দেবপ্রয়াগ ভ্রমণ ।। অনিতা মুখার্জী - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

Wednesday, August 20, 2025

দেবপ্রয়াগ ভ্রমণ ।। অনিতা মুখার্জী

ভ্রমণকাহিনি

দেবপ্রয়াগ


দেবপ্রয়াগ : পাহাড়ের হাতছানি

অনিতা মুখার্জী 


 'লয়ে রশারশি  করি কষাকষি'র দিন এখন শেষ । ট্রলি ব্যাগ ওঠাও আর বের হয়ে পড়ো । হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়ার ডাক এলো। এ  এক অজানা অচেনার মায়াবী হাতছানি। একে উপেক্ষা করা মুশকিল, বেরিয়ে পড়া গেল। গন্তব্য দেবপ্রয়াগ।  এসে সত্যিই মুগ্ধ। পাহাড় দেখার এক অদ্ভুত নেশা আছে। যারা পাহাড় ভালবাসে পাহাড় তাদের হাতছানি দেবেই দেবে । রাস্তায় আসার পথে দেখছিলাম জলের আয়নায় পাহাড়ের অলস লাবণ্য । দুপাশে পাহাড় কে সাক্ষী রেখে ছুটে চলেছে দুরন্ত পাহাড়ি নদী। অরণ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে বন্যপ্রাণীর দল । গাছে গাছে পাখি ,ফুলে ফুলে হোলি । রাস্তার ধারে কত বর্ণের ফুল যে ফুটে আছে বলার নয় । নাম না জানা গাছে ছেয়ে আছে এই বনানী । যেন কোন রূপসী সবুজ শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে তার আঁচল বিছিয়ে ,আর তার শাড়িতে নানা রকমের নকশা আঁকছে কোন এক অজানা জাদুগর । প্রকৃতির কি অদ্ভুত খেয়াল যেখানে কেউ নেই সেখানে কি চমৎকার দৃশ্য সে সাজিয়ে রেখেছে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না । বড় বড় গাছের ডালের আড়াল থেকে সূর্য মামার উঁকিঝুঁকি চোখে পড়ছে, হালকা আলোয় পল্লবীত কচি পাতাগুলো অনাবিল আনন্দে দুলছে । দেখে মুগ্ধ হতেই হয়। ধীরে ধীরে দিনমনি তার নিজের কাজ সেরে অস্তাচলের পথ ধরলেন। একটু পরেই অন্ধকার ঘন হয়ে এল। যাত্রার ক্লান্তি মুছে গেল যখন দেখলাম সামনের পাহাড়ে কেউ যেন দীপের মালা সাজিয়ে দিয়েছে। দেখে সত্যিই আশ মেটে না । রাত আটটা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম আমাদের গন্তব্যে । ফ্রেশ হয়ে ডিনার করে প্রাতঃভ্র মনে বেরোবার ইচ্ছে নিয়ে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।


ভোর বেলায় কোন মন্দিরের মৃদু ঘন্টার ধ্বনিতে ঘুম ভাঙলো । উঠে বাইরে এলাম । মনে হলো নিচে কোন মন্দির আছে । পরে দেখা যাবে ভেবে আমরা তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম প্রভাতভ্রমণে । একটু ওপর দিকে উঠে একটা ছোট চায়ের দোকান। চায়ের গন্ধে নেশা হয় না এমন বাঙালি বোধহয় কমই আছেন । আমরা দু গ্লাস চায়ের অর্ডার দিয়ে বাইরের বেঞ্চে বসলাম । চায়ের দোকানে আস্তে আস্তে ভিড় বাড়ছে ।চা খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম । আস্তে আস্তে হাঁটছি কারণ রাস্তা উপরে উঠছে । গোলাপি আর সাদা গোলাপ গাছে ছেয়ে আছে রাস্তা । কি তার রং কি তার রূপ । চলতে চলতে হঠাৎ দেখি আমাদের পেছনে একটা নধর কান্তি কালো কুকুর । পাহাড়ি কুকুররা খুব হৃষ্টপুষ্ট হয়, লম্বা ও আমাদের সমতলের কুকুরের থেকে । আমরা ভয়ে ভয়ে সরে গিয়ে ওকে এগিয়ে যাবার রাস্তা করে দিলাম । কিন্তু আশ্চর্য কুকুরটা কিন্তু এগিয়ে যাবার কোনো লক্ষণই দেখালো না।আমাদের পেছনেই আসতে লাগলো। ধীরে ধীরে অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে আসা গেল ।পাহাড়ি রাস্তায় চলতে বেশ কষ্ট হয়। শান্ত নির্জন পথ ,পাহাড়ি ঢাল সবুজ লতা গুল্মে ঢাকা। চারিদিকে নরম রোদ। মাঝে মাঝে দু চারজন পাহাড়ি মেয়ে চোখে পড়ছে । তারা জ্বালানি সংগ্রহে চলেছে নির্জন বনে। দূরে পাহাড়ি কিশোরী ভেড়ার পাল নিয়ে চলেছে রাস্তা জুড়ে ।পাহাড়ি মেয়েরা খুবই পরিশ্রমী। এদের পুরুষরা বেশিরভাগই একটু আয়েসী টাইপের হয়। মেয়েরা চাষের কাজ থেকে শুরু করে ঝর্ণা থেকে জল আনা, বাচ্চা সামলানো প্রায় সবই করে । চারিদিক দেখতে দেখতে আমরা এগোতে লাগলাম । কুকুরটা কখনো দৌড়ে আগে চলে যায় ,গিয়ে কিছুক্ষণ এটা ওটা শোকে আর আমাদের অপেক্ষা করে। কখনো আগে আর কখনো পেছনে ,যেন আমাদের পাহারা দিয়ে নিয়ে চলেছে। কৃষি খেত, বসত বাটি ,চায়ের দোকান এখন আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। দুপাশে কালচে নীল আর সবুজ পাহাড়। মাথার উপর আকাশের চাঁদোয়া। আমার কেমন যেন মনে হতে লাগলো এ যেন যুধিষ্ঠিরের স্বর্গযাত্রার পথ। নির্জন পথে শুধু আমরা আর আমাদের সঙ্গী এই সারমেয়টি। অনেকটা রাস্তা চলে এসেছি, ক্লান্তি লাগছে ।

ফেরবার ইচ্ছা প্রকাশ করাতে আমার স্বামী বললেন আগের মাইলস্টোন অব্দি যাব। অগত্যা এগোতে লাগলাম। হঠাৎ কুকুরটার মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখে আমরা অবাক হলাম। ও হঠাৎ খুব চঞ্চল হয়ে উঠল ।একবার আগে একবার পেছনে দৌড়ে যেতে লাগলো এবং হঠাৎ পথ রোধ করে দাঁড়ালো যেন আমাদের আর আগে যেতে দেবে না । আমি এগিয়ে ওর গায়ে হাত দিয়ে আদর করে বললাম কিরে হঠাৎ বাঘ দেখলি নাকি? কি হলো? ও গর গর করে আওয়াজ করে আমাদের পায়ের কাছে ঘুরতে লাগলো। অনেকটা পথ চলে এসেছি, হোটেল থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার । আবার অতটা নামতেও তো হবে ভেবে আমরা প্রত্যাবর্তনের পথ ধরলাম । কিছুটা গিয়ে আমি মজা করবার জন্য  উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করতেই ও ঘেউ ঘেউ করে দৌড়ে চলে এলো । তখন আমরা নিশ্চিত হলাম যে কোনো বিশেষ কারণেই ও আমাদের আগে যেতে দিতে চায় না । ফিরে চললাম , সারা রাস্তা আমি কারনটা অনুমান করতে চেষ্টা করলাম। বুঝতে পারলাম না কেন ও এমন করছে।সারাদিন নানা কাজের ফাঁকে খালি ওই  প্রসঙ্গটি আমার মাথায় ঘুরতে লাগলো। বিকেলে চা খেয়ে ফরেস্ট বাংলো ঘুরে দেখতে গেলাম। চারপাশে ফুলের মেলা, নানা রঙের ফুল । গোলাপের বাহার দেখে মন খুশিতে ভরে উঠলো। হঠাৎ বুড়ো চৌকিদারের আগমনে ঘুরে দাঁড়ালাম । কাছেই ওর গ্রাম । আমায় জিজ্ঞেস করলো কোথায় বেড়ালাম । সকালের ভ্রমণ কাহিনী এমনকি কুকুর প্রসঙ্গও এসে পড়ল। চৌকিদার  অবাক হয়ে আমার কথা শুনছিল। হঠাৎ উপরের দিকে তাকিয়ে হাতজোড়  করলো। আমি ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। চৌকিদার যা বলল তাতে আমার , বিস্ময়ের অবধি ছিল না। ও যা বলল তার বাংলা তরজমা করলে এই দাড়ায়,আজ আমরা যেখানে গিয়েছিলাম তার থেকে কিছুটা দূরে প্রায় বছর চারেক আগে একটা বাস এক্সিডেন্ট ঘটে । পাহাড়ে দুর্ঘটনাটা কোন ব্যাপারই না। এটা একটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার । মানুষ একটু কৌতুহলী হয়ে দেখে ,কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে, তারপর যে যার কাজে চলে যায়। কিন্তু এই দুর্ঘটনার পর থেকে ওখানে একা বা দুজন পথযাত্রীর সর্বদা বিপদ ঘটেছে। ওখানে যারা একা একা গেছে তারা কেউ নাকি ফিরে আসেনি। তারপর থেকেই ওদিকটাই লোকজন যাওয়া অনেক কমে গেছে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যার অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ছিল চারিদিকে।  ।পাহাড়ে লোকেরা অনেক অলৌকিক জিনিসের  বিশ্বাস নিয়েই বেঁচে থাকেন। 

 আমি অবাক হয়ে চৌকিদারের কথা  শুনছিলাম । জানিনা এটা সত্যি কি মিথ্যে । কিন্তু সেদিন ওটা আমি সত্যিই বিশ্বাস করেছিলাম । একটা ঘোরের মধ্যে কখন যে মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলাম  বুঝতে পারিনি ,ওখানে অধিষ্ঠিত দেবতার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে বাংলোয় ফিরলাম। তারপর যে কদিন আমরা ওখানে ছিলাম রোজ চায়ের দোকানে ওই কুকুরটার সঙ্গে আমাদের দেখা হতো। ওকে রোজ সকালে বিস্কুট খাইয়ে তবে আমরা ফিরতাম।


===================

অনিতা মুখার্জী

ব্যাঙ্গালোর ইলেকট্রনিক্স সিটি

No comments:

Post a Comment