হাততালি
সুকুমার বারিক
অনুপমা আবাসন শহরের প্রান্তে এক ছিমছাম থাকার জায়গা । গেটের দুপাশে নারকেল গাছের সারি। মাঝখানে ফুলের বাগান। মাঝখানের লন সন্ধ্যেবেলা বাচ্চাদের খেলায় জমে ওঠে । বয়স্কদের হাঁটাহাঁটির জন্য লেনটিও চমৎকার । সব মিলিয়ে এক অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন পরিবেশ । তৈরি হয়েছিল হাউসিং সোসাইটি । কয়েক বছরে রূপ বদলেছে । আবাসনের বাইরে থেকে দেখে মনে হয় না, যে হাউসিং সোসাইটির ভেতরে কতখানি অসহ্য রকমের নিঃশব্দ চাপা রাজনীতি জমে আছে!
এসবের মাঝেই এক সময় ছিলেন প্রদীপ মুখার্জি। অনুপমা সোসাইটির সাধারণ মেম্বারশিপ থেকে ধীরে ধীরে জয়েন্ট সেক্রেটারি পোস্টে উন্নীত হয়েছিলেন । সবার কাছে ছিলেন এক নির্ভরযোগ্য মুখ । নিজের কাজ কোন দিন ফেলে রাখেন নি । ঠিক তেমনি কারুর কাজে বাধা ও দেন নি । অন্যায় কিছু মনে হলে প্রতিবাদ করেছেন এবং তেমন কাজ হতে দেন নি । কারোর জলের ট্যাংকের সমস্যা হলে তিনি আগে ফোন করেছেন । কারোর বাথরুমের পাইপে ফুটো হলে প্রদীপদা জানতেন সবার আগে। কারোর জানলায় যদি হনুমানের অত্যাচার বাড়তো সেখানেও সমস্যার সমাধানের জন্য সবার মনে হতো প্রদীপদার কথা । এই আবাসনে প্রদীপদার হাসি মুখ সবাইকে মুগ্ধ করেছিল।
তাই যখন পরবর্তী সেক্রেটারি জন্য নাম ভাবা হচ্ছিল, তখন অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন যে প্রদীপদাই হবেন পরের সেক্রেটারি । একে তো যথেষ্ট করিতকর্মা লোক । খুব বেশি লোক যে অপছন্দ করেন তা নয় । তাছাড়া উনিই তো জয়েন্ট সেক্রেটারি রয়েছেন । সুতরাং প্রথাগতভাবেও উনারই সেক্রেটরি হওয়ার কথা। শুধু সমস্যা একটাই । উনি খুব স্পষ্টবাদী এবং সৎ । হয়তো আজকের দিনের সমাজে এটি অন্যরকম ভাবে দেখা হতেই পারে। কারণ অনেকেই সততাকে আর কোন বিশেষ গুণ হিসেবে দেখেন না । বরং এক বিশেষ অক্ষমতা হিসেবে ভাবেন ।
তাই সবাই ভাবলেন যে লোকটি এত বছর সৎ ভাবে কাজ করে আসছেন, তাঁর স্বীকৃতি তো পাওয়াই উচিত। কিন্তু সব জায়গায় উচিত কথাটা আজকাল আর মেনে চলা হয় না। বিশেষ করে রাজনীতির ঘোলা জল আজকাল বড় পরিসর থেকে ছোট পরিসর, সব জায়গায় কী অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে নিয়েছে!
দেবাশীষ রায় । এখনকার ভাইস প্রেসিডেন্ট। পরের বারে তাঁরই প্রেসিডেন্ট হওয়ার কথা। আগে কর্পোরেট দুনিয়ায় কাজ করতেন । এখন অবসর নিয়ে সোসাইটির রাজনীতিতে ব্যস্ত। অত্যন্ত চালাক , ধূর্ত এবং মতলবি লোক । নিজের ধান্দাটি বোঝেন ষোল আনা । তবে একটি বিশেষ গুণটির জন্য বিশেষ ভাবে সবার প্রিয় । উনি সব রকমের দুর্নীতিতে কিছুজনকে কিছু পাইয়ে দিয়ে নিজের এক বিশেষ দল তৈরি করেন । দেবাশীষ ভাবলেন প্রদীপ ভাল মানুষ হলেও ওর ভেতরে ওই যে কাজের যে জোর সেটা ঠিক তেমন করে নেই। মানে একটু খুলে বললে উনার দ্বারা কোন বড় স্পনসর বা এই ধরনের কিছু পাওয়ার কোন আশা নেই। দেবাশীষ প্রেসিডেন্ট হওয়ার সময় চাইছিলেন এমন একজনকে যিনি তাঁর এই রঙিন স্বপ্নকে পূর্ণ করতে পারবেন । যিনি পারবেন এদিক ওদিক থেকে নানান চলচাতুরিতে পয়সা আনতে। উৎসব হবে । মোচ্ছব হবে । গ্ল্যামারের ছটায় ফেটে পড়বে ওদের আবাসনের সমস্ত অনুষ্ঠান ।
ঠিক এই সময়ের সামনে এলেন রমেন্দু বিশ্বাস । অদ্ভুত এক লোক । এমনিতেই বেশ হাসি খুশি ধরনের লোক । কিন্তু কখন যে কার সঙ্গে ঘুরে বেড়ান বলা খুব মুশকিল। একসময় নাকি রিয়েল এস্টেট এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কারো কারো মতে বৃহত্তর রাজনীতিতেও ভালোই এক প্রভাব রয়েছে। কথার মধ্যে রয়েছে এক অদ্ভুত ধরনের চাতুর্যের হাসি । সেই হাসিতে রয়েছে একরকম ঠান্ডা প্রভাব । সবচেয়ে বড় কথা , স্পনসরসিপের জন্য যে চাতুরির প্রয়োজন সেখানটিতে রমেন্দুর জুড়ি মেলা ভার । সেখানে ওর ব্যবহারটা দেখার মতো । বেশ খানিকটা মাফিয়াদের মতো ।
দেবাশীষের খুব পছন্দ হল রমেন্দুকে । নিজের সমস্ত রকম প্রভাব খাটিয়ে প্রদীপকে সরিয়ে দিয়ে রমেন্দুকে সেক্রেটারির পদে বসিয়ে দিলেন । সমস্ত লিখিত অলিখিত নিয়ম ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। কেউ প্রতিবাদ করলেন না। সবাই চুপ। কারো কারো হয়তো একটু খারাপ লেগেছিল । কিন্তু বলার সাহস ছিল না। প্রদীপ নিজে কিছু বলেননি। শুধু একদিন পরই নিজের সব দায়িত্ব গুটিয়ে নিয়েছিলেন। নিঃশব্দে সরে গিয়েছিলেন তিনি। তারপর আর সবাই এলেন না । তার মুখটাই যেন মিলিয়ে গেল। সোসাইটির দেয়ালে দেওয়ালে টাঙানো ব্যানার মিটিংয়ে রঙিন পোস্টার কোথাও প্রদীপ নেই। নতুন কমিটি চলে এল। উৎসব হল। ব্যানার ছাপা হল । স্পনন্সর এলো । কিন্তু এক সময়ের এই ছায়ার মত থাকা মানুষটা থাকলেন না।
প্রদীপ চলে গেলেন নিজের ছোট্ট ঘরে । নিজেকে দূরে সরিয়ে নিলেন সব আয়োজন থেকে। দু একজন শুভাকাঙ্খী ছাড়া বিশেষ কেউ খোঁজও নিলেন না ।
তবে তিনি থেমে থাকেননি । একসময় প্রদীপ অল্প কিছু লিখতেন। পুরানো সেই অভ্যাসটাকে জাগিয়ে তুললেন । প্রথমে হাতে লিখে এখানে ওখানে পাঠাতে শুরু করলেন । তারপর ধীরে ধীরে কিছু লেখা ছাপা হতে থাকল। খবরের কাগজ, কিছু লিটল ম্যাগাজিন। ধীরে ধীরে কিছু ছোটগল্প , প্রবন্ধ, ছড়া, ভ্রমণ কাহিনি ইত্যাদির মধ্যে নিজেকে ছড়িয়ে দিলেন। খানিকটা সমাজসেবাও শুরু করলেন। প্রবীনদের কাগজপত্র নিয়ে সাহায্য করা। ছোট ছেলে মেয়ের জন্য বইয়ের ক্যাম্প । ধীরে ধীরে প্রদীপ নিজের মতো করে একটা সমাজ তৈরি করলেন। যেখানে তিনি নেতা নন। একজন সহযাত্রী।
এভাবে কেটে গেল পনেরটি বছর। অনুপমা সোসাইটি এখন অনেক বদলে গেছে। । রমেন্দু এখনো আছেন, তবে তাঁর প্রভাব আগের মত নেই । দেবাশীষও এখন ক্লান্ত প্রায় অবসরপ্রাপ্ত । নতুন ছেলেমেয়েরা এগিয়ে আসছে । কিন্তু তাদের মধ্যেও কেমন যেন একটা শূন্যতা রয়ে গেছে। একদিন এক মিটিং-এ কেউ হঠাৎ করে বলে উঠলো, আমরা কি একবার প্রদীপদাকে ডাকতে পারি না? প্রথমে কিছুটা নীরবতা। তারপর দেবাশীষ নিজেই সম্মত হলেন । ভেতরে ভেতরে তিনি জানতেন, এক চরম ভুল হয়েছিল একসময়। অনেকেই বললেন উনি তো অনেকটা দূরে সরে গেছেন , আর আসবেন বলে মনে হয় না । তবু একটা চিঠি গেল । ছোট্ট চিঠি কিন্তু কিছু গভীর শব্দ।
আমরা বুঝি আমরা ভুল করেছি। আপনি যদি আবার এসে আমাদের পরামর্শ দেন আমরা কৃতজ্ঞ থাকব।
প্রদীপ সেই চিঠি পড়ে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। একটা সময় ছিল এই সোসাইটি ছিল তার সবকিছু। আজ এটি অনেক দূরের কোণের এক শহরের মতো। চেনা অথচ অনেকটা অজানা । তারপর তিনি জবাব দিলেন এক লাইনে ।
অনেক দেরি হয়ে গেছে। মন সরে গেছে অনেক দূরে।
তিন মাস পর অনুপমা সোসাইটির ২৫ বছর পূর্তি। তখনকার প্রেসিডেন্ট উৎসব দাস প্রদীপের খুবই ভক্ত ছিলেন। বড় করে এক আয়োজন হবে। কেক ফেস্টুন স্মারক। সবাইকে অবাক করে এ রমেন্দু নিজে এসে প্রস্তাব দিলেন । প্রদীপদাকে বিশেষ সম্মান জানানো হোক। ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’।
এবারও এক চিঠি পাঠানো হল। প্রদীপ চুপ করে ছিলেন কিছুদিন । তারপর হঠাৎ জানিয়ে দিলেন যে তিনি আসবেন।
অনুষ্ঠানের দিন কমিউনিটি হল সাজানো হয়েছে ঝকঝকে করে। রঙিন ফেস্টুন ব্যানার । প্রোজেকশনে পুরনো দিনের ছবি। মঞ্চ আলো করে বসে রয়েছেন দেবাশীষ। একটু চুপচাপ। চেহারায় এক কৃত্রিম সৌজন্য । রমেন্দু এবারও তার পাশে বসে। চোখে এক অস্বস্তি। যা বয়সের থেকে বেশি হয় অভ্যন্তরের চাপ থেকে । দর্শক আসনে অনেক নতুন মুখ । অনেকেই জানেন না এই প্রদীপ মুখার্জি কে ছিলেন একসময় । অবশেষে নাম ডাকা হল। ‘আমাদের আজকের বিশেষ অতিথি একজন অত্যন্ত বিশিষ্ট জন। যিনি এই সোসাইটির এক বিশেষ আলো । যিনি এখন লেখক হিসাবেও সুপ্রতিষ্ঠিত । তাঁকে আমরা বিশেষ সম্মান জানাতে চাই।
প্রদীপ মঞ্চে উঠলেন । সাদা পাঞ্জাবি পাজামা । হাতে ছোট্ট একটা ডায়েরি । মুখে সেই শান্ত হাসি। শব্দহীন পা ফেলে মাইকের সামনে উঠে দাঁড়ালেন ।
- আপনারা আমাকে ডেকেছেন সম্মান জানাতে । আমি এসেছি, কারণ আমি বিশ্বাস করি , জীবনে কখনো কখনো একবার ফিরে তাকানো দরকার। আমি এসেছি কিছু কথা বলতে । কথাগুলি অনেক দিন আমার ভেতরে জমে ছিল ।
সবাই চুপ ।
- একদিন এই সোসাইটির কাজ আমার কাছে দায়িত্ব ছিল । ভালোবাসা ছিল । আমি চাইনি কিছু পাওয়ার জন্য কাজ করতে । কেবল অনুভব করতাম এই জায়গাটা আমার । সবকিছু দিয়ে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেছি । তরুণ বয়সের এক বিশেষ সময় আমি নিবেদন করেছিলাম এই সোসাইটির জন্য । কিন্তু কোথাও যেন একটা অদ্ভুত কিছু এল এই সোসাইটিতে । অদ্ভুতভাবে অনেক নিয়ম বদলে গিয়ে প্রভাব , স্বার্থ আর চাপ এসে ঢুকলো । এসে ঢুকলো স্পনসর আনার ক্ষমতার প্রতিযোগিতা । আমাকে সরিয়ে দেওয়া হল । না সেভাবে কেউ সরিয়ে দেন নি বা বাদ দেন নি। পরোক্ষভাবেই সেটা করা হয়েছিল। তখন কেউ প্রশ্ন করেন নি । কেউ পাশে দাঁড়ান নি। আজ আপনারা সেই ভুলের জন্য একটি সম্মান দিতে চান।
একটা কথা খুব স্পষ্ট করে বলে রাখি , সম্মান কখনো দান হয় না। সম্মান অর্জন করতে হয়। আমি সম্মানিত বোধ করছি না। তবে আমি এসেছি কারণ এই জায়গাটা আমার খুব চেনা। এসেছি বলতে ক্ষমা আমি করতে পারি । কিন্তু কোন কিছুই ভুলে যেতে পারি না ।
এরপরে প্রদীপ মঞ্চের একপাশে রাখা ফুলের তোড়াটি হাতে তুলে নিলেন । তারপর বললেন ‘এই তোড়াটা রেখে যাচ্ছি এখানে । আমার সম্মান তৈরি হয়েছে আমার নীরবতা দিয়ে। কারুর অনুশোচনার প্রস্তাবে নয়। আপনার চেষ্টা করুন ভবিষ্যতে যেন আর কাউকে এমন ভাবে সরিয়ে না দিতে । যদি পারেন তবেই সত্তিকারের হাততালি উঠবে ভেতর থেকে , শুধু হাতে নয়’ ।
এইটুকু বলে আস্তে আস্তে উনি মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন ।
কেউ হাততালি দিলেন না । তবু সেই নীরবতার ভেতরে যেন শত শত হাততালির প্রতিধ্বনি বেজে উঠতেই রইল ।
সত্যের । এক চরম সত্যের ।
Sukumar Barik, (Purnadas Road, Kolkata.)
MD , DNB , FRCOG
Professor
Department of Obstetrics and Gynaecology
ICARE Institute of Medical Sciences and Research , Haldia , West Bengal , India
Senior Consultant Obstetrician and Gynaecologist
Narayana Multispecialty Hospital , Howrah , WB
No comments:
Post a Comment