স্বাধীনতার কবিতা ।। অনিন্দ্য পাল - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

Wednesday, August 20, 2025

স্বাধীনতার কবিতা ।। অনিন্দ্য পাল

 
ভারতের স্বাধীনতা দিবস ব্যানার

স্বাধীনতা 

অনিন্দ্য পাল 


এক. 
 
স্বাধীনতা 
এনার বয়স এক এক দেশে এক এক রকম 
ভারতে মাত্র ছিয়াত্তর কি সাতাত্তর 
পৃথিবীর বয়স যদি নাও ধরি 
মানুষের বয়সের তুলনায় ইনি নিতান্তই 
শিশু 
এখনো প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়নি 
ভাষা শিক্ষাও হয় নি এখনো পুরোপুরি 
তবে ইতিমধ্যেই ইনি যেটা খুব ভালো শিখেছেন 
সেটাকে ফুটপাতের ভাষায় বলে বাজার 
এই দেশে এখন বাজার হয়েছে দেবতা 
তার লাল চোখে ভয় পায় রাজা এবং প্রজা 
কী বললেন? 
রাজা নেই? 
প্রজাও নেই? 
কে বলে?  
দিব্বি আছে রাজা 
প্রজারাও আছে বেশ 
অলিতে গলিতে মাঠে ঘাটে নগরে বন্দরে 
কাগজে টিভিতে আছে কালো চুল বা পক্ককেশ 
রাজারা আছেন সভায়, ভবনে এবং চেয়ারে 
রাজাদের নাম লেখা থাকে অনেক উঁচুতে 
যত্নে এবং কেয়ারে 
মঞ্চ আলো করে এসে বসেন সম্রাট 
কত প্রজা আছে তাঁর সীমানায় গুনে নেন রাজপাট 

তবে বলতে পারো মুকুটের দিন শেষ 
বলতে পারো প্রজাদের গলাটা একটু উঁচু এখন 
জিরাফের মত না হলেও পৌঁছে যাচ্ছে 
কুর্সির হাঁটুর কাছে, 
কিন্তু ব্যস্ ওটুকুই, 
কুর্সির উপরে যারা চড়ে বসেছে একবার 
তাদের গোপন হাতে কাটারির ধার 
এদের কারো কারো আবার সহস্র হাত 
কোনো হাতে ফুল কোনো হাতে কাটা মুণ্ডুর চুল 
আসলে সবাই তো স্বাধীনতা পেতে চায় নি 
সবাই স্বাধীনতা দিতেও চায় নি 
এই চাওয়া না-চাওয়ার মাঝে কেউ মাথায় পেয়েছে ছাতা 
বাকিরা খোলামকুচি 
তাদের দীর্ঘশ্বাসের উপর ধবধবে পালিশ মার্বেল পাতা 
                এই কি তবে স্বাধীনতা? 

এটাই কি আমরা অর্জন করেছিলাম শহীদের রক্তে? 
এই স্বাধীনতার জন্যই কি ক্ষুদিরাম, সুভাষ, ভগৎ , যতীন 
লড়েছিলেন শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে? 
উন্নাও, হাথরস, বারাসত, মণিপুর জ্বলতে জ্বলতে 
আগুন লেগেছে আরজি কর, ল-কলেজ আর 
আমাদের বিছানার চাদরে 
মন্দির মসজিদ দেবতা হয়েছে আমাদের 
মৃত্যু সস্তা হয়েছে জলের মত 
                                   শাসকের আদরে 
"মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম" ভুলে গেছে দেশ 
মানচিত্র জুড়ে এখন ছন্নছাড়া বেশ 
তবু প্রজারা ভালো আছি, ভালোই আছি বেশ। 

দুই. 
 
পরাধীনতা একটা বকলস! 
কেউ এটা নিজে পরে নেয় গয়না ভেবে 
কেউ বাধ্য হয় পরে নিতে লোভ খ্যাতি যশ 
মীরজাফর একা দায়ী নয়, 
পরাধীনতার পাঁক আজও আমাদের মুলতানি মাটি 
মেরুদণ্ডে ঘুন লেগে আছে হাজার বছর ধরে 
এখন সেই সব পতঙ্গভুকের গায়ে রংধনু ফিতে
লাল, নীল, আকাশি, সবুজ রঙের আঁচড়ে 
আত্মভুক কর্কট ধরেছে সবার অস্থিতে, 

অন্ধকার সমানে চলছে কাঁধে কাঁধ দিয়ে 
আগুনের ফোঁটা দাবানল জ্বলে পূর্বে পশ্চিমেতে 
অভয়াদের নগ্ন শবে নাচে নষ্ট সভ্যতা 
পুড়ে ছাই হয়ে গেছে কবে ধর্ম নিরপেক্ষতা 
ভাইয়ের রক্ত মেখে ভাই গেছে জিতে!  
অযোগ্যরা মুকুট পরে আর যোগ্যরা ফুটপাতে 
পেটের টানে ছশো মাইল দূরে নাম পায় পরিযায়ী 
এও এক স্বাধীনতা, পরাধীনতার বামহাতে। 

কিন্তু ও ভাবে কি জেতা যায়? 
সব শেষে সবাইকে পেরোতে হবে সেই লাল ফিতে। 

স্বাধীনতা কি তবে শুধুই একটা শব্দ? 
স্বাধীনতা শুধু একটা দিন নয়, জীবন 
স্বাধীনতা শুধু একটা তারিখ নয়, মহাকাব্য  
স্বাধীনতা শুধু বাৎসরিক ছুটি নয়, জেগে ওঠার মন্ত্র  
স্বাধীনতা শুধু এক গোছা রজনীগন্ধা ফুল নয়, অথবা  
নয় শুধু চিরকুটে লেখা হাজার শব্দের বক্তৃতা,  
স্বাধীনতা অঙ্কুরিত হয় না শুধু ভোটবাক্সে ডুবে মরার জন্য 
স্বাধীনতা ভূমিষ্ঠ হয়নি দাউ দাউ দাবানল হয়ে জ্বলবার জন্য 
বরং বলতে পারি স্বাধীনতা নরম ঘাসফুলের মত 
বরং বলতে পারি স্বাধীনতা মায়ের আদরের মত 
স্বাধীনতা খুব সরল সেই গ্রামের মেয়ে 
যার নথে লেগে আছে ভালোবাসার পরাগরেণু 
স্বাধীনতা অনেকটা নীল আকাশের মত 
যার বুকে মাথা রেখে কাটিয়ে দেওয়া যায় 
আরও একটা হরপ্পার সকাল 
স্বাধীনতা শুধু আগুন নয়, মানবতা মহাকাল। 

স্বাধীনতা অনেকটা সেই নৌকার মত
যার মাঝির একহাতে বৈঠা, অন্য হাতে কালাশনিকভ
যারা বসে আছি, যারা ভেসে আছি তাদের ঠিক নিচে
অনন্ত শান্তি… 
অথচ আমরা কেউ শান্তি চাইনি 
কেউ চাইনি ডুবো-পাথরের বুকে গড়ে তুলতে
নিজেদের স্মৃতিসৌধ, তবু
তবু কারা যেন সপ্ত-পাতাল পেরিয়ে এখন আমাদের পৈঠায়
অযুত মন্ত্রে বোধন করে শকুনির হাড়ের এবং
সমস্ত অভিমণ্যুর মৃত্যুর পরেও দ্রৌপদীর গোড়ালি চুম্বন করে বলে
যাও, আজ থেকে তুমি স্বাধীন! 
কিন্তু আগুন তবু নেভে না, 
রক্ত তবু বয়ে যায় রাজপথ থেকে শাসকের কিউবিক্যালে
তবু প্রতি ১৬ মিনিটে মৃত্যু হয় কোন না কোন মেয়ের// যোনির 
বছর ঘুরে যায়, যোগ্যতার মৃতদেহ লোপাট হয়
ফেঁপে ওঠে জনগনের পেট, সেখানে শুধু জমা হয়
পঁচাত্তর পেরোনো গেঁজানো স্বপ্নের অ্যালকোহল
আমরা আরো মাতাল হই
একে অন্যকে বলি, 'তুই চোর'  এবং তারপর
আবার জড়িয়ে ধরি নপুংসক চিহ্নের গলা, চিবুকে চুম্বন দিয়ে বলি
আমরা সবাই স্বাধীন আমাদের এই আত্মভোলা দেশে। 

তিন. 

স্বাধীনতা! 
কার থেকে? 
কোথা থেকে? 
দেশ?  বিদেশ? সাদা? কালো? 
নাকি ধর্ম? অধর্ম? অথবা ইত্যাদি প্রভৃতি… 
স্বাধীনতা কি পাওয়া যায়? 
হাট-বাজার বা মলে? নিদেন পক্ষে অনলাইনে? 
কিলোদরে অথবা ছোট ছোট টুকরোয়? 
আসলে আমরা পৌঁছেছি বাঘের গুহা থেকে
শেয়ালের গর্তে, 
একই সূর্য, একই চাঁদ, একই নক্ষত্র-ভস্ম 
আলাদা হয়েছে শুধু স্থানাঙ্ক জ্যামিতি
তাই ব্রেকিং নিউজে প্রকাশিত হয় লাশের পরিচয়
পেপারের কলামে ছাপা হয় ধর্ষিতার অস্পষ্ট ছবি
ফাঁক বাড়তে থাকে এপার-ওপারের আর ধারাল হতে থাকে
সাদা পোষাকে ভোটযুদ্ধে জেতা বকলমে রাজাদের ক্যানাইন, 
তাই রক্ত পাতলা হতে হতে মিশে যায় শাসকের নর্দমার জলে
তাই ঘুণপোকার জনসংখ্যা বাড়তে থাকে স্পাইনের শহরে
আর আমরা প্রশস্ত হতে হতে বিবর্তিত হয়ে উঠি
'স্বাধীন' খোজা প্রহরীর দলে… 
 
==============

অনিন্দ্য পাল 
চম্পাহাটি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা 
 
চিত্রঃ সংগৃহীত।

No comments:

Post a Comment