শ্রীজিৎ জানা
ক্ষুধা আদিমতম; অনন্ত। প্রাণময় দেহ, অন্নময় কোষ। গুহাবাসী হাতে অস্ত্র তুলে নেয় শুধুমাত্র আত্মরক্ষার্থে নয়, ক্ষুধা নিবৃত্তির কারণেও। ক্ষুধার থালায় একটা অস্ত্র লুকানো থাকে।খাদ্য মানে একটা চলমান লড়াই ; সংগ্রাম। আহার্য দ্রব্য সংগ্রহে আদিমমানুষদের নিশ্চত লড়তে হয়েছে। অরণ্যবাসী হওয়ার কারণে বনজ খাবার সবসময় ও সর্বত্র সহজলভ্য ছিল তা তো নয়। যাযাবর জীবনে বিবর্তনের পশ্চাতে ছিল খাদ্যাদি অন্বেষণ। পশুমাংসের ক্ষেত্রে পশুশিকারও ছিল যথেষ্ট ঝক্কিঝামেলার। তার সাথে শিকারের কৌশল তৈরি, অস্ত্র নির্মাণ, অস্ত্র চালনের পারদর্শিতা - সবমিলে ছোটখাটো একটা যুদ্ধের আয়োজন! যূথবদ্ধ ভাবে শিকার করলেও বিপরীত দিক থেকে হিংস্র আক্রমণ এবং প্রাণহানির শঙ্কা থেকেই যেত। কিন্তু সবশেষে সবার গ্রাসে সমান খাদ্য বন্টন হত।
আদিম মানুষ তার ক্ষুধা নিবৃত্তির কারনেই প্রথম গ্রাস মুখে তুলেছে। গুহাচরদের স্বাদ উপলব্ধির প্রাথমিক অবস্থা কেবলমাত্র অনুমানজাত। খাদ্যগ্রহণের সূচনালগ্নে স্বাদগ্রন্থির ছিল সওয়া আর না সওয়ার বাছবিচার। লালারসের আমুদে নিঃসরণ এবং স্বাদকোরকের আস্বাদনের বিলাসিতা বোধকরি ততখানি ছিল না। দাবানলের আগুনে পোড়া মাংসের টুকরো প্রথম তাদেরকে স্বাদের রহস্য বুঝতে শেখায়। খাবারের পাতে তখন থেকে কাঁচা মাংস নিষিদ্ধ হল,সমাদরে ঠাঁই পেল পোড়ামাংস।গুহাবাসীদের এবার থেকে ভোজনরসিক বলা বাড়াবাড়ি হবেনা। স্বাদগ্রন্থি এবার থেকে সামান্য বিলাসী হয়ে উঠল বোধহয়।
আগুন আবিষ্কারের সাথে সাথে হোমোসেপিয়েন্সের স্বাদে ও সাধে বদল এল। রসনার রসে মজে জন্ম হল হেঁসেলের।
আদিমানবরা নিরামিষাশী না আমিষভোজী তা নিয়ে তত্ত্বতালাশ চলছে বিস্তর। ইতিমধ্যে হয়তো বা
সর্বভুকের শিরোপা মাথায় উঠেছে। তারা পুষ্টির জন্য নাকি পেটের জন্য খাবার খেত গবেষকগণের এসব নিয়ে ভাবনার অন্ত নেই।কিন্তু একটা ব্যাপার নিশ্চত প্রস্তরযুগের মানুষদের খাদ্য তালিকায় শস্যের অনুপ্রবেশ ঘটেছে অনেক পরে। ফলমূল,শাকপাতা, মাংস, দুধ প্রভৃতি পুষ্টিকর খাদ্যই তারা গ্রহণ করছে শুরুর দিকে। দলবদ্ধ জীবনে বোধকরি খাদ্য বৈষম্য ছিল না। পরবর্তী সময়ে শস্য উৎপাদন আর তাকে মজুত রাখার পেছনে ছিল ভবিষ্যতের খাদ্যসংস্থানকে সুনিশ্চিত করণের ভাবনা। একইসাথে গুদামজাত শস্যগহ্বরে জন্ম নিয়েছে প্রভুত্ব, আধিপত্য, লোভ, স্বর্থপরতা আর বৈষম্যকরণের রক্তবীজ। গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ তাদের দলপতি বেছে নিয়েছে গোষ্ঠীর সবচেয়ে ক্ষমতাবানকে। ক্ষমতা কখনোই কোনকিছুর সুষম বন্টন চায় না। ক্ষমতার হাতে থাকে বৈষম্যের বিচার। নিজস্ব বৃত্তের বাইরে ক্ষমতার চাহুনি রক্তবর্ণ এবং ক্রূর। পছন্দ - অপছন্দ,অনুগত- বিপ্রতীপ, তোষামুদে - নিন্দুক হাজারো বাটখারায় মাপজোপ চলতে থাকে ক্ষমতার দরবারে।
ক্ষুধা একটি শারীরিক প্রক্রিয়া হলেও, ব্যক্তির অথবা সমষ্টির দেহগত জৈবনিক চাহিদা হলেও ক্ষুধা নিবৃত্তির চাবিকাঠি ক্ষমতার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। ক্ষুধার একটা বিষময় জ্বালা আছে,সেই অসহনীয় যন্ত্রণা ব্যাক্তি অথবা সমষ্টির শিরদাঁড়াকে দুর্বল করে দ্যায়,অন্যদিকে ক্ষমতাকে বাঁচিয়ে রাখে।ক্ষুধার থালায় আড়াআড়ি ভাগের নিষ্ঠুর কৃৎকৌশল ক্ষমতার মজ্জাগত স্বভাব।
পশু তার শিকারের খাদ্য সবসময় অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চায় না। অনেকক্ষেত্রে এক দলের অধিকারে থাকা খাবারে অন্যেরা ভাগ বসাতে চাইলে তুমুল হাঙ্গামা বেঁধে যায়। অথচ নাবালক শাবকের জন্য খাদ্য সংগ্রহে মা-পশুর মরিয়াভাব পশু-মানুষের মাতৃত্বের গরিমাকেই সম্মনীত করে। শুধুমাত্র বোধকরি মাতৃক্রোড়েই দ্বিপদ আর চতুষ্পদের সীমারেখা ঘুচিয়ে দ্যায়। শাবক অথবা নাবালক মাত্রই বাড়তি যত্ন স্নেহ ও সমাদর প্রার্থী। সমাজ পরিবেশে নাবালক কারা? 'নাবালক' শব্দটিকে শুধুমাত্র বয়সের মাপদন্ডে মাপা হবে নাকি তার ভাবনার পরিসর হবে বিস্তৃত? 'নাবালক' শব্দে যদি ছোট, অসহায় অর্থে ধরা যায় তবে অর্থ, জাতি, খ্যাতি ইত্যাদির সাথে যুক্ত করে ভাবা যেতেই পারে। তাহলে সেখানে কিঞ্চিৎ যত্ন স্নেহ সমাদরের কৃপাদৃষ্টি পড়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে আশা করি।
আদিম মানুষ তার ক্ষুধা নিবৃত্তির কারনেই প্রথম গ্রাস মুখে তুলেছে। গুহাচরদের স্বাদ উপলব্ধির প্রাথমিক অবস্থা কেবলমাত্র অনুমানজাত। খাদ্যগ্রহণের সূচনালগ্নে স্বাদগ্রন্থির ছিল সওয়া আর না সওয়ার বাছবিচার। লালারসের আমুদে নিঃসরণ এবং স্বাদকোরকের আস্বাদনের বিলাসিতা বোধকরি ততখানি ছিল না। দাবানলের আগুনে পোড়া মাংসের টুকরো প্রথম তাদেরকে স্বাদের রহস্য বুঝতে শেখায়। খাবারের পাতে তখন থেকে কাঁচা মাংস নিষিদ্ধ হল,সমাদরে ঠাঁই পেল পোড়ামাংস।গুহাবাসীদের এবার থেকে ভোজনরসিক বলা বাড়াবাড়ি হবেনা। স্বাদগ্রন্থি এবার থেকে সামান্য বিলাসী হয়ে উঠল বোধহয়।
আগুন আবিষ্কারের সাথে সাথে হোমোসেপিয়েন্সের স্বাদে ও সাধে বদল এল। রসনার রসে মজে জন্ম হল হেঁসেলের।
আদিমানবরা নিরামিষাশী না আমিষভোজী তা নিয়ে তত্ত্বতালাশ চলছে বিস্তর। ইতিমধ্যে হয়তো বা
সর্বভুকের শিরোপা মাথায় উঠেছে। তারা পুষ্টির জন্য নাকি পেটের জন্য খাবার খেত গবেষকগণের এসব নিয়ে ভাবনার অন্ত নেই।কিন্তু একটা ব্যাপার নিশ্চত প্রস্তরযুগের মানুষদের খাদ্য তালিকায় শস্যের অনুপ্রবেশ ঘটেছে অনেক পরে। ফলমূল,শাকপাতা, মাংস, দুধ প্রভৃতি পুষ্টিকর খাদ্যই তারা গ্রহণ করছে শুরুর দিকে। দলবদ্ধ জীবনে বোধকরি খাদ্য বৈষম্য ছিল না। পরবর্তী সময়ে শস্য উৎপাদন আর তাকে মজুত রাখার পেছনে ছিল ভবিষ্যতের খাদ্যসংস্থানকে সুনিশ্চিত করণের ভাবনা। একইসাথে গুদামজাত শস্যগহ্বরে জন্ম নিয়েছে প্রভুত্ব, আধিপত্য, লোভ, স্বর্থপরতা আর বৈষম্যকরণের রক্তবীজ। গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ তাদের দলপতি বেছে নিয়েছে গোষ্ঠীর সবচেয়ে ক্ষমতাবানকে। ক্ষমতা কখনোই কোনকিছুর সুষম বন্টন চায় না। ক্ষমতার হাতে থাকে বৈষম্যের বিচার। নিজস্ব বৃত্তের বাইরে ক্ষমতার চাহুনি রক্তবর্ণ এবং ক্রূর। পছন্দ - অপছন্দ,অনুগত- বিপ্রতীপ, তোষামুদে - নিন্দুক হাজারো বাটখারায় মাপজোপ চলতে থাকে ক্ষমতার দরবারে।
ক্ষুধা একটি শারীরিক প্রক্রিয়া হলেও, ব্যক্তির অথবা সমষ্টির দেহগত জৈবনিক চাহিদা হলেও ক্ষুধা নিবৃত্তির চাবিকাঠি ক্ষমতার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। ক্ষুধার একটা বিষময় জ্বালা আছে,সেই অসহনীয় যন্ত্রণা ব্যাক্তি অথবা সমষ্টির শিরদাঁড়াকে দুর্বল করে দ্যায়,অন্যদিকে ক্ষমতাকে বাঁচিয়ে রাখে।ক্ষুধার থালায় আড়াআড়ি ভাগের নিষ্ঠুর কৃৎকৌশল ক্ষমতার মজ্জাগত স্বভাব।
পশু তার শিকারের খাদ্য সবসময় অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চায় না। অনেকক্ষেত্রে এক দলের অধিকারে থাকা খাবারে অন্যেরা ভাগ বসাতে চাইলে তুমুল হাঙ্গামা বেঁধে যায়। অথচ নাবালক শাবকের জন্য খাদ্য সংগ্রহে মা-পশুর মরিয়াভাব পশু-মানুষের মাতৃত্বের গরিমাকেই সম্মনীত করে। শুধুমাত্র বোধকরি মাতৃক্রোড়েই দ্বিপদ আর চতুষ্পদের সীমারেখা ঘুচিয়ে দ্যায়। শাবক অথবা নাবালক মাত্রই বাড়তি যত্ন স্নেহ ও সমাদর প্রার্থী। সমাজ পরিবেশে নাবালক কারা? 'নাবালক' শব্দটিকে শুধুমাত্র বয়সের মাপদন্ডে মাপা হবে নাকি তার ভাবনার পরিসর হবে বিস্তৃত? 'নাবালক' শব্দে যদি ছোট, অসহায় অর্থে ধরা যায় তবে অর্থ, জাতি, খ্যাতি ইত্যাদির সাথে যুক্ত করে ভাবা যেতেই পারে। তাহলে সেখানে কিঞ্চিৎ যত্ন স্নেহ সমাদরের কৃপাদৃষ্টি পড়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে আশা করি।
শুধু কি ক্ষমতা,তার বাইরেও যাদের থালায় অন্ন যথেষ্ট স্বচ্ছল, যারা প্রয়োজনে নয়, আয়োজনের বাহুল্যকে বিজ্ঞাপিত করে সমাজে প্রতিপত্তি আদায় ও সুনাম কুড়োতে চায় অভিযোগের তর্জনীর সম্মুখে সেই সংখ্যাও অগণিত। তারা কেবলমাত্র এক শ্রেণীর মানুষজনদের খুশি করতে ব্যাস্ত থাকে। তাদের এমন সংকীর্ণ দৃষ্টি- ভাবনা সমাজের পাওয়া না পাওয়ার বিভাজনের পাঁচিলকে দীর্ঘতর করে। প্রতিদিন কত খাদ্যের অপচয় হয়ে চলেছে, কত খাবার জায়গা নিচ্ছে আস্তাকুঁড়ের পচা জঞ্জালে। আর সেই ডাস্টবিনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকছে শিক্ষার উৎকর্ষে ও টেকনোলোজির চমকানো বিদ্যায় মোড়া অত্যাধুনিক সভ্যতার অভুক্ত ঈশ্বর।
পাথরের মূর্তির সম্মুখে নানাবিধ উপাচারে ভোগ ও প্রসাদ নিবেদনের যে ভ্রান্ত নিয়মনীতি, যে অযৌক্তিক ধারণা তার ভেতরে বিশ্বাস ও ভক্তি থাকলেও সার্থকতা থাকে না। পুঁথি পুরাণ পুস্তক সিনেমা সিরিয়াল সমস্ত চেটেপুটে জীব সেবাই শিব সেবার ধারনা মনে গেঁথে থাকলেও কাজের বাস্তবায়নে তিনশ ষাট ডিগ্রি বেঁকে অবস্থান নেয় সবাই। বাড়িতে অষ্টপ্রহর বা চব্বিশপ্রহর নামযজ্ঞ হবে,তিনদিন টানা প্রসাদ বিতরণ,কত ধুমধাম,কত লোকসমাগম, খাদ্যের তালিকায় নিত্যনতুন খাদ্যসম্ভার, কত কায়দার মেনুকার্ডে দেশি বিদেশী মেনুর গালভরা নামের ছড়াছড়ি কিন্তু শামিয়ানার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে গাঁয়ের এক প্রান্তের আদিবাসী - সাঁওতাল পরিবারের অভুক্ত গোপালরা। ছেলের মুখেভাত কি জন্মদিন,মেয়ের বিয়ে,বাবার শ্রাদ্ধ, নিজের বিবাহবার্ষিকী প্রভৃতি পারিবারিক উৎসব অনুষ্ঠানের অামন্ত্রণের তালিকায় নাম উঠবেনা ওদের, ওরা যারা সত্যিকারের খেতে পায় না। যাদের সাধ্য কোনদিন ক্ষিদে স্বাদ ও সাধকে পরিতৃপ্তি দ্যায়নি। আমন্ত্রণের তালিকায় সসম্মানে তাদের নাম লেখা হয়েছে যারা স্বাদবিলাসী। যার্ খিদের জন্য নয়, স্বাদের জন্য খায়। যাদের কাছে ভোজন উদরপূর্তি নয় রসনাতৃপ্তি,ক্ষুধা নিবৃত্তি নয় মুখগহ্বরের আর স্বাদকোরকের লালাময় সুধাক্ষরন। যার অন্নসংস্থানের সামর্থ্য আছে তাকে পঞ্চদশ ব্যঞ্জন সহযোগে ভোগ নিবেদনের আগ্রহ প্রকাশ আমাদের জড়ভাবাপন্ন মানসিকতার পরিচয় দেয়। ক্ষুধার্ত দুমুঠো অন্নের ভেতর তার পেট ভর্তির তৃপ্তিটুকু খোঁজে। সামান্যত প্রাপ্তির মধ্যেই অভুক্তের সন্তুষ্টি। অভুক্তের ক্ষুধা নিবৃত্তির অনাবিল আনন্দ প্রকাশ অন্নদাতার অন্তর্লোককে আলোকিত করে। অন্নদাতা ঈশ্বর। অন্নগ্রহীতাও ঈশ্বর।বর্তমান বিশ্বে অন্নদাতাদের মানসিক প্রসারতা অত্যন্ত জরুরি। ভাবনার প্রসারতা অত্যন্ত জরুরী। নইলে খাদ্যবিলাসী আর ক্ষুধার্তদের বৈষম্য সভ্যতার মধ্যেকার,মানুষের মধ্যেকার পশুভাবকেই প্রকটিত করবে। প্রসঙ্গত ক্ষুধার সূচকে যখন এ পোড়া দেশের স্থান নিম্নে সেই দেশের সোশাল মিডিয়া, দুরদর্শনের পর্দায় চোখধাঁধানো হেঁসেল আর রকমারি রান্নার লোভী প্রদর্শন আমাদের মহিমান্বিত করেনা,বরঞ্চ অভুক্তের দেশে আসুরিক মানসিকতাকে নগ্ন করে- মানবিকতাকে লজ্জা দ্যায়। অন্ন ঈশ্বর! ঈশ্বর সৃষ্ট রোদ জল হাওয়া নিসর্গসৌন্দর্য প্রভৃতির বন্টনে বৈষম্য নেই। তার সৃষ্টি সম্ভারে সবার সমান অধিকার। সাম্যের এই শিক্ষায় শিক্ষিত হোক সমাজসভ্যতা। অন্ততপক্ষে অন্নের থালায় সাম্যভাবনা দৃষ্ট হোক। অন্ন ঈশ্বর! ঈশ্বর সবাকার।
অভুক্তের দেশে রেঁস্তোরার বিজ্ঞাপন, জমকালো নামের খাদ্যের বিজ্ঞাপন, খাদ্যউৎসব উদযাপন তালিবানি মানসিকতার চেয়েও ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর।

Comments
Post a Comment