বিশ্ব ইতিহাসে আলবেরুনীর অবদান
এস এম মঈনুল হক
আলবেরুনি জন্মগ্রহণ করেন ৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে (৩৬২ হিজরি) মধ্য এশিয়ার খোয়ারিজম (বর্তমান উজবেকিস্তানের অংশ) অঞ্চলে। তাঁর পূর্ণ নাম ছিল আবু রাইহান মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ আল-বেরুনি। শৈশবেই তিনি গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন, ভূগোল, ইতিহাস, ও ভাষার প্রতি গভীর আগ্রহ দেখান। তিনি আরবি, ফার্সি, সংস্কৃত, গ্রীক, সিরিয়াক ও তুর্কিসহ বহু ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। রাজা মাহমুদ গজনবীর আমন্ত্রণে তিনি ভারতবর্ষ সফর করেন এবং দীর্ঘ সময় ধরে এখানকার সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে গভীর গবেষণা চালান।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অবদান:
১. জ্যোতির্বিদ্যায় অবদান:
আলবেরুনী জ্যোতির্বিদ্যাকে একটি নিখুঁত পর্যবেক্ষণভিত্তিক বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তিনি খগোলবিজ্ঞানের অনেক তত্ত্ব এবং গণনা পদ্ধতি নিয়ে কাজ করেন। তাঁর রচিত 'আল-কানুন আল-মাসউদি' নামক গ্রন্থে পৃথিবীর ঘূর্ণন, সূর্য ও চাঁদের গতি, গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। তিনি সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের সময় গণনা করতেন অত্যন্ত নির্ভুলভাবে।
২. ভূগোলে অবদান:
আলবেরুনী পৃথিবীর আকৃতি ও পরিমাপ নির্ণয়ে এক অসাধারণ কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি একটি পর্বতের উচ্চতা ও এর ছায়ার দৈর্ঘ্য মেপে পৃথিবীর পরিধি নির্ধারণের চেষ্টা করেন, যা আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও বিস্ময়কর। তাঁর লেখা "কিতাব আত-তাহকিক মা লিল-হিন্দ" গ্রন্থে ভারতীয় উপমহাদেশের ভৌগলিক বিবরণ, নদ-নদী, পর্বতমালা, বন্যা ইত্যাদি নিয়ে বিশ্লেষণ রয়েছে।
ধর্ম ও দর্শনে অবদান:
আলবেরুনী ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরোধিতা করে যুক্তিনির্ভর ব্যাখ্যার পক্ষে ছিলেন। তিনি ইসলাম ছাড়াও হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম এবং খ্রিস্টধর্ম নিয়ে গভীর গবেষণা করেন। ভারতের ধর্মীয় সংস্কৃতি এবং দর্শন সম্পর্কে তিনি যা লিখেছেন তা আজও গবেষকদের জন্য অমূল্য সম্পদ।
১. হিন্দুধর্ম বিষয়ে গবেষণা:
ভারত সফরের সময় আলবেরুনী সংস্কৃত ভাষা শেখেন এবং হিন্দু শাস্ত্র পড়ে তা আরবিতে অনুবাদ করেন। তাঁর বই "তাহকিক মা লিল হিন্দ" হিন্দু সমাজ, ধর্মীয় আচার, দর্শন ও বিজ্ঞান সম্পর্কে এক মহামূল্যবান দলিল। তিনি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ ও ভাগবত গীতা পড়ে তার সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ করেন।
২. যুক্তিবাদ ও নিগূঢ় দর্শনচর্চা:
আলবেরুনীর চিন্তাধারা ছিল যুক্তিনির্ভর ও খোলা মনস্ক। তিনি ধর্মীয় কুসংস্কার বা গোঁড়ামির বাইরে এসে জ্ঞান আহরণ ও বিতর্কের পক্ষে ছিলেন। তাঁর লেখায় গ্রিক দর্শনের ছাপ থাকলেও তিনি ইসলামি তাওহিদী দর্শনের প্রচারকও ছিলেন।
ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় অবদান:
আলবেরুনী একাধারে বহু ভাষার দক্ষ পণ্ডিত ছিলেন। তিনি ফার্সি, আরবি, সংস্কৃত, গ্রিক, সিরিয়াক, হিব্রু প্রভৃতি ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করেন। তিনি ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিভিন্ন ভাষার তুলনামূলক রূপরেখা তৈরি করেন। সংস্কৃত ভাষায় তাঁর দখলের প্রমাণ আমরা পাই যখন তিনি সংস্কৃত গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদ করেন।
ইতিহাসচর্চায় অবদান:
আলবেরুনী একজন ইতিহাসবিদ হিসেবেও বিশিষ্ট ছিলেন। তিনি নানা জাতি ও দেশের ইতিহাস, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ধর্ম নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর ইতিহাসচর্চা ছিল তথ্যনির্ভর এবং বস্তুনিষ্ঠ। তিনি কোনো জাতির ইতিহাস লেখার সময় পক্ষপাতিত্ব এড়িয়ে চলতেন এবং নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও দলিলের ভিত্তিতে লিখতেন।
গণিতে অবদান:
আলবেরুনী জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি, ও পাটিগণিত নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি গ্রিক ও ভারতীয় গণিতের তাত্ত্বিক ও প্রয়োগগত দিক নিয়ে কাজ করেন। ত্রিকোণমিতিতে তিনি কোণের মাপ নির্ণয়, সিন ও কোসাইন পদ্ধতি এবং গোলীয় ত্রিকোণমিতি নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন।
চিকিৎসাশাস্ত্রে অবদান:
আলবেরুনী চিকিৎসাবিজ্ঞানের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। ভারতীয় আয়ুর্বেদ পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত লিখেছেন এবং গ্রিক চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি ঔষধের গুণাগুণ, শরীরের বিভিন্ন রোগ এবং সেগুলোর চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে আলোকপাত করেন।
ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা:
আলবেরুনী ছিলেন ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতির এক অন্যতম পর্যবেক্ষক। তিনি লিখেছেন – "ভারতীয়দের ধর্ম, সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিনীতি নিয়ে ধারণা না রেখে তাদের বিচার করা একধরনের অন্যায়।" তিনি হিন্দু সমাজের কাস্ট সিস্টেম, পঞ্চ মহাযজ্ঞ, তীর্থযাত্রা, বিবাহপ্রথা, নৃত্য, সংগীত, শিল্পকলা প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তারিত লেখেন।
অনুবাদ সাহিত্যচর্চায় অবদান:
আলবেরুনী ভারতীয়, গ্রিক ও সিরিয়াক সাহিত্যের অনেক গ্রন্থ আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন। এর ফলে মুসলিম বিশ্ব নতুন জ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত করে। এই অনুবাদ চর্চার মাধ্যমেই পরবর্তীকালে ইউরোপীয় রেনেসাঁর সূচনা হয়েছিল বলে অনেক পণ্ডিত মনে করেন।
তাঁর গ্রন্থসমূহ:
আলবেরুনী প্রায় ১৪৬টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
1. আল-কানুন আল-মাসউদি – জ্যোতির্বিদ্যার গ্রন্থ
2. আস-সাইদানা ফি তিব্ব – চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ক
3. আত-তাফহিম – গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যায় প্রাথমিক পাঠ
4. তাহকিক মা লিল-হিন্দ – ভারতীয় সমাজ ও ধর্ম নিয়ে গবেষণাগ্রন্থ
5. আল-জামি ফি হিশাব – গণিতবিষয়ক বই
আলবেরুনীর চিন্তাধারার প্রভাব:
আলবেরুনীর গবেষণা ও দর্শন শুধু ইসলামি জগতে নয়, ইউরোপীয় বিজ্ঞান ও দর্শনেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। তাঁর বিশ্লেষণী মনোভাব, পর্যবেক্ষণভিত্তিক চিন্তা এবং সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক বিজ্ঞানের পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছে।
আলবেরুনী ছিলেন এক অসাধারণ প্রতিভাবান মনীষী, যাঁর গবেষণা ও চিন্তাভাবনা মানব সভ্যতাকে শত শত বছর ধরে আলোকিত করে চলেছে। তাঁর জ্ঞানপিপাসা, নিরপেক্ষতা ও গবেষণামূলক দৃষ্টিভঙ্গি আজও বিজ্ঞান ও মানবিকতার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। জ্ঞানচর্চা, মানবিক মূল্যবোধ এবং বহুভাষিক ও বহুসাংস্কৃতিক বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে আলবেরুনীর অবদান সত্যিই অতুলনীয়।
=============
এস এম মঈনুল হক, মুর্শিদাবাদ
No comments:
Post a Comment