রুম নম্বর ১০৪
সুমিত মোদক
দরজার শব্দটাই অস্বাভাবিক । কেমন যেন কর্কশ। বহু দিন বন্ধ পুরানো দরজা খুললে যেমন শব্দ তোলে ঠিক তেমনই — ক্যা …
রুমে ঢুকতেই বেশ গরম । অথচ , বাইরে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে । একটা জানলা খুলতেই বুকটা চড়াৎ করে উঠল । জানালার কাছে থেকে ঝটপট করে উড়ে গেল ধূসর রঙের কয়েকটি পাখি । হঠাৎ করে এতো গুলি ডানার শব্দ । ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম । বাইরের ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকে পড়লো রুমে । এ জানালা দিয়ে দেখা যায় সামনের পাহাড়টিকে । পাশের হোমস্টে গুলিও ।
উত্তরবঙ্গের কালিম্পং জেলার অতি মনোরম এক অফবিট মাইরুং গাঁও । পাহাড় ঘেরা ছবির মতো সাজানো এক গ্রাম । সাধারণ বাঙালি পর্যটক দার্জিলিং ভ্রমণ করলেও বেশ কিছু ভ্রমন পিপাসু মানুষের প্রথম পছন্দের তালিকায় রাখছে এই অফবিট । সে কারণে বেশ কিছু বাঙালি ও বিদেশি পর্যটক লক্ষ্য পড়ল ।
হোমস্টের ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে শিলি , আমার মেয়েকে বলে — সোনাই , মিমোকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে এসো কে কোন রুমটায় ঢুকবে ।
ঋদ্ধা কি অতো সব বোঝে ! সে সেখান থেকেই বলে ওঠে — ও মিমো ,কে কোন রুমে থাকবে ?
শিলি একটু বিরক্ত হলো । কিন্তু করার কিছু নেই । বাচ্চা মানুষ বলে ফেলেছে । তাই সে সামলে নিয়ে বলল — নিচে গিয়ে তো বলতে বললাম ।
মেয়েদের উপরে যেতে বলে আমি ও দ্বীপ তখন হোমের সামনে দাঁড়িয়ে গৃহকর্তার সঙ্গে কথা বলছিলাম । আসলে কি হোটেলে বা হোমস্টের রুম নম্বর নিয়ে দ্বীপের অনেক জ্যোতিষ ব্যাখ্যা আছে । নেগেটিভ , পজেটিভ । মোদ্দাকথা পাশ্চাত্য সংখ্যাতত্ত্ব । আমার আবার ও সব বিষয়ে কোনও বিশ্বাস নেই । তবে কারোর বিশ্বাসকে ও অসম্মান করিনা । এ সব যে যার নিজস্ব ব্যাপার ।
উপরে গেলাম । চারটে রুম আছে । নাম্বার যথাক্রমে ১০১ , ১০২ , ১০৩ , ১০৪ । হাতে গোনা কয়েকটি রুম । কিন্তু নম্বর গুলি ওভাবে । দ্বীপ নিলো রুম নম্বর ১০৪ ।
। একটা রাত এখানে থাকা হবে । পরের দিন লোলে গাঁও ।
রাত নামার পর থেকেই বদলে যেতে শুরু করলো পরিবেশ । অসম্ভব এক নিস্তব্ধতা । কেবল মাত্র কীট পতঙ্গের শব্দ । সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে ঠাণ্ডা । এতো ঠাণ্ডা যে হাত পাও ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে । দিন ও রাতের তাপ মাত্রার পার্থক্য বেশ টের পাওয়া গেলো ।
দশটার মধ্যে খাওয়া দাওয়া সেরে যে যার রুমে চলে গেলাম । আগের রাতে ঘুম ঠিক হয়নি । তাই ঘুমিয়ে পড়লাম শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে । ফোনটা বেজে উঠতেই ঘুমটা ভেঙে গেল । শিলি ফোন করেছে । রাত তখন দুটো ।
— কি হলো ?
— দরজা খুলুন । গিয়ে বলছি ।
হাপিয়ে হাপিয়ে এই চারটে শব্দ বললো ।
দরজা খুলতেই ওরা দুজনে ঢুকে পড়ল আমাদের রুমে । হাঁপাচ্ছে ।
— বস, জল খা ।
দুজনেই ঢোক ঢোক করে জল খেলো ।
— বল , কি হয়েছে ?
— আমাদের রুমে ভূত আছে ।
— সে কি রে ! কি বলছিস !
— হ্যাঁ ! আমি নিজের চোখে দেখেছি । দ্বীপ ও দেখেছে !
দ্বীপ বললো — হ্যাঁ, জিজু সত্যি ভূত আছে ।
— কি হয়েছে বোলবি তো ।
শিলি বললো — ঘুমাতে ঘুমাতে হটাৎ মনে হলো আমার মাথার কাছে কে যেনো দাঁড়িয়ে আছে । ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে । চোখ খুলে দেখি আমার বয়সী এক মেয়ে । ভয়ে হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। কোনও রকমে দ্বীপ কে ডাকলাম — এই দেখো , কে দাঁড়িয়ে আছে !
— কে ! কোথায় !
— ওই দেখো দরজার দিকে চলে যাচ্ছে !
দ্বীপ ও নাকি নাইট ল্যাম্পের আলোতে দেখতে পেয়েছে একটা ছায়ার মতো কিছু সরে যাচ্ছে । সঙ্গে সঙ্গে রুমের সবকটি আলো জ্বেলে দেয় । তখন আর কিছুই নেই । তবে রুমের মধ্যে এক বীভৎস গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে । সে কারণে ওরা আর ও রুমের মধ্যে থাকার সাহস দেখাতে পারলো না।
আমি এমনিতেই ভীতু মানুষ । ভূতের ভয় আছে । বেশ কয়েক বার আলো-ছায়ার সামনে সামনি হতে হয়েছে । তবে সে সময়ে ভিতর থেকে কে যেন সাহস যুগিয়েছে । বেশ সাহসী হয়ে উঠেছিলাম । সে কারণে বললাম — তোরা এ রুমে থাক । আমি বরং ও রুমে গিয়ে দেখে আসি ।
সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী বলে উঠল — তোমাকে অতো সাহস দেখাতে হবে না । এখানে শুয়ে পড়।
মেয়েও বললো — তোমার ওই রুমে যাওয়ার দরকার নেই ।
বাধ্য, কথা না বাড়িয়ে কোনও রকমে বেড ও সোফায় শুয়ে রাতটা কাটালাম ।
পরের দিন সকাল সকাল উঠে দ্বীপ ও শিলিকে কে নিয়ে ওই রুমে গেলাম ওদের লাগেজ গুছিয়ে নিতে । সবই ঠিক আছে । তবে দ্বীপের সংখ্যাতত্ত্ব অনুযায়ী এ রুমে তো ভূত প্রেত থাকার কথা নয় । সবই শুভ হওয়ার কথা । তাহলে কি ওরা ওসব ভাবে বলে এমনি ঘটনা ঘটেছে ওদের সঙ্গে ! নাকি সবটাই ওদের মনের ভুল ! কি জানি !
হঠাৎ আমার আবার বুকটা চড়াৎ করে উঠল । অটোমেটিক দরজা বন্ধ হওয়ার সেই অদ্ভুদ শব্দ — ক্যা …
================
সুমিত মোদক, দীঘির পাড়, দক্ষিণ ২৪ পরগনা।
No comments:
Post a Comment