে। এ যেন আলোক সজ্জায় সজ্জিত ঝকমকে আলোর নীচে নিভু নিভু আলো। এদের জীবন যাপনের আমূল পরিবর্তন। অজানা পারাগায়ের পরিবেশ থেকে এসে এখানকার সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতির আবহে এরা নিজেদের গড়ে তোলে। নিজেরা হয়ে ওঠে আত্মনির্ভর স্বাধীনচেতা মহিলা গোষ্ঠী। হাজার অনিশ্চয়তা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে যেন আলোর স্ফুলিঙ্গ। পুরুষ প্রধান সমাজের পৌরুষ মুক্ত অনেকাংশে। ঘরে বাইরে নারী অবদমনের বিরুদ্ধে এক জাগ্রত শক্তি।এটা যে কেবল পশ্চিমবঙ্গের বিষয় তা নয়। এ প্রবাসন প্রক্রিয়া মানব সমাজে নতুন নয়। আদিম কালে খাদ্যের সন্ধানে মানুষের এই গমন নির্গমন প্রক্রিয়া যুক্ত ছিল। কৃষিতে স্থায়ী বসতি গড়ার আগে মানুষ ছিল যাযাবর জাতি। এক অঞ্চলের খাদ্য যোগানে ঘাটতি দেখা দিলে তারা অন্য অঞ্চলে পাড়ি দিত। পরিবার দেশ কাল জাতির বাঁধন তাদের বাঁধতে পারতো না। পরে কৃষিকাজের উদ্ভাবনের সঙ্গে মানুষ গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে এক এক অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। গড়ে ওঠে পরিবার জাতি ধর্ম ভিত্তিক মানব গোষ্ঠী। পরে নগর সভ্যতার বিকাশ ঘটে। কালকারখানা অফিস কাছারি গড়ে ওঠায় নগর সভ্যতা গড়ে ওঠে। ইতিমধ্যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আবির্ভাব ঘটে। মেয়েদের ঘরের কাজে আবদ্ধ থাকতে হয়। তারা হয়ে ওঠে পুরুষ নির্ভর। পাশাপাশি নারী স্বাধীনতার দাবি ওঠে। মেয়েরা ঘরের বাইরে শ্রমজীবী মানুষ হিসেবে অফিস কচারী এমন কি কিছু শিল্পে যোগ দেয়। পুঁজিবাদী দেশে এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। কিন্তু ভারতের মত পেছিয়ে পড়া দেশে এই প্রক্রিয়া তেমন গতি পায় না। ধর্ম ও সংস্কার বিশেষ করে গ্রামীণ মেয়েদের ঘরে আটকে রাখে। মেয়েদের মধ্যেশিক্ষা র প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে আজ সেই স্থবিরতা ভাঙতে শুরু করেছে। আমরা যে গরিব গ্রামীণ মেয়েদের প্রবাসনের ওপর আলোচনা করলাম বৃহত্তর অর্থে সেটা এই স্থানান্তর প্রক্রিয়ার অঙ্গ।আমি আমার এই লেখার পরিসমাপ্তি ঘটাচ্ছি, নারী জাগরণের দিকটা তুলে ধরার চেষ্টা করছি আমার লেখা একটা কবিতায়:
তাই আমি বিদ্রোহিনী আজ
সে এসেছিল একদিন রাখবে আমাকে পাহারায়
আমি যে নারী অবলা, নিজেরটা নিজে বুঝি না,
তাই আমাকে বাঁচতে হবে কারও দয়ায়।
নারী আমি, তাই বাঁচতে পারি না নিজ সত্তায়
আমাকে সোঁপে দিতে হয় কোথাও,
তার সত্তায় আমার সত্তা হারায়।
এমনি করে জীবন চলে আমার
বাঁধা পড়ে থাকি সংসারের মায়ায়---
স্বামী ছেলে মেয়ে ঘরকন্যা, জীবনের মন্ত্র সেটাই
সংসার নাকি সুখের আমার গুণের আরাধনায়----
প্রবাদ বাক্য, লেগে থাকে জিহবায়।
আমি জানতাম না, আমার হৃদয়ে এক দানবী ঘুমায়
সে জেগে ওঠে আজ এক পুরুষের তাড়নায়,
আমার ভেতরের দানবীর ঘুম ভাঙ্গলো পৌরুষের মহিমায়,
আমাকে সে জাগিয়ে তোলে আমার চেতনায়
আমি ফিরে পাই সত্তা আমার, বাঁচতে চাই সে সত্তায়,
তাই বিদ্রোহিনী আমি আজ এবার,
আমার গুনে যদি ভস্ম হয় পৌরুষত্ব তার।
No comments:
Post a Comment